জয়পুরহাটের ৪৮ বধ্যভূমি চিহ্নিত হয়নি

জেলাবাসীর দাবি, সবগুলো গণকবর চিহ্নিত করে সরকারিভাবে সংরক্ষণ করা হোক।

মোমেন মুনিজয়পুরহাট প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 2 Dec 2022, 03:44 PM
Updated : 2 Dec 2022, 03:44 PM

জেলায় মোট ৫২টি গণকবর বা বধ্যভূমির কথা জানা গেলেও সরকারিভাবে মাত্র চারটিকে চিহ্নিত করা হয়েছে।

জেলাবাসীর দাবি, সবগুলো গণকবর চিহ্নিত করে সরকারিভাবে তালিকাভুক্ত ও সংরক্ষণ করা হোক।

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে জয়পুরহাটে শিশু ও নারীসহ হাজার হাজার মানুষকে হত্যা করে পাক হানাদার বাহিনী ও তাদের এ দেশীয় দোসররা।

তদানীন্তন বগুড়া জেলার মহকুমা জয়পুরহাট জেলার পথ ধরে শরণার্থী হয়ে ভারত যাওয়ার সময় ৯ মাসব্যাপী পাক বাহিনী হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে তাদের গণকবর দেয়।

এসব বিষয়ে কথা হয় জেলার সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব আমিনুল হক বাবুল, প্রবীণ আইনজীবী নন্দকিশোর আগরওয়ালা, শহীদ পরিবারের সন্তান ও প্রবীণ আলোক চিত্রশিল্পী রণজিত কুমার পাল (দশরত) সহ সে সময়ের প্রত্যক্ষদর্শী কয়েকজনের সঙ্গে।

তারা জানান, জেলায় মোট বধ্যভূমি আছে ৫২টি। এর মধ্যে চারটি সরকারিভাবে চিহ্নিত হয়। সেগুলোতে শহীদদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে সরকারি অর্থায়নে নির্মিত হয় স্মৃতিসৌধ।

চিহ্নিত বধ্যভূমিগুলো হচ্ছে- জয়পুরহাট সদর উপজেলার চকবরকত ইউনিয়নে পাগলা দেওয়ান, বম্বু ইউনিয়নের কড়ই-কাদিপুর, আক্কেলপুর উপজেলার আমুট্ট এবং পাঁচবিবি উপজেলার ধরঞ্জি ইউনিয়নের ভারতীয় সীমান্ত সংলগ্ন নন্দুইল বধ্যভূমি।

আক্কেলপুর উপজেলার বীর মুক্তিযোদ্ধা ও দেশ বরেণ্য চলচ্চিত্রকার মনতাজুর রহমান আকবর, জয়পুরহাট সদর উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কমান্ডার আফসার আলী, কালাই উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কমান্ডার মুনিশ চৌধুরীসহ প্রত্যক্ষদর্শী অনেকের সঙ্গে কথা হয়।

তারা জানান, ১৯৭১ সালে রাজাকারদের সহযোগিতায় পাক হানাদাররা দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে মুক্তিকামী মানুষদের ধরে এনে হত্যার পর মৃতদেহগুলো জেলার বিভিন্ন স্থানে গণকবর দেয়।

সদর উপজেলার কুঠিবাড়ি ব্রিজ, চিনিকল পুকুর পূর্বপাড়, ক্ষেতলাল উপজেলা পরিষদ প্রাঙ্গণ, পাঁববিবি উপজেলা ছোট যমুনা নদীর পাড়সহ জেলার ৫২টি স্থানে হত্যাযজ্ঞের শিকার নিরীহ মানুষের মরদেহগুলো গণকবর দেওয়া হয়। 

যদিও বধ্যভূমিগুলো সরকারি খাতায় এখনও স্থান পায়নি।

জেলার সবগুলো গণকবর চিহ্নিত করে সরকারি তালিকাভুক্ত ও সংরক্ষণের দাবি জানান সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব আমিনুল হক বাবুল, আইনজীবী নন্দকিশোর আগরওয়ালা, সদর ও কালাই উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কমান্ডার আফসার আলী এবং মুনিশ চৌধুরী।

রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃত চারটি বড় বধ্যভূমি আজও হানাদার বাহিনীর হত্যাযজ্ঞের সাক্ষ্য বহন করছে। 

পাগলা দেওয়ান বধ্যভূমি

জয়পুরহাট শহর থেকে ১৭ কিলোমিটার পশ্চিমে সদর উপজেলার সীমান্ত এলাকায় পাগলা-দেওয়ান নাম বধ্যভূমির অবস্থান।

(এই বধ্যভূমির দুটি গণকবরের একটি নাওগাঁ জেলার ধামইরহাট উপজেলার জাহানপুর ইউনিয়নে পড়েছে।)

পাকিস্তানি বাহিনীর সংঘটিত গণহত্যার অন্যতম উদাহরণ জয়পুরহাটের সদর উপজেলার পাগলা-দেওয়ান বধ্যভূমি।

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে প্রায় দশ হাজার নিরীহ বাঙালিকে হত্যা করে এখানে গণকবর দেওয়া হয়।

এ হত্যাকাণ্ডের আগে ভারত সীমান্ত এলাকার পাগলা দেওয়ান গ্রামসহ এ অঞ্চলে পাকিস্তানি বাহিনীর আনাগোনা শুরু হয় ওই বছরের এপ্রিল থেকে।

এর মাস দেড়েক পর ১৪ জুন একই গ্রামের মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ নেওয়া সলিম মিয়ার পোঁতা ডিনামাইটের আঘাতে হানাদার বাহিনীর একটি জিপ ধ্বংস হয়ে ছয় পাকিস্তানি সেনা নিহত হন।

এতে হানাদার বাহিনীর হিংস্রতা বেড়ে যায়। তারা জুমার (২০ জুন শুক্রবার) নামাজের পর বা নামাজরত অবস্থায় মসজিদ থেকে ১২২ জন নিরীহ মানুষকে ধরে এনে ওই গ্রামের একটি জায়গায় জড়ো করেন। তাদের মধ্যে বাহার মাস্টার নামের এক শিক্ষক মৃদু প্রতিবাদ করলে তাকে সঙ্গে সঙ্গে গুলি করে হত্যা করা হয়।

এরপর জড়ো করা মুসল্লিদের দুইটি দলে ভাগ করে এক দলকে দিয়ে গর্ত খোঁড়ানো হয়, আরেক দলকে কাঁটাযুক্ত ডাঁটার মত আগাছার স্তূুপের ওপর দিয়ে খালি পয়ে হাঁটানো হয়।

কাঁটার আঘাত ও ব্যথায় জ্ঞান হারান দলের সদস্যরা। পরে দুই দলের সবাইকে ধারালো ছোরা দিয়ে এলোপাথারি কুপিয়ে সেই গর্তে ফেলে দেওয়া হয়।

পাক বাহিনীর হত্যাযজ্ঞের এক পর্যায়ে বিকাল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামে। তখন প্রবল বজ্র- বৃষ্টি শুরু হলে পাক সেনারা এলাকা ছেড়ে চলে যান।

এদিকে, কুপিয়ে গর্তে ফেলে দেওয়া মুসল্লিদের মধ্যে এলাকার আকবর আলীসহ গুরুতর আহত সাত থেকে নয়জন ভাগ্যক্রমে সেখান থেকে আহত অবস্থায় বের হতে পেরেছিলেন। পরে স্থানীয়রা তাদের ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বালুরঘাট হাসপাতালে ভর্তি করালে তারা চিকিৎসা নিয়ে বেঁচে যান।

প্রত্যন্ত পাগলা দেওয়ান গ্রামের অবস্থান ভারতঘেঁষা হওয়ায় শরণার্থীরা গ্রামটিকে সীমান্তের ওপারে যাওয়ার নিরাপদ কড়িডোর হিসেবে জানতেন।

ফলে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে মানিকগঞ্জ, সিরাজগঞ্জ, টাঙ্গাইল, নাটোর, পাবনা, বগুড়া, নওগাঁসহ দেশের বিভিন্ন এলাকার হাজার হাজার মানুষ এদিক দিয়ে ভারত যাওয়ার পথে পাক হানাদাররা তাদের ধরে ধরে হত্যা করে। শুধু তা-ই নয়, নারীদের ধর্ষণও করে।

দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ২-৩ মাস পর্যন্ত গলিত মৃতদেহের দুর্গন্ধ পুরো এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে। জমি চাষের সময় লাঙ্গলের ফলায় মৃত দেহের হাড়গোড় বেরিয়ে আসতে থাকে।

এখানে পাকিস্তানিদের স্থাপন করা কংক্রিটের বাংকার ও এর আশপাশের এলাকাগুলো এখনও সেই ভয়াল স্মৃতিচিহ্ন বহন করছে।

হানাদারদের মধ্যযুগীয় কায়দায় নির্যাতনের এসব ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে বারবার শিউরে ওঠেন জয়পুরহাট সদর উপজেলা সংসদের কমান্ডার আফসার আলী।

তিনি বলেন, “এমন নির্যাতনের প্রতিবাদে ভারতে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ নিয়ে যুদ্ধে অংশ নিই।” 

কড়ই কাদিপুর বধ্যভূমি

জয়পুরহাট সদর উপজেলার কড়ই কাদিপুর গ্রামে এ বধ্যভূমির অবস্থান। ১৯৭১ সালের ২৬ এপ্রিল সোমবার হানাদার বাহিনী স্থানীয় আলবদর-রাজাকারদের সহযোগিতায় গ্রামটিকে ঘিরে ফেলে। পরে ৩৭১ জন পাল সম্প্রদায়ের (মৃৎশিল্পী) পুরুষকে একত্রিত করে এলোপাথারি গুলি চালিয়ে হত্যা করে। পুরুষশূন্য এ গ্রামটি যেন বিধবাদের আর্তনাদে এখনও ভারি হয়ে ওঠে। 

শহীদ পরিবারের সন্তান ও ফটোগ্রাফার দশরত পাল বলেন, “তখন আমার বয়স ৭/৮ বছর হবে, সব মনে আছে। পাক বাহিনী ও রাজারকাররা আমাদের গ্রাম ঘিরে ফেলে। চোখের সামনে আমার বাবা, কাকা, জ্যাঠা, দাদাদের ধরে লাইনে দাঁড় করিয়ে তাদের ব্রাশ ফায়ার করে হত্যা করে হানাদাররা। সে সময় মনে হয়েছে, আমি কোনো দুঃস্বপ্ন দেখছি।

“এখানে সরকারি উদ্যোগে (জেলা পরিষদ) স্মৃতিসৌধ নির্মিত হলেও অনাথ সেই আমিসহ শহীদ পরিবারের প্রায় সবাই অবহেলায় পড়ে রইলাম,” ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বলেন দশরত।

নন্দুইল বধ্যভূমি

জেলার পাঁচবিবি উপজেলার ধরঞ্জি ইউনিয়নের নন্দুইল গ্রামে আদিবাসী শহীদদের বধ্যভূমির অবস্থান।

১৯৭১ সালের এপ্রিল মাস থেকে পাক বাহিনীর তাণ্ডব শুরু হলে ওই গ্রামসহ আশপাশের আদিবাসীরা তীর-ধনুক নিয়ে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন।

তাদের ছোড়া তীরের আঘাত শত্রু বাহিনীর অনেকের বুক ভেদ করে। দেশকে পরাধীনতার হাত থেকে রক্ষা করতে আদিবাসী যুবকরা তীর-ধনুক দিয়ে পাক বাহিনীর সমরাস্ত্রের মোকাবেলা করতে গিয়ে গুলিতে বেশ কয়েকজন শহীদ হন।

এ ছাড়া অনেককে ধরে এনে হত্যা করে এ গ্রামে গর্ত করে তাদের পুঁতে রাখা হয়।

কোনো প্রত্যক্ষদর্শী না থাকায় ঠিক কতজন আদিবাসী নিহত হন বা কতজনকে গণকবর দেওয়া হয়েছে সে তথ্য আজও জানা যায়নি।

তবে কম পক্ষে আটজন আদিবাসীকে হত্যার ধারণা করা যায় বলে জানান ধরঞ্জি ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগ নেতা গোলাম মোস্তফা এবং সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব আমিনুল হক বাবুল।

আমুট্ট বধ্যভূমি

আক্কেলপুর উপজেলার রেল গেইটের অদূরে আমুট্ট খেলার মাঠ এলাকায় আমুট্ট বধ্যভূমির অবস্থান। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও তাদের দোসর রাজাকার, আল-বদররা এ জায়গাটিতে কম পক্ষে ২০ জন মুক্তিযোদ্ধাসহ অসংখ্য নিরীহ মুক্তিকামী মানুষের গলা কেটে ও গুলি করে হত্যা করে। এ ছাড়া সে সময় রাজাকাররা এখানে ট্রেন থামিয়ে লুটপাট ও যুবকদের ধরে এনে হত্যা করে।

এ গণকবরে শহীদের তালিকায় আটজনের নাম উল্লেখ থাকলেও অনেক শহীদ এখনও অজ্ঞাত পরিচয় হিসেবেই আছেন।

আটজন হলেন, একই উপজেলার গোপিনাথপুর গ্রামের সাবের জোয়ারদার, মোকলেছার রহমান, বানদিঘ গ্রামের নবির উদ্দিন, নজের আলী প্রামানিক, নছির প্রামানিক, আছের প্রামানিক, ডা. বুমচান এবং তোফাজ্জল হোসেন (তোফা)।

দেশ বরেণ্য চলচ্চিত্রকার ও আক্কেলপুরের মুক্তিযোদ্ধা মনতাজুর রহমান আকবর এ তথ্য জানান।

তিনি বলেন, “নিহতদের অনেককে এখানে গণকবর দেওয়া হয়। পরে ১৯৯৬ সালে আক্কেলপুর উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা ও মুক্তিযোদ্ধা নূর হোসেন তালুকদার এ গণকবরের ওপর স্মৃতিসৌধটি নির্মাণ করেন।”

জয়পুরহাট হানাদারমুক্ত দিবস

জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কমান্ডার আমজাদ হোসেন বলেন, “১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর পাকিস্তানি হানাদারদের হটিয়ে মুক্তিযোদ্ধারা বীর বিক্রমে জয়পুরহাটে প্রবেশ করে। তখন পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের এ দেশীয় দোসর রাজাকার-আলবদররা জীবন বাঁচাতে বগুড়া ও ঘোড়াঘাটের দিকে পালিয়ে যান।

মুক্তিযোদ্ধারা উল্লাসের মধ্যে দিয়ে ফাঁকা গুলি বর্ষণ করতে করতে জয়পুরহাটের ডাক বাংলোতে প্রবেশ করেন।

জয়পুরহাটের ডাক বাংলো প্রাঙ্গণে প্রথম স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করেন প্রয়াত মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার খন্দকার আসাদুজ্জামান বাবলু। যিনি বাঘা বাবলু নামে পরিচিত।  

বিজয়ের এ দিনকে স্মরণ রাখার জন্য জয়পুরহাটে শহীদ ডা. আবুল কাসেম ময়দানে ৭১ ফুট উচ্চ শহীদ স্মৃতি বিজয় স্তম্ভ নির্মাণ করা হয়েছে। প্রতি বছর নানা কর্মসূচির এ দিনটি পালন করেন জয়পুরহাটবাসী।

আমজাদ হোসেনের দেওয়া তথ্যে ১৯৯২ সালে সে সময়ের জেলা প্রশাসক সিরাজুল ইসলাম প্রথম গণকবরগুলোতে স্মৃতিসৌধ নির্মাণের উদ্যোগ নেন।