‘লোভে ছেলেকে ইতালি পাঠায়ে এখন লাশ আনার সামর্থ্যও নাই’

শুক্রবার মাদারীপুরের রাজৈরের দুই যুবকের এবং মঙ্গলবার আরও তিনজনের মৃত্যুর খবর আসে।

মাদারীপুর প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 20 Feb 2024, 02:03 PM
Updated : 20 Feb 2024, 02:03 PM

ভূমধ্যসাগরের তিউনিসিয়া উপকূলে নৌ দুর্ঘটনায় নিহত বাংলাদেশি অভিবাসন প্রত্যাশী আটজনের মধ্যে পাঁচজনের বাড়ি মাদারীপুরের রাজৈর উপজেলায়। এ খবরে ওই পরিবারগুলোতে নেমে এসেছে শোকের ছায়া।

সন্তান, স্বামী, বাবা, ভাই হারিয়ে পরিবারগুলো দিশেহারা; তাদের বিলাপে উঠে এসেছে পরিবারকে সচ্ছল করতে নিহতদের বিদেশ যাওয়ার করুণ ও বিষাদ কাহিনি।

তারা আর কোনোদিনই ঘরে ফিরবেন না, এই শোক কিছুতেই মেনে নিতে পারছেন না স্বজনরা। তাদের আহাজারিতে ভারি হয়ে উঠেছে চারপাশ। প্রতিবেশীরাও ধরে রাখতে পারছে না চোখের জল। এই ঘটনায় দালালের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেছেন স্বজন ও এলাকাবাসী।

শুক্রবার প্রথমে উপজেলার দুই যুবকের মৃত্যুর খবর পাওয়া যায়। মঙ্গলবার আরও তিনজনের মৃত্যুর খবর আসে।

লিবিয়ায় বাংলাদেশ দূতাবাস জানিয়েছে, লিবিয়া উপকূল থেকে ৫২ জনের একদল অভিবাসী সাগরপথে ইউরোপ যাচ্ছিলেন। যাত্রার মধ্যে ১৫ ফেব্রুয়ারি তিউনিসিয়া উপকূলে তাদের বহনকারী নৌকাটিতে অগ্নিকাণ্ড হয়।

নিহত আটজনের মধ্যে পাঁচজনই মাদারীপুরের রাজৈর উপজেলার বাসিন্দা এবং বাকি তিনজন গোপালগঞ্জের মুকসুদপুর উপজেলার বলে জানিয়েছে লিবিয়ায় বাংলাদেশ দূতাবাস।

মাদারীপুরের নিহত পাঁচজন হলেন- উপজেলার খালিয়া ইউনিয়নের পশ্চিম স্বরমঙ্গল গ্রামের ইউসুফ আলী শেখের ছেলে মামুন শেখ (২০), সেনদিয়া গ্রামের সুনীল বৈরাগীর ছেলে সজল বৈরাগী (২৫), কবিরাজপুর ইউনিয়নের কিশোরদিয়া গ্রামের মৃত তোঁতা খলিফার ছেলে কায়সার খলিফা (৩৫), বাজিতপুর ইউনিয়নের কোদালিয়া গ্রামের মিজানুর রহমান কাজীর ছেলে সজীব কাজী (১৮) এবং কদমবাড়ি ইউনিয়নের এলাকার নয়ন বিশ্বাস।

মঙ্গলবার সরেজমিনে নিহতদের বাড়িতে যান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের প্রতিবেদক। কথা বলেন তাদের পরিবার, স্বজন ও এলাকাবাসীদের সঙ্গে।

নিহত সজীব কাজীর বাবা মিজানুর রহমান কাজী বলেন, “গোপালগঞ্জের মুকসুদপুর উপজেলার রাঘদী ইউনিয়নের গজনিয়া গ্রামের রহিম দালালের সঙ্গে ১৪ লাখ টাকা চুক্তি হয়। রহিমের ভাই কামাল আমার কাছ থেকে নগদ ১২ লাখ টাকা নিয়ে ছেলেকে লিবিয়া পাঠায়।

“পরে অতিরিক্ত যাত্রী বোঝাই করে ইঞ্জিনচালিত নৌকায় ইতালি পাঠানোর সময় ঘটে এই দুর্ঘটনা। শুনেছিলাম, আমার ছেলে সজীব আহত অবস্থায় চিকিৎসাধীন ছিল। দুইদিন পরে মৃত্যুর খবর পেয়েছি।”

উপজেলার কবিরাজপুর ইউনিয়নের কিশোরদিয়া গ্রামে গিয়ে কথা হয় নিহত কায়সার খলিফার স্ত্রী নাজমা বেগমের সঙ্গে।

তিনি বলেন, “রাজৈরের পাইকপাড়া ইউনিয়নের দামেড়চর গ্রামের অবুঝ মাতুব্বর প্রথমে সাড়ে আট লাখ টাকা চুক্তিতে লিবিয়া নেয়। পরে বড় ইঞ্জিনচালিত নৌকায় দেওয়ার কথা বলে আরও সাড়ে চার লাখ টাকা নেয় অবুঝ মাতুব্বর। কিন্তু ছোট একটি নৌকায় পাঠালে দুর্ঘটনায় আমার স্বামী মারা যান।

“সব কিছু বিক্রি করে এবং সুদে টাকা এনে স্বামীকে বিদেশে পাঠানোর স্বপ্ন দেখেছিলাম। এখন আমার সবই শেষ হয়ে গেল। আমার দুটি মেয়ে নিয়ে কীভাবে বাঁচবো”, বলে আহাজারি করতে থাকেন তিনি।

এদিকে কদমবাড়ি ইউনিয়নের নিহত নয়ন বিশ্বাসের ভাই আকাশ বিশ্বাস বলেন, “আমার ভাই ঢাকার এক দালালের মাধ্যমে লিবিয়া গিয়েছিল। পরে এই দুর্ঘটনার খবর শুনেছি। কিন্তু দালালের সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ রয়েছে। সে বলেছে আমার ভাই ভালো আছে। কিন্তু মিডিয়ার মাধ্যমে খবর পাচ্ছি, আমার ভাইয়ের নাম মৃতদের তালিকায় আসছে। এখন বুঝতেছি না। ঘটনা আসলে কী ঘটছে।”

নিহত মামুন শেখের বড় ভাই সজীব শেখ বলেন, “মানবপাচারকারী চক্রের সক্রিয় সদস্য গোপালগঞ্জের মুকসুদপুর উপজেলার রাঘদী ইউনিয়নের সুন্দরদী গ্রামের বাদশা কাজীর ছেলে মোশারফ কাজী। তিনি প্রলোভন দেখিয়ে প্রত্যেকের কাছ থেকে ১৩ থেকে ১৫ লাখ টাকা নেন।

“পরে অতিরিক্ত যাত্রী বোঝাই করে ইঞ্জিনচালিত নৌকায় ইতালিতে পাঠানোর সময় ইঞ্জিন ফেটে আগুন ধরে এই দুর্ঘটনা ঘটে। এখন কী বলবো কিছুই মাথায় আসছে না। অনেক স্বপ্ন নিয়ে ধার দেনা করে ভাইকে বিদেশ পাঠায়ছিলাম।”

সেনদিয়া গ্রামের নিহত সজল বৈরাগী বাবা সুনীল বৈরাগী বলেন, “আমি গরিব মানুষ। টাকার লোভে ছেলেকে স্বপ্নের দেশ ইতালি পাঠাতে চেয়েছিলাম। জমিজমা বিক্রি করে দালালের কাছে টাকা দিয়েছি। এখন আমার সবই শেষ হয়ে গেল।

“এখন ছেলের লাশটা দেখতে চাই। সরকার যেন লাশ আনার ব্যবস্থাটুকু করে। আমাদের লাশ ফিরিয়ে আনার সামর্থ্য আর নেই।”

রাজৈর থানার ওসি মো. আসাদুজ্জামান হাওলাদার আসাদ বলেন, “নিহতদের পরিবার থেকে অভিযোগ পেলে আমরা দালালদের বিরুদ্ধে আইনগত পদক্ষেপ গ্রহণ করব। এবং লাশগুলো যাতে দেশে আসতে পারে সেই বিষয়ে আমরা আন্তরিকতার সঙ্গে চেষ্টা করব।”

Also Read: ভূমধ্যসাগরে নৌ দুর্ঘটনায় নিহতদের ৮ জনই বাংলাদেশি