শামীম ওসমান বলেন, “যদি সরকার বিচারবিভাগীয় তদন্তের ব্যবস্থা করে এবং আমি সেই তদন্ত কার্যক্রমকে প্রভাবিত করব বলে সন্দেহ হয়, তাহলে প্রয়োজনে তদন্তকালে আমার সংসদ সদস্য পদও স্থগিত রাখা হোক।”
Published : 06 Mar 2024, 06:30 PM
মামলার নথিপত্র আদালতে উঠেছে অন্তত ৭০ বার। আদালত তাগিদও দিয়েছে; কিন্তু দীর্ঘ ১১ বছরেও নারায়ণগঞ্জের মেধাবী কিশোর তানভীর মুহাম্মদ ত্বকী হত্যা মামলার অভিযোগপত্র জমা দিতে পারেনি তদন্তকারী সংস্থা র্যাব। এতে শুরু করা যায়নি মামলাটির বিচারকাজ।
যদিও হত্যাকাণ্ডের এক বছরের মাথায় সংবাদ সম্মেলন করে র্যাবের তৎকালীন অতিরিক্ত মহাপরিচালক কর্নেল জিয়াউল আহসান জানিয়েছিলেন, ত্বকী হত্যার কারণ স্পষ্ট, আসামিও চিহ্নিত। অভিযোগপত্রও প্রায় তৈরি। অল্প সময়ের মধ্যে তা আদালতে দাখিল করা হবে।
সেটি দীর্ঘ ১০ বছরেও সম্ভব হয়নি বলে ত্বকীর বাবা রফিউর রাব্বির অভিযোগ। তিনি বলছিলেন, নারায়ণগঞ্জের প্রভাবশালী ওসমান পরিবারের লোকজন এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত বলে ‘অঘোষিত ইনডেমনিটি’র কারণে তৈরি করে রাখা অভিযোগপত্র আদালতে আর জমা দেয়নি র্যাব।
২০১৩ সালের ৬ মার্চ বিকালে শহরের শায়েস্তা খাঁ সড়কের বাসা থেকে বেরিয়ে নিখোঁজ হয় মেধাবী কিশোর তানভীর মুহাম্মদ ত্বকী।
পরদিনই মেধাবী এই কিশোরের এ লেভেল পরীক্ষার ফল প্রকাশিত হয়। ফলাফলে জানা যায়, ত্বকী পদার্থবিজ্ঞানে (২৯৭/৩০০) সারাবিশ্বে এবং রসায়নে (২৯৪/৩০০) বাংলাদেশের মধ্যে সর্বোচ্চ নম্বর পায়।
এই ফলাফল দেখার সৌভাগ্য হয়নি তার। ৮ মার্চ সকালে শহরের পাঁচ নম্বর ঘাট এলাকায় শীতলক্ষ্যা নদীর শাখা খাল (কুমুদিনী খাল) থেকে তার মরদেহ উদ্ধার হয়।
নিখোঁজ হওয়ার দিন বিকালে শহরের সুধীজন পাঠাগার হয়ে চাষাঢ়ায় বাবার ব্যবসায়িক কার্যালয়ে যাওয়ার কথা ছিল ত্বকীর।
সেখানে না যাওয়ায় অনেক খোঁজাখুঁজির পর সন্ধ্যায় নারায়ণগঞ্জ সদর মডেল থানায় সাধারণ ডায়েরি করেন ত্বকীর বাবা রফিউর রাব্বি।
খাল থেকে মরদেহ উদ্ধারের পর অজ্ঞাতদের আসামি করে হত্যা মামলা করা হয়।
একই বছরের ১৮ মার্চ নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনে আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য এ কে এম শামীম ওসমান, তার ছেলে অয়ন ওসমান, জেলা যুবলীগের বহিষ্কৃত নেতা জহিরুল ইসলাম পারভেজ ওরফে ক্যাঙারু পারভেজ, জেলা ছাত্রলীগের সহসভাপতি রাজীব দাস, সাধারণ সম্পাদক মিজানুর রহমান সুজন, সালেহ রহমান সীমান্ত ও রিফাত বিন ওসমান ত্বকী হত্যার সঙ্গে জড়িত উল্লেখ করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে একটি অবগতিপত্র দেন রফিউর রাব্বি।
তিনি অভিযোগ করেন, ত্বকীকে অপহরণের পর আজমেরী ওসমানের ‘টর্চার সেল’ উইনার ফ্যাশনে নিয়ে গিয়ে নির্যাতন করে হত্যা করা হয়।
বাদীর আবেদনে উচ্চ আদালতের নির্দেশে মামলাটি থানা পুলিশ থেকে ওই বছরের ২০ জুন র্যাবে হস্তান্তর হয়। এরপর ৭ আগস্ট উইনার ফ্যাশনে অভিযান চালায় র্যাব। সেখান থেকে রক্তমাখা জিন্স প্যান্ট, পিস্তলের বাট, ইয়াবার সরঞ্জাম উদ্ধারের কথা জানায় র্যাব। ওই সময় উদ্ধার হওয়া রক্তমাখা জিন্স প্যান্টটি তরুণ আশিকুল ইসলামের বলে দাবি করেছিলেন রফিউর রাব্বি। আশিক তার চাচাতো বোনের ছেলে। ২০১১ সালের ১১ মে সন্ধ্যায় নিখোঁজ হওয়ার দু’দিন পর শীতলক্ষ্যা থেকে মেলে আশিকের অর্ধনগ্ন মরদেহ। আশিকের মৃত্যুর পেছনেও ওসমান পরিবারের লোকজনের সম্পৃক্ততার অভিযোগ উঠেছিল।
আশিক হত্যার দুই বছরের মাথায় ত্বকী হত্যার শিকার হয়। ত্বকী হত্যা মামলায় পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। এদের মধ্যে ইউসুফ হোসেন লিটন ও সুলতান শওকত ভ্রমর ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৪ ধারায় আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন।
নিহত ত্বকী নারায়ণগঞ্জের সাংস্কৃতিক ও নাগরিক আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক শিল্পী রফিউর রাব্বির বড় ছেলে।
বাবা রফিউর রাব্বিকে শায়েস্তা করতেই ছেলেকে হত্যা করা হয়েছে বলে ২০১৪ সালের ৫ মার্চ সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছিলেন র্যাবের তৎকালীন অতিরিক্ত মহাপরিচালক কর্নেল জিয়াউল আহসান।
তবে অভিযোগ প্রসঙ্গে মন্তব্যের জন্য আজমেরী ওসমানের মোবাইল ফোনের নম্বরে একাধিকবার কল করেও সংযোগ পাওয়া যায়নি। খুদেবার্তা পাঠিয়েও কোনো সাড়া মেলেনি।
আজমেরী ওসমানের বাবা প্রয়াত এ কে এম নাসিম ওসমান জাতীয় পার্টি থেকে নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনে চারবারের নির্বাচিত সংসদ সদস্য ছিলেন।
সংবাদ সম্মেলনে তদন্তের একটি ‘খসড়া প্রতিবেদন’ সাংবাদিকদের কাছে সরবরাহ করে তদন্তকারী সংস্থাটি।
সেখানে হত্যার কারণ ও জড়িতদের বিষয় সবিস্তারে উল্লেখ করা হয়।
হত্যার কারণ হিসেবে র্যাব জানায়, ২০১১ সালে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী এ কে এম শামীম ওসমানের বিরুদ্ধে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভী। ওই সময় আইভীর নির্বাচন পরিচালনা কমিটির সদস্যসচিব ছিলেন রফিউর রাব্বি। নির্বাচনে বিপুল ভোটের ব্যবধানে হেরে যান শামীম ওসমান।
এ ছাড়া ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ রুটে চলাচলকারী বিভিন্ন পরিবহনের মালিকেরা ওসমান পরিবারের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির অভিযোগ করেন। রফিউর রাব্বি এই চাঁদাবাজির বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন। স্থানীয় ভূমিদস্যুদের বিরুদ্ধে আন্দোলনেও সোচ্চার ছিলেন রফিউর রাব্বি। এসব কারণেই রাব্বির প্রতি ক্ষুব্ধ হয়ে তাকে শায়েস্তা করতে ছেলেকে অপহরণ করে হত্যা করা হয়।
ত্বকী হত্যাকাণ্ডের প্রথম বর্ষপূর্তিতে র্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক কর্নেল জিয়াউল আহসান সংবাদ মাধ্যমে এসব তথ্য তুলে ধরেন। যা সে সময় প্রায় সব সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত ও প্রচারিত হয়।
ওই সময় র্যাব আরও জানায়, আজমেরী ওসমানের নির্দেশে এবং প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণে সহযোগীদের নিয়ে ত্বকীকে হত্যা করা হয়। পরে লাশ ফেলা হয় শীতলক্ষ্যা নদীর শাখা খালে।
অচিরেই এই হত্যাকাণ্ডের অভিযোগপত্র দাখিল করার কথা জানালেও তা আর আলোর মুখ দেখেনি।
এদিকে, গ্রেপ্তার আসামিরাও জামিনে বেরিয়ে এসে এখন পলাতক।
শুরুতে এই মামলা নারায়ণগঞ্জ সদর মডেল থানা তদন্ত করলেও উচ্চ আদালতের নির্দেশে তদন্তের দায়িত্ব পায় র্যাব-১১।
‘হত্যার কারণ স্পষ্ট ও আসামিরা চিহ্নিত’ হওয়ার পরও অভিযোগপত্র দাখিল না করায় ভুক্তভোগী পরিবার বিচার পাওয়ার সাংবিধানিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে বলে মন্তব্য করেন এই মামলার বাদীপক্ষের আইনজীবী প্রদীপ ঘোষ।
তিনি বলেন, “তদন্তকারী সংস্থা র্যাব দেশের সকল গণমাধ্যমকর্মীদের ডেকে সংবাদ সম্মেলনে কে, কেন, কীভাবে ত্বকীকে হত্যা করেছে বিস্তারিত জানিয়েছে। এই মামলায় গ্রেপ্তার সুলতান শওকত ভ্রমর ১৬৪ ধারায় জবানবন্দিতে আজমেরী ওসমানসহ একাধিক ব্যক্তির এই হত্যাকাণ্ডে সরাসরি জড়িতের কথা বলেছে। এই হত্যা মামলার সবকিছুই স্পষ্ট। তারপরও আদালতে অভিযোগপত্র দিচ্ছে না র্যাব। মামলাটি এখন পর্যন্ত ৭০ বার আদালতে উঠেছে। আদালত তাগিদ দিলেও কোনো তারিখেই র্যাব তাদের অভিযোগপত্র এখন পর্যন্ত জমা দেয়নি। রাষ্ট্রের ঊর্ধ্বতন কর্তা-ব্যক্তিরা এগিয়ে না এলে ভুক্তভোগী পরিবার বিচার পাওয়ার যে সাংবিধানিক অধিকার তা থেকে বঞ্চিত হতে হবে।”
মামলাটির সর্বশেষ তারিখ গিয়েছে ২০ ফেব্রুয়ারি। ওইদিনও র্যাব তদন্তের জন্য আরও সময় চেয়ে আবেদন করে বলে জানান, আইনজীবী প্রদীপ ঘোষ।
জানতে চাইলে মামলাটির তদন্তকারী সংস্থা র্যাব-১১ এর অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল তানভীর মাহমুদ পাশার দাবি, মামলাটি এখনও তদন্তাধীন। তদন্ত শেষ করতে আরও সময় লাগবে বলে জানান। তবে সেই সময় কত দিন সে বিষয়ে সুনির্দিষ্ট করে কিছু বলতে পারেননি তিনি।
বলেন, “তদন্ত কাজ চলমান আছে। তদন্ত শেষ করতে আমাদের আরও সময় লাগবে। মামলাটি একটু জটিল। তাছাড়া বেশ কয়েকবার তদন্তকারী কর্মকর্তা বদলিজনিত কারণে পরিবর্তন হয়েছেন। কবে নাগাদ শেষ হবে তা বলতে পারছি না।”
তবে, মামলাটির তদন্ত দ্রুত শেষ করে প্রতিবেদন দাখিলের জন্য র্যাবের সদরদপ্তর থেকেও তাগিদ দেওয়া হয়েছে বলে জানান, র্যাব-১১ এর এই কর্মকর্তা।
তিনি বলেন, “মাসখানেক ধরে তদন্তে র্যাব সদরদপ্তরও আমাদের সঙ্গে সমন্বিতভাবে কাজ করছে। দ্রুতই তদন্ত শেষ করতে পারব।”
‘ওপর মহলের নির্দেশে অভিযোগপত্র দাখিল করা হচ্ছে না’ এ অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে তানভীর মাহমুদ বলেন, “আমার ওপর এমন কোনো নির্দেশনা নেই। আমরা স্বাভাবিক প্রক্রিয়া অনুযায়ী তদন্ত করছি।”
এদিকে, ‘অঘোষিত ইনডেমনিটি’র কারণে এই মামলার অভিযোগপত্র আদালতে দাখিল করা হচ্ছে না বলে অভিযোগ নিহত ত্বকীর বাবা সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব রফিউর রাব্বির।
তিনি বলেন, “এই হত্যাকাণ্ডের কোনো কিছুই কারও অজানা নয়। আমরা বারবার বলে আসছি, এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গ শামীম ওসমান, তার ছেলে অয়ন ওসমান, ভাতিজা আজমেরী ওসমানসহ তাদের সহযোগীরা সরাসরি যুক্ত। র্যাব এক বছরের মাথায় সংবাদ সম্মেলন করে সবই জানাল। তারপর সংসদে দাঁড়িয়ে ওসমান পরিবারের পাশে থাকার কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রীর দেওয়া বক্তব্যের পর থেকেই সবকিছু বন্ধ।”
দীর্ঘসূত্রতা থাকলেও এই হত্যাকাণ্ডের বিচার হবে এবং দোষীরা শাস্তি পাবেন বলে আশাবাদী সন্তানহারা এই পিতা।
তিনি বলেন, “ত্বকী হত্যার বিচার হবেই। এই সরকার থাকতে হোক কিংবা পরেই হোক। এই হত্যাকাণ্ডের দৃষ্টান্তমূলক বিচার হবে।”
এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে সংসদ সদস্য এ কে এম শামীম ওসমান বলেন, ত্বকী হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে তিনি কিংবা তার পরিবারের কোনো সদস্য সম্পৃক্ত নন। রাজনৈতিকভাবে তার পরিবারকে ক্ষতিগ্রস্ত করার জন্য এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে তাদের নাম যুক্ত করা হয়েছে। তিনি এই হত্যা মামলাটির বিচারবিভাগীয় তদন্তের দাবি জানান।
এ সংসদ সদস্য বলেন, “নারায়ণগঞ্জে সাত খুন মামলার মতো ত্বকী হত্যাকাণ্ডটিকে রাজনীতিকরণ করা হয়েছে। ত্বকী হত্যাকাণ্ডের তদন্ত মেজর আরিফরাই (সাত খুন মামলায় দণ্ডিত র্যাবের সাবেক কর্মকর্তা) করেছিল, যে আরিফরা অর্থের বিনিময়ে একজন মানুষকে মারতে গিয়ে বিনা অপরাধে সাতজন মানুষকে মেরে ফেলে; যারা এই ধরনের মেন্টালিটি রাখে তাদের তদন্ত কতটুকু সত্য সেটাও দেখার বিষয়।”
শামীম ওসমান আরও বলেন, “একজন পিতা হিসেবে ব্যক্তিগতভাবে এই ঘটনার বিচারবিভাগীয় তদন্তের দাবি জানাই। যেভাবে তার (ত্বকী) পরিবার সন্তুষ্ট হয় সেইভাবেই তদন্ত হোক। যদি সরকার বিচারবিভাগীয় তদন্তের ব্যবস্থা করে এবং আমি সেই তদন্ত কার্যক্রমকে প্রভাবিত করব বলে সন্দেহ করা হয়, তাহলে প্রয়োজনে তদন্তকালে আমার সংসদ সদস্য পদও স্থগিত রাখা হোক।”