Published : 16 Mar 2023, 03:05 PM
ফেইসবুকে ‘ভুয়া আইডি খুলে’ সাম্প্রদায়িক উসকানি ছড়িয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়ি-ঘরে হামলার ঘটনায়একটি মামলায় ১৩ জনের কারাদণ্ডের রায় এসেছে। আসামিদের সবাইকে চার বছর কাটাতে হবে কারাগারে।
সাড়ে ছয় বছর আগে দেশজুড়ে আলোড়ন তোলা এই ঘটনায় করা আটটি মামলার মধ্যে এটাই প্রথম রায়।
বৃহস্পতিবার ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মুখ্য বিচারিক হাকিম মোহাম্মদ মাসুদ পারভেজ এই রায় দেন। সাজাপ্রাপ্ত সবাইকে ২ হাজার টাকা করে জারিমানাও করা হয়েছে।
দণ্ডিতদের মধ্যে আতিকুর রহমান আঁখি রয়েছেন, তিনি হরিপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান।
ফেইসবুকে রসরাজ দাস নামে এক তরুণের আইডি থেকে ধর্ম অবমাননাকর ছবি পোস্টের জেরে ২০১৬ সালের ৩০ অক্টোবর নাসিরনগর উপজেলা সদরে হিন্দুদের ১৫টি মন্দির ও অর্ধশতাধিক ঘর-বাড়িতে হামলা, ভাঙচুর ও আগুন দেওয়া হয়।
হামলার ঘটনায় স্থানীয় বারোয়ারি মন্দিরের পুরোহিতসহ দুই ব্যক্তি দুটি মামলা করেন। প্রত্যেকটি মামলায় অজ্ঞাতপরিচয় ১০০০ থেকে ১২০০ জনকে আসামি করা হয়। পরে পুলিশও কিছু মামলা করে।
এই ঘটনায় সে সময় যে আটটি মামলা করা হয়, তার মধ্যে রায় এসেছে উপজেলা সদরের পশ্চিমপাড়া এলাকার পুরাতন দুর্গামন্দিরে অগ্নিসংযোগের ঘটনায়।
মামলাটির করেন নাসিরনগর থানার তৎকালীন এসআই সাধন কান্তি চৌধুরী। দীর্ঘ তদন্তের পর ১৩ জনকে অভিযুক্ত করে আদালতে অভিযোগপত্র জমা পড়েছিল। তাদের সবারই সাজা হল।
এই সহিংসতার পরে রসরাজকে গ্রেপ্তার করেছিল পুলিশ, তাকে পাঁচ দিনের রিমান্ডেও নেওয়া হয়েছিল। পরে জানা যায়, তিনি একজন জেলে, যার অক্ষরজ্ঞান নেই, স্মার্টফোনও চালাতে পারেন না।
রসরাজ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেছিলেন, “ফেইসবুক কী জিনিস তা-ই আমি জানতাম না। অথচ ঘটনার দিন আমাকে একদল লোক মারতে মারতে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যায়। আমি গুরুতর আহত হই। পরে তারা আমাকে পুলিশের কাছে তুলে দেয়।”
এরই মধ্যে নাসিরনগরের ঘটনার তদন্তে নেমে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) তদন্তকারীরা জানতে পারেন রসরাজের মোবাইল ফোন থেকে ধর্মীয় অবমাননার ছবি আপলোড হয়নি। ওই ছবি সম্পাদনা করা হয়েছিল হরিণবেড় বাজারে আল আমিন সাইবার পয়েন্ট অ্যান্ড স্টুডিও থেকে, যার মালিক জাহাঙ্গীর আলম নামে এক ব্যক্তি।
ঘটনার শুরু থেকেই অভিযোগ ছিল, জাহাঙ্গীর আলম তার সাইবার ক্যাফে থেকে ধর্মীয় অবমাননাকর ছবিটি প্রিন্ট করে লিফলেট আকারে তা এলাকায় বিতরণ করেন। গত বছরের ২৮ নভেম্বর গ্রেপ্তার হওয়ার পর জাহাঙ্গীর ১৬৪ ধারায় দেওয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে তা স্বীকারও করেন।
যাদের সাজা
ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা আদালত পুলিশের পরিদর্শক (ইন্সপেক্টর) দিদারুল আলম জানান, দণ্ডপ্রাপ্তরা হলেন- দেওয়ান আতিকুর রহমান আঁখি, মো. মোখলেছ মিয়া, মো. মফিজুল হক, খসরু মিয়া, নাজির রহমান, মো. মাফুজ মিয়া, ইদু মিয়া, শেখ মো. আব্দুল আহাদ, সায়হাম রাব্বি শ্যাম, মীর কাশেম, আনিস মিয়া ও তাবারক রেজা, সজিব চৌধুরী।
এদের মধ্যে পাঁচজন পলাতক। বাকিরা রায় ঘোষণার সময় আদালতে উপস্থিত ছিলেন।
দণ্ডপ্রাপ্তদের সবার বাড়ি নাসিরনগর উপজেলার বিভিন্ন এলাকায়।
রায়ে ক্ষুব্ধ আসামিপক্ষ
আদালতের সিদ্ধান্তে অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন আসামিপক্ষের আইনজীবী কামরুজ্জামান মামুন। তার দাবি, সাজা হওয়ার মতো কিছু প্রমাণ করতে পারেনি রাষ্ট্রপক্ষ। ‘ন্যায়বিচার’ পেতে উচ্চ আদালতে যাওয়ার কথাও বলেছেন তিনি।
রায় ঘোষণার পর এক প্রতিক্রিয়ায় এই আইনজীবী বলেন, “যে কোনো মামলার সাজা দিতে গেলে ন্যূনতম সাক্ষ্য-প্রমাণ প্রয়োজন। কিন্তু সাক্ষ্য-প্রমাণহীন এই মামলায় ১৩ জনকে কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে।
“ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আইনাঙ্গনে ফরমায়েশি রায় এটিই প্রথম। আমরা ন্যায়বিচার পাইনি। এই রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে আপিল করে আমরা ন্যায়বিচার পাব বলে আশা করছি।”
তবে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী ও অতিরিক্ত পাবলিক প্রসিকিউটর নাজমুল হোসেন মনে করেন, এই রায়ে ন্যায়বিচার হয়েছে এবং এটি উদাহরণ হয়ে থাকবে।
তিনি বলেন, “পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে সাক্ষ্য-প্রমাণ বিচার বিশ্লেষণ করেই রায় ঘোষণা করা হয়েছে। এই রায়ের মাধ্যমে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং এটি অনুকরণীয় রায় হয়ে থাকবে।”