‘পাস না করেও’ চাকরি: স্বাস্থ্য কর্মকর্তা বরখাস্ত, নিয়োগপ্রাপ্তদের বিরুদ্ধে মামলা

সিলেটের পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তারা এখন একে অন্যকে দুষছেন।

বাপ্পা মৈত্রসিলেট প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 29 March 2023, 02:27 PM
Updated : 29 March 2023, 02:27 PM

সিলেট জেলা পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তার কার্যালয় থেকে দুর্নীতির মাধ্যমে নিয়োগ পাওয়ার অভিযোগে আটজনের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। পরিবার কল্যাণ সহকারী পদে পরীক্ষায় পাস না করেও নিয়োগ পাওয়ার অভিযোগ আনা হয়েছে তাদের বিরুদ্ধে।

একই অভিযোগে একজন উপ-পরিচালককে চাকরি থেকে বরখাস্ত করে তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলার সুপারিশ এবং তিনি যেন দেশত্যাগ করতে না পারেন সে ব্যাপারে সতর্কবার্তা দিয়েছে মন্ত্রণালয়।  

মঙ্গলবার সিলেটের বিমানবন্দর থানায় মামলা করা হয় বলে সিলেট বিভাগের পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের পরিচালক (যুগ্ম সচিব) মো. কুতুব উদ্দিন জানিয়েছেন।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “প্রাথমিক তদন্তে অতিরিক্ত আট জনের নিয়োগের প্রমাণ মিলেছে; মামলার তদন্তে রেব হয়ে আসবে কিভাবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এ কাজের সঙ্গে কারা জড়িত তাও বের হবে।” 

মামলায় পরিবার কল্যাণ সহকারী পলি দাশ, পপি রাণী দাশ, মন্টি সরকার, স্নিগ্ধা সরকার, তাহসিন সুরমা কচি, শক্তি রাণী পাল, তাছলিমা আক্তার ও পূর্ণিমাকে আসামি করা হয়েছে।

‘অতিরিক্ত’ এই আটজনের চাকরির নিয়োগ জারির আদেশে স্বাক্ষর করেছেন- জেলা পরিবার পরিকল্পনা কার্যালয়ের উপ-পরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) ডা. লুৎফুন্নাহার জেসমিন, পরিবার পরিকল্পনা কার্যালয়ের উপ-পরিচালকের সহকারী বাশির উদ্দিন, জেলা কার্যালয়ে সংযুক্ত উপজেলা পরিবার পরিকল্পনা সহকারী বরুণ ছত্রী।

মামলার পর মঙ্গলবার উপসচিব মোহাম্মদ মোহসীন উদ্দিন স্বাক্ষরিত প্রজ্ঞাপনে উপ-পরিচালক ডা. লুৎফুন্নাহার জেসমিনকে বরখাস্ত করা হয়।

বুধবার দুপুরে বরখাস্তের প্রজ্ঞাপন পেয়েছেন বলে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান উপ-পরিচালক লুৎফুন্নাহার জেসমিন।

‘অতিরিক্ত’ আটজনের নিয়োগের অভিযোগের ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, “আমরা দেইনি, এসব জানতামও না। আগের নিয়োগ আদেশ থেকে সহকারীসহ আমার সই স্ক্যান করে দেওয়া হয়েছে। যাদের নিয়োগ দেওয়া হয়েছে তারা ওই সব গ্রামেরও না, ভুয়া।

“আমরা পাঁচটি আদেশে ৫০ জনকে নিয়োগ দিয়েছি। একজন তদন্তে বাদ পড়েছেন। আমাদের দেওয়া আদেশ আর জারি করা আদেশের মধ্যে মিল নেই।” 

তাহলে এসব আদেশে নিয়োগপ্রাপ্তরা যোগদান করলেন কীভাবে- এমন প্রশ্নে জেসমিন বলেন, “অফিসের অভ্যন্তরে থাকা সিন্ডিকেট পরিকল্পিতভাবে এই অনিয়ম করে আমাকে ফাঁসিয়েছে।”

জেলা পরিবার পরিকল্পনা কার্যালয়ের উপ-পরিচালকের সহকারী বাশির উদ্দিন বলেন, “যে চারটি নিয়োগের আদেশে অনিয়ম হয়েছে, সেগুলোর ফাইল স্বাক্ষর করেছেন বরুণ ছত্রী। এগুলোয় আমার কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই।” 

বরুণ ছত্রী বলেন, “না দেখে কিছু বলতে পারব না। এসব স্মারকে নিয়োগই হয়নি। স্বাক্ষর থাকলেও আমার কিছু বলার নেই, উপ-পরিচালক স্বাক্ষর করেছেন। সেগুলো স্ক্যান করা কি না, তিনিই ভালো বলতে পারবেন।”

৫ জন পাস করেননি, স্থায়ী ঠিকানা মেলেনি তিনজনের

সিলেট জেলা পরিবার পরিকল্পনা কার্যালয়ের একজন কর্মকর্তা জানান, ৫৫টি শূন্য পদে নিয়োগের চূড়ান্ত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছিলেন ৫১ জন। একজন বাদ পড়েন। ৫০ জনের নিয়োগ হওয়ার কথা। কিন্তু নিয়োগ পেয়েছেন ৫৮ জন। অতিরিক্ত আটজনকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।

এর মধ্যে লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ না হওয়া পাঁচজনকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া সবাইকে একটি আদেশে নিয়োগ দেওয়ার কথা থাকলেও পাঁচটি আলাদা আদেশ তাদের দেওয়া হয়েছে।

২০২১ সালের ১৮ জুন স্থানীয় পত্রিকায় সিলেট জেলা পরিবার পরিকল্পনা কার্যালয়ে চারটি পদে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হয়। বিজ্ঞপ্তিতে জেলার ৪৪টি ইউনিয়নের জন্য ৫৫টি পরিবার কল্যাণ সহকারী পদের জন্য স্থানীয় বাসিন্দাদের কাছ থেকে আবেদন চাওয়া হয়।

এসব পদে নিয়োগ কমিটির সভাপতি ছিলেন সিলেটের জেলা প্রশাসক মো. মজিবর রহমান, সদস্যসচিব জেলা পরিবার পরিকল্পনা কার্যালয় সিলেটের উপ-পরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) ডা. লুৎফুন্নাহার জেসমিন এবং সদস্য ছিলেন সিভিল সার্জন ডা. এস এম শাহরিয়ার।

২০২২ সালের ২৫ নভেম্বর ওই নিয়োগের লিখিত পরীক্ষা হয়। পরদিন, ২৬ নভেম্বর প্রকাশিত হয় ফলাফল। পরীক্ষায় ১৮৬ জন প্রার্থী উত্তীর্ণ হন। মৌখিক পরীক্ষার পর চূড়ান্তভাবে প্রার্থী নির্বাচনের ফল প্রকাশ করা হয় ওই বছরের ৩০ নভেম্বর। নিয়োগ কমিটি ৫৫টি পদের বিপরীতে ৫১ জনকে সুপারিশ করে চূড়ান্ত ফলাফল প্রকাশ করে। ফলাফল সরকারি দুটি ওয়েবসাইটেও রয়েছে।

তারপর ২০২২ সালের ৫ ডিসেম্বর জেলা মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্রের চিকিৎসা কর্মকর্তা আব্দুল মান্নাসহ সাতজন কর্মকর্তাকে স্থায়ী ঠিকানা যাচাইয়ের দায়িত্ব দেওয়া হয়। ৮ ডিসেম্বরের মধ্যে তাদের প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দেওয়া হয়। ঠিকানা যাচাই-বাছাইয়ের পর সঠিক হলে এক আদেশেই সব প্রার্থীর নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন হওয়ার কথা। কিন্তু ঠিকানা যাচাই-বাছাইয়ের পর পাঁচটি আদেশ জারি করা হয়।

এর মধ্যে ২০২২ সালের ১৮ ডিসেম্বর জারি করা প্রথম আদেশে ২৩ জনকে নিয়োগ দেওয়া হয়।

একই মাসের ২৮ তারিখ জারি করা দ্বিতীয় আদেশে নিয়োগ পান ১৭ জন।

এই আদেশে দক্ষিণ সুরমার বরইকান্দি ইউনিয়নে পলি দাশ এবং তেতলী ইউনিয়নে পপি রানী দাশ ও মন্টি সরকারকে পরিবারকল্যাণ সহকারী পদে নিয়োগ দেওয়া হয়। তাদের কারও রোল নম্বর চূড়ান্ত ফলাফলের তালিকায় নেই। এমনকি নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে বরইকান্দি ইউনিয়নে লোকবল নিয়োগের কথা উল্লেখও ছিল না।

এ বিষয়ে জানতে মোবাইল ফোনে পপি রানী দাশের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে নম্বরটি বন্ধ পাওয়া যায়। পলি দাশ ফোন কল রিসিভ করলেও এ ব্যাপারে কথা বলতে রাজি হননি।

তবে সব পরীক্ষায় পাস করেছেন বলে দাবি করেছেন মন্টি সরকার।

তার ভাষ্য, “আমার স্বামীর বাড়ি গোয়াইনঘাট। বাবার বাড়ি নেত্রকোণার কলমাকান্দায়। উপর থেকে নিয়োগ দিছে। চিঠি পেয়ে যোগদান করেছি।”

এ তিনজনের নিয়োগের বিষয়ে দক্ষিণ সুরমা উপজেলা সহকারী পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা মানুদা রঞ্জন তালুকদার বলেন, “পপি, পলি ও মন্টিকে জেলা অফিসের পাঠানো আদেশে নিয়ম মেনে যোগদানের সুযোগ দেওয়া হয়েছে। তবে তাদের সবার স্থায়ী ঠিকানা সঠিক নয়।” 

চলতি বছরের ১১ জানুয়ারি তৃতীয় আদেশে আরও আটজনকে নিয়োগ দেওয়া হয়। এতে স্নিগ্ধা বিশ্বাস নামের একজনকে গোলাপগঞ্জের ঢাকা দক্ষিণ ইউনিয়নে নিয়োগ দেওয়া হয়। অথচ ওই ইউনিয়নের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিই প্রকাশিত হয়নি। এই সিগ্ধা বিশ্বাসকে শুধু ঠিকানা পরিবর্তন করে দুই আদেশে দুই উপজেলার দুটি ইউনিটে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।

চলতি বছরের ১২ জানুয়ারি চতুর্থ আদেশে নিয়োগ দেওয়া হয় ছয়জনকে। এতে তাহসিন মাসুমা কচি ওসমানীনগরের উমরপুর ইউনিয়নের নিয়োগ পান। তিনি মৌখিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হননি।

এরপর গত ২ ফেব্রুয়ারি পঞ্চম আদেশে নিয়োগ দেওয়া হয় চারজনকে। এর মধ্যে বালাগঞ্জের সদর ইউনিয়নে নিয়োগপ্রাপ্ত শক্তি রানী পাল লিখিত ও মৌখিক কোনো পরীক্ষাতেই উত্তীর্ণ হননি। ওসমানীনগর উপজেলার কোনো ইউনিয়নের নিয়োগের বিজ্ঞপ্তিও প্রকাশিত হয়নি। কিন্তু ওসমানীনগর উপজেলার উছমানপুর ইউনিয়নে নিয়োগ দেওয়া হয় মৌখিক পরীক্ষায় ফেল করা পূর্ণিমাকে। একই ইউনিয়নে নিয়োগ পেয়েছেন তাছলিমা আক্তার ও সিগ্ধা বিশ্বাস।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে তাছলিমা আক্তার বলেন, “ভাইভা পরীক্ষায় পাস করিনি। আমাকে ওয়েটিং লিস্ট থেকে জেলা অফিস ফোনে ডেকে পাঠায়। সেখানে ডা. জেসমিন ম্যাম জনস্বার্থে উছমানপুরে কাজ করব কি-না জানতে চান। রাজি হলে নিয়োগ দেওয়া হয়।”

কিন্তু নিজের গ্রামের নাম নিয়ে দুই ধরনের তথ্য দেন তাসলিমা। একইভাবে নিয়োগ পান পূর্ণিমা। তার বাড়ি জৈন্তাপুর উপজেলার রামেশ্বর গ্রামে। তাসলিমা ও পূর্ণিমার মতো চাকরি পান শক্তি রানী পালও।

শক্তি রানী পাল বলেন, “আমার বাবার বাড়ি হবিগঞ্জের বানিয়াচংয়ে। তবে স্বামীর বাড়ি বালাগঞ্জের চানপুর।” 

নিয়োগ পাওয়া সিগ্ধা বিশ্বাসের ফোন নম্বর বন্ধ পাওয়া গেছে।

ওসমানীনগর উপজেলা পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা মহিতোষ মজুমদার বলেন, “নিয়োগ আদেশ জেলা অফিসের এক ই-মেইলে চার উপজেলায় পাঠানো হয়। নিয়োগপ্রাপ্তরা কাজে যোগ দিয়েছেন।”

উপ-পরিচালকের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা

স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ বিভাগের পক্ষ থেকে মঙ্গলবার উপ-পরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) ডা. লুৎফুন নাহার জেসমিনকে বরখাস্তের প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়।

এতে উল্লেখ করা হয়েছে, “লুৎফুন নাহার জেসমিনের বিরুদ্ধে আনীত জেলা পর্যায়ের নিয়োগে এখতিয়ার বহির্ভূত ও বেআইনিভাবে এবং দুর্নীতির আশ্রয় নিয়ে জেলা নিয়োগ ও বাছাই কমিটির সুপারিশ বহির্ভূত আটজনের অনুকূলে নিয়োগপত্র জারি সংক্রান্ত অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেছে। বিভাগীয় মামলা তদন্তের স্বার্থে তাকে চাকরি হতে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে।”

অপর একটি স্মারকে লুৎফুন নাহার জেসমিনের বিরুদ্ধে বিধি মোতাবেক শৃঙ্খলামূলক বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়।

এ ছাড়া আরও একটি স্মারকে পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ও সিলেটের জেলা প্রশাসক তথা নিয়োগ কমিটির সভাপতিকে জনবল নিয়োগ ও বাছাই কমিটির সুপারিশ বহির্ভূতভাবে নিয়োগকৃত আটজন ব্যক্তির নিয়োগপত্র বাতিলের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ ও বর্ণিত কর্মকর্তাসহ জড়িতদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা দায়েরের নির্দেশ দেওয়া হয়।

অন্য এক আদেশে লুৎফুন নাহার জেসমিনের বিদেশ গমনে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। স্মারকে তদন্ত নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত লুৎফুন নাহার জেসমিন যেন বিদেশে পলায়ন করতে না পারেন- এজন্য তার বিদেশ ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা জারির নির্দেশ দেওয়া হয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা সেবা বিভাগকে। 

বিভাগীয় তদন্ত কমিটি

সিলেট জেলা পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তার কার্যালয়ে নিয়োগ বাণিজ্যের বিষয়টি নজরে আসার পর উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন তদন্ত কমিটি তদন্ত কার্যক্রম শুরু করে।

কমিটির সদস্যরা হলেন- পরিবার পরিকল্পনা ঢাকা বিভাগের পরিচালক (যুগ্ম সচিব) মো. মাহবুব আলম, পরিবার পরিকল্পনা বিভাগের কেন্দ্রীয় পণ্যাগার (ড্রাগস এন্ড স্টোরস) এর অতিরিক্ত পরিচালক মো.আব্দুল বাতেন এবং পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের প্রশাসন ইউনিট সহকারী পরিচালক (পারা-১) মো. আব্দুল মান্নান।

কমিটির সদস্যরা মঙ্গলবার সিলেটের বিভাগীয় পরিবার পরিকল্পনা কার্যালয়ের পরিচালকের সভাকক্ষে সিলেট সংশ্লিষ্ট কয়েকজন কর্মকর্তাকে ডেকে কথা বলেন। তারপর প্রাথমিক সত্যতা পেয়ে মামলা ও বরখাস্তের নির্দেশ দেন।