আক্রমণের আগে ছক আঁকতেন শাহাদাত আরা; আর আগরতলা মেডিকেল ক্যাম্পে আহত যোদ্ধাদের সেবা দিতেন কাওসার বেগম।
Published : 05 Dec 2022, 10:08 AM
সমাজের নানা প্রতিকূলতা পেরিয়ে নারীরা যোগ দিয়েছেন সম্মুখ সমরে; মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তায় বিভিন্ন তথ্য জোগাড় করেছেন জীবনের ঝুঁকি নিয়ে। অবদান রেখেছেন আহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা সেবায়ও।
রণাঙ্গনের সরাসরি না থেকেও মুক্তিযুদ্ধে অপরিসীম অবদান রেখেছেন ফেনীর শাহাদাত আরা বেগম ও কাওসার বেগম।
দেশের অভ্যন্তরে থেকে তথ্য সংগ্রহ করে মুক্তিযোদ্ধাদের রণকৌশল নির্ধারণে সহায়তা করেছেন শাহাদাত আরা। আর ভারতের আগরতলা হাসপাতালে আহত মুক্তিযোদ্ধাদের সেবায় নিরলস কাজ করেছেন কাওসার বেগম।
কয়েকটি আক্রমণের ছক এঁকেছিলেন শাহাদাত আরা:
এই বীর মুক্তিযোদ্ধার পৈত্রিক বাড়ি ফেনী জেলার সোনাগাজী উপজেলার উত্তর চরচান্দিয়া গ্রামে। স্বাধীনতার পর দীর্ঘদিন তিনি গার্লস গাইড অ্যাসোসিয়েশনে চাকরি করেছেন। এখন স্বামী সন্তানসহ ঢাকায় অবসর জীবন কাটছে তার। স্বাধীনতার ৫২ বছর পেরোলেও মুক্তিযুদ্ধের সময়কার চিত্র এখনও তার স্মৃতিতে জ্বল জ্বল।
মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচারণে তিনি বলেন, রাজাকার ও পাকিস্তানি বাহিনীর ওপর গেরিলাদের আক্রমণের আগে নির্দিষ্ট স্থান রেকি করতেন। এরপর ওই বাড়ি বা স্থানের ছক তৈরি করে গেরিলাদের রণকৌশল নির্ধারণে ভূমিকা রেখেছেন। শৈশবের বন্ধু সোনাগাজীর বীর মুক্তিযোদ্ধা মোশারফ হোসেন, নাছির উদ্দিন, শফিসহ অন্যান্য গেরিলা মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে একসঙ্গে কাজ করেছিলেন।
সোনাগাজীর তার বাবার বাড়িটি দাদা হাজী মাজহারুল হকের নামে পরিচিত। ওই বাড়িতেই মুক্তিযোদ্ধাদের আনাগোনা ছিল। চাচা মাহবুবুল হকসহ একাধিক আত্মীয় ছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা।
১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুথানের সময় ইডেন কলেজের ছাত্রী শাহাদাত আরা কলেজ প্রাঙ্গণে এক বিক্ষোভ কর্মসূচিতে আহত হয়েছিলেন। এরপর ১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চ ভাষণের পর পারিবারিক সিদ্ধান্তে তিনি সোনাগাজী চলে যান।
সে সময়ের গল্পে তিনি বলেন, “মার্চে সোনাগাজীতে সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হলে তাদের সঙ্গে যুক্ত হই। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে সোনাগাজীতে রাজাকার ফকির আহমদ ছিল আতঙ্কের নাম। সম্পদ লুট করতে গিয়ে ফকির ও তার সহযোগীরা কমপক্ষে ১৫ থেকে ২০ জন নিরীহ মানুষকে হত্যা করে।
“আমার প্রধান কাজ ছিল এই রাজাকারদের অবস্থান গেরিলাদের কাছে পৌঁছে দেওয়া এবং স্থানটির ছক তৈরি করা। এ কারণে বাড়ির সামনে এসে একাধিকবার রাজাকাররা হুমকি দেয় এবং আক্রমণের চেষ্টাও করে। বিপদ আঁচ করতে পারলে নিরাপদ স্থানে সরে পড়তাম।”
শাহাদাত আরা বলেন, ৬ ডিসেম্বর ফেনী হানাদারমুক্ত হলে রাজাকার ফকিরকে গেরিলারা তন্ন তন্ন করে খুঁজেও পাচ্ছিল না।
“আমার কাছে খবর ছিল ফরিদ আমাদের বাড়িতে একটি ঘরে লুকিয়ে আছে। তখন গেরিলাদের বললাম, আমাদের বাড়িতে খোঁজো। তারপর তাকে খুঁজে পাওয়া গেলে ব্রাশফায়ার করে মেরে ফেলা হয়।”
রাইফেল ছেড়ে নিয়ে নার্সিং প্রশিক্ষণ নেন কাওসার বেগম:
মুক্তিযুদ্ধের সময় পরিবারের সঙ্গে চট্টগ্রাম শহরে ঝাউতলায় তৎকালীন টিএনটি কলোনিতে থাকতেন বীর মুক্তিযোদ্ধা কাওসার বেগম। তার বড় ভাই ফেরদৌস আহমেদ কোরেশীসহ তিন ভাই বীর মুক্তিযোদ্ধা।
নিজে কাজ করেছেন আগরতলায় মেডিকেল ক্যাম্পে। পাঁচ বোনের তিনবোনই আহত বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সেবা করেছেন।
কাওসার বেগম বলেন, মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে বিহারীরা তাদের পরিবারের উপর আক্রমণ করে। প্রতিবেশী একটি পরিবার সাত দিন ঠাঁই দিলেও পরে অপারগতা জানায়। পরে তার বাবা পাঁচ বোনকে নিয়ে চট্টগ্রাম থেকে ফেনীর দাগনভূঞার পৈতৃক বাড়ি চলে আসেন।
“কিন্তু এখানেও ঠাঁই মিলল না। বারবার রাজাকার এসে বাবাকে ধরে নিয়ে যেতো। এভাবে আমাদের কয়েক রাত কেটেছে ঝোঁপের ভেতরে পোকামাকড়ের সঙ্গে। এরই মধ্যে গ্রামবাসী আমাদের বোঝা মনে করল। আমার ভাইদের কারণে তারাও বিপদে পড়ছিলো।
“পরে বাধ্য হয়ে আমরা চার বোন আর ছোট দুই ভাই মিলে বিলোনিয়া সীমান্ত দিয়ে ভারত পাড়ি দেই।”
এই বীর মুক্তিযোদ্ধা আরও বলেন, “তখন আমার বড় তিন ভাই আগরতলায়। সেখানে আমিসহ বোনরা ১০ দিন রাইফেল চালানোর প্রশিক্ষণ নিই। কিন্তু এর মাঝে খবর আসে যুদ্ধক্ষেত্রে প্রচুর মুক্তিযোদ্ধা হতাহত হচ্ছেন। তখন প্রশিক্ষক বলেছিলেন, সবাই রাইফেল প্রশিক্ষণ না নিয়ে নার্সিং প্রশিক্ষণ নেন। আহতদের সেবা করুন।
“আমার ভাইদের পরামর্শে বড় বোন সালেহা বেগমসহ আমি চোত্তাখোলায় নার্সিং মেডিকেলে প্রশিক্ষণ নিই। এরপর হাসপাতালের কাজে লেগে যাই।”
ভয়াবহ সেই দিনগুলি স্মরণ করে কাওসার বেগম বলেন, “প্রশিক্ষণ শেষে প্রথম যেদিন হাসপাতালে গেলাম, দেখতে পাই বালতি আর বালতি, তাতে কাটা হাত-পা ভরতি। হাসপাতালে সিঁড়ির নিচেও স্তূপ করে রাখা হয়েছে হাত-পা। সে সময় যে মেয়েগুলো সেবা দিচ্ছিলো তাদের হাত-কাপড় রক্তে ভেজা; ভয়ে কাঁপছিলো তারা।
“তখন জানতে পারি কাটা হাত-পাগুলো আহত মুক্তিযোদ্ধাদের। ডাক্তার ও নার্স সঙ্কটের কারণে অতিরিক্ত সংখ্যক আহতকে চিকিৎসা দেওয়া যাচ্ছিল না। ক্ষতস্থানে পচন ধরে মৃত্যু ঘটবে ভেবে জীবন বাঁচাতে পঙ্গুত্ব মেনে নিতে হয়েছে যুদ্ধাহতদের।”
“ভবনের উপরে নিচে আহত মুক্তিযোদ্ধাদের আর্তনাদ ভেসে আসছিলো। আমাদের দেখে আহতরা বলছিল, আমাদের বাঁচান। তারা বলছিল, আমাদের মা-বোনরা এসেছে, এবার আমাদের চিকিৎসা হবে।”
যুদ্ধ শেষ হওয়া পর্যন্ত তিনি বিলোনিয়ার আগরতলা হাসপাতালে নিরলস চিকিৎসা সেবা দিয়েছিলেন বলে কাউসার বেগম জানান।