নির্বাচনি ইশতেহারে প্রাধান্য দেওয়া হলেও সমস্যা সমাধানে মেয়রের কোনো পদক্ষেপ দেখছেন না নগরবাসী।
Published : 22 Dec 2023, 09:02 AM
সিলেট শহর যেন হকারদের নগরীতে পরিণত হয়েছে। ফলে দিনভর যানজটে নাকাল হচ্ছেন পথে নামা মানুষ।
নগরবাসী বলছেন, দায়িত্ব নেওয়ার এক মাসেরও বেশি দিন পেরিয়ে গেলেও নগরীকে হকার ও যানজট মুক্ত করতে কোনো পদক্ষেপ নেননি নতুন মেয়র।
এদিকে, মেয়র মো. আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী বলছেন, অচিরেই সিলেট নগরীকে হকারমুক্ত করা হবে। নেওয়া হচ্ছে তাদের পুনর্বাসনের পরিকল্পনাও।
হকার ও যানজটমুক্ত নগরী গড়ার বিষয়ে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “এ বিষয়ে প্রশাসনের সঙ্গে মিটিং হয়েছে। আমি সবার আগে নগরবাসীর চাহিদাকে প্রাধান্য দিতে চাই। হকার ও যানজটমুক্ত নগরী গড়ে তোলা আমার নির্বাচনি ইশতেহারে রয়েছে।”
সিলেট মহানগর পুলিশের উপ-কমিশনার (ট্রাফিক) মোহাম্মদ মাহফুজুর রহমান বলেন, “সিলেট নগরীতে যানজট সৃষ্টির যেসব কারণ আছে, তার মধ্যে একটি হচ্ছে হাকারদের রাস্তা ও ফুটপাত দখল। এ ছাড়া নগরীর সরু রাস্তাগুলোতে গাড়ি পার্কিং করে রাখা।
“বিভিন্ন সময় রাজনৈতিক দলগুলো রাস্তার পাশে কর্মসূচি করার কারণেও যানজট বৃদ্ধি পায়। তবে যানজট নিরসনে ট্রাফিক বিভাগ নিরলসভাবে কাজ করছে।”
সরেজমিনে গত ১৩ ডিসেম্বর সন্ধ্যা ৭টার দিকে নগরীর বন্দরবাজার এলাকার সিলেট সিটি করপোরেশনের সামনে গিয়ে দেখা গেছে, নগর ভবনের সামনেই বিভিন্ন পণ্যের পসরা নিয়ে বসেছেন হকাররা। ফুটপাতের পাশাপাশি রাস্তার বেশিরভাগ অংশও তাদের দখলে। ফলে এ রাস্তায় যানজট লেগেই আছে। পুরো বন্দরবাজার ও তার আশপাশ এলাকাজুড়ে রয়েছেন ভাসমান বিক্রেতারা।
এসব ভাসমান দোকান থেকে শাক-সবজি, কাপড়, ফলমূল, মাছসহ নিত্যপণ্য কিনছেন ক্রেতারা।
পরদিন দুপুরের দিকে সরেজমিনে নগরীর গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট বা সড়ক মদিনা মাকের্ট, সুবিদবাজার, ওসমানী মেডিকেল রোড, রিকাবীবাজার, লামাবাজার, জিতুমিয়ার পয়েন্ট, আম্বরখানা, চৌহাট্টা, জিন্দাবাজার, ধোপাদিঘীরপাড়, সোবাহানীঘাট, উপশহর, শিবগঞ্জও টিলাগড় এলাকায়ও দেখা গেছে একই চিত্র।
যদিও গত বুধবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সফর উপলক্ষে হকারদের রাস্তায় বসতে দেওয়া হয়নি। কিন্তু ফের আগের অবস্থায় ফিরে যায় নগরীর রাস্তা ও ফুটপাত।
এ বিষয়ে নগরীর নয়াসড়ক এলাকার শাকিল হোসেন নামে একজন বলেন, “দীর্ঘদিন ধরে সিলেট নগরে গুরুত্বপূর্ণ রাস্তাগুলো হকারদের দখলে। তাদের উচ্ছেদে আগের মেয়র তার মেয়াদের শেষদিকে এসে কোনো ভূমিকা নেননি। আর বর্তমান মেয়র এখনও কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন বলে মনে হচ্ছে না।
“নগরের গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টের রাস্তাগুলোর দুই পাশেই হকার বসার কারণে নগরীজুড়ে যানজট লেগেইে আছে। ফুটপাতেও হাঁটার কোনো সুযোগ নেই। এসব দেখারও কেউ নেই।”
বন্দরবাজারের হাসান মার্কেটের ব্যবসায়ী আব্দুল মনাফ বলেন, “আমরা প্রতিমাসে দোকান ভাড়া, কর্মচারীর বেতন দিয়ে ব্যবসা করতে বসেছি। তবে অনেক দিন ধরে আমাদের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের সামনের অংশ ভাসমান বিক্রেতাদের দখলে।
“তাদের কাছে এখন সব ধরনের মালামাল পাওয়া যায়। এমনিতেই আমাদের আগের মত ব্যবসা-বাণিজ্য নেই। তার ওপর সকাল থেকেই হকাররা বসে যান। এ কারণে ক্রেতারা আগের মত দোকানে আসেন না। ব্যবসায়ীদের কথা চিন্তা করার মত কেউ নেই। হকারদের জন্য লালদিঘীর পাড়ে জায়গা থাকলেও তারা সেখানেও যান না। তাদের যেতে কেউ বাধ্যও করেন না।”
হাসান মার্কেটের সামনে ঠেলাগাড়িতে করে ফল বিক্রয় করছেন হাসান নামে এক ব্যক্তি।
নগরের গুরুত্বপূর্ণ সড়কে দাঁড়িয়ে ব্যবসা করার প্রশ্নে তিনি বলেন, “আমরা অনেকদিন ধরেই এভাবে ব্যবসা করে আসছি। আমাদের কাছ থেকে সবাই ভাগ পায়।”
নিজেদের জন্য নির্ধারিত লালদিঘীর পাড়ে গিয়ে কেন বসেন না জানতে চাইলে হাসান বলেন, “শহরের সব হকারই মেইন রোডে বসছে। সবাই গেলে ক্রেতারাও সেখান যাবেন। বর্তমানে সবাই সড়কে বসে বা দাঁড়িয়ে ব্যবসা করার কারণে আমরাও এখানে দাঁড়িয়ে বিক্রি করি।”
জিন্দাবাজারের লতিফ সেন্টারের ব্যবসায়ী জুয়েল আহমেদ বলেন, “শহরের মেইন সড়ক জিন্দাবাজরের দুপাশের রাস্তা দখল করে সকাল থেকেই বসে ব্যবসা করছেন হকাররা। আমাদের মার্কেটের সামনেও আছে। দুইপাশ দখল করে বসে থাকার কারণে যানজটও লেগে আছে। কেন যে হকারদের উচ্ছেদ করা হয় না, তা বুঝতে পারছি না। “শুনেছি, নগরীতে হকার বসার কারণে প্রতিদিন বিপুল পরিমাণ চাঁদা উঠে; তার ভাগ সবাই পান। তাই দীর্ঘদিন ধরে এভাবে চলছে। হকারদের কারণে ক্রেতারা মার্কেটের ভেতরে ঢুকতে অসুবিধা হয়। আর তাদের কাছে সব ধরনের মাল থাকার কারণে অনেকে মার্কেটে আসেন না, এতে আমাদের ব্যবসা-বাণিজ্য দিন দিন কমছে।”
টিলাগড়ের বাসিন্দা ইকবাল আহমেদ চৌধুরী বলেন, “যানজটের কারণে বাসা থেকে বন্দরবাজার আসতে প্রচুর সময় লাগে। সড়কের গুরুত্বপূর্ণ স্থানের দুই পাশের জায়গায় হকারা থাকার কারণে পয়েন্টে-পয়েন্টে যানজটে পড়তে হয়। বেশি জ্যাম থাকে বন্দরবাজারের আগে; দিন দিন সাধারণ মানুষের ভোগান্তি বাড়ছে।”
নাগরিক সমাজ কী বলছে
সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজন সিলেট চ্যাপ্টারের সভাপতি ফারুক মাহমুদ চৌধুরীর ভাষ্য, “নতুন মেয়র দায়িত্বে নেওয়ার এক মাসের বেশি সময় পেরিয়ে গেলেও নগরীর হকার ও যানজট নিরসনে কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি। কেন যে হচ্ছে না, বিষয়টি বোধগম্য নয়। মেয়র তো পাঁচ বছর দায়িত্বে আছেন, তাই আমাদের ধৈর্য ধরে দেখতে হবে কী উদ্যোগ নেওয়া হয়। এ ছাড়া আর কোনো উপায়ও নেই।”
সংক্ষুব্ধ নাগরিক আন্দোলনের সমন্বয়ক আব্দুল করিম কিম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “নতুন মেয়র দায়িত্ব নেওয়ার পর মানুষজনের প্রত্যাশা ছিল, শুরুতেই হকার সমস্যার সমাধান হবে। আগের মেয়রও হকার উচ্ছেদে উদ্যোগ নিলেও লোক দেখানো ছিল। এ অবস্থায় নতুন মেয়র হকার পুর্নবাসন ও উচ্ছেদে কার্যকর ভূমিকা রাখবেন, এটা নাগরিক প্রত্যাশা। সাম্প্রতিক সময়ে সিলেট শহরের অধিকাংশ সড়ক হকারদের দখলে।”
নাগরিক মৈত্রী সিলেটের সভাপতি সমর বিজয় সী শেখর বলেন, “নতুন মেয়রের নির্বাচনি ইশতেহার ছিল গ্রিন-ক্লিন-স্মার্ট সিলেট গড়া। তার ইশতেহার বাস্তবায়ন করতে হলে দ্রুতই নগরীর হকার ও যানজট সমস্যার সমাধান করতে হবে।”
ব্যবসায়ী নেতাদের ভাষ্য
মহানগর ব্যবসায়ী ঐক্য কল্যাণ পরিষদের সভাপতি আব্দুর রহমান রিপন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “মহানগরীর বেশিরভাগ রাস্তার দুপাশ এখন হকারদের দখলে। হকাররা সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত ফুটপাত ও রাস্তা দখল করে রাখছে। ফলে যানজট ও পথচারীদের চলাচলে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হচ্ছে। মার্কেটের সামনে ফুটপাত-রাস্তা দখল করে রাখায় ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।”
তিনি আরও বলেন, “এ বিষয়ে আমরা আগামী সপ্তাহে নতুন মেয়রের সঙ্গে সাক্ষাৎ করব। একইসঙ্গে চেম্বারকে জানাব, হকার উচ্ছেদে করণীয় বিষয়ে উদ্যোগ নিতে। আমরা নগরীর রাস্তাগুলো হকারমুক্ত করতে দীর্ঘদিন ধরে সিটি করপোরেশন, পুলিশ, বণিক সমিতিসহ প্রশাসনের নানা জায়গায় দাবি জানিয়েছি, তবু কাজ হয়নি। বেশিরভাগ গুরুত্বপূর্ণ স্থান তাদের দখলে থাকায় বর্তমানে ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে।”
রাস্তা-ফুটপাত দখলমুক্ত করার দাবিতে স্মারকলিপি
সিলেট নগরীর ফুটপাত ও রাস্তা দখলমুক্ত করার দাবিতে ১৩ ডিসেম্বর সিলেট সিটি করপোরেশনের মেয়রের কাছে স্মারকলিপি দিয়েছে সামাজিক সংগঠন সিলেট বিভাগ যুব কল্যাণ সংস্থা ও সিলেট প্রবাসী কল্যাণ সংস্থা।
সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি মোহাম্মদ এহছানুল হক তাহেরের নেতৃত্বে স্মারকলিপি প্রদানকালে মো. খলিলুর রহমান খাঁন, মো. আশরাফ উদ্দিন, মুখতার আহমেদ তালুকদার, মো. নজমুল হুসেইন, দীপক কুমার মোদক বিলু, মুসলেহ উদ্দিন চৌধুরী মিলাদ, নুর হোসেন, সৈয়দ রাসেল, মো. মহিবুর রহমান মুহিব ও লায়েক আহমদ ছিলেন।