মারমা, রাখাইন ও বার্মিজ ভাষার বর্ণমালা একই রকম। ভৌগোলিকভাবে কেবল দেশ, অঞ্চল ও এলাকাভেদে সুর ও উচ্চারণের একটু পার্থক্য দেখা যায়।
Published : 21 Feb 2024, 07:18 PM
ভাষার মানচিত্র থেকে প্রতি পক্ষে একটি করে মাতৃভাষা হারিয়ে যাওয়ার দুঃসময়েও পার্বত্য চট্টগ্রামে মারমাদের ভাষাচর্চা দিন দিন বাড়ছে। নতুন প্রজন্মের মেধা ও সৃজনশীলতার কল্যাণে সামাজিক ও ধর্মীয় উৎসবে এখন মাতৃভাষার লিখিত রূপ ব্যবহার হচ্ছে আগের তুলনায় বেশি।
উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অধ্যয়নরত মারমা শিক্ষার্থীরা নিজেদের বর্ণমালায় সম্প্রদায়ের জন্য ‘ভাষা শিক্ষা কোর্স’ চালু করেছেন। ফলে আগে যে ভাষা শিক্ষার চর্চাটা শুধু বিহার বা ভান্তেকেন্দ্রিক ছিল, সেটা এখন আরও নানা স্থানে, নানামাত্রায় বিস্তৃত হয়েছে।
বান্দরবানের মারমাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, একসময় কেবল পাড়ার বয়স্ক ব্যক্তিরাই মাতৃভাষায় ভালভাবে লিখতে-পড়তে পারতেন। মাঝখানে বড় একটা সময় গেছে যখন মারমাদের মধ্যে মাতৃভাষার চর্চা কমে গিয়েছিল।
গত এক দশকে মাতৃভাষায় বিভিন্ন পর্যায়ে প্রচার-আলাপচারিতা বাড়ার পাশাপাশি চর্চার গুরুত্বও বেড়েছে। নিজের আগ্রহে কেউ বৌদ্ধবিহারে গিয়ে শিখছেন, কেউ শিখছেন সমবয়সী কারো কাছে।
ডিপার্টমেন্ট অব মিয়ানমার অ্যান্ড ল্যাংগুয়েজ এর অধীন মিয়ানমার ল্যাংগুয়েজ কমিশনের মতে, মারমা জনগোষ্ঠীর ভাষা মূলত তিব্বতী-বর্মী ভাষা গোষ্ঠী। এর উৎপত্তি ঘটেছে প্রাচীন ভারতবর্ষে সম্রাট অশোকের রাজত্বকালের ব্রাহ্মী লিপি থেকে।
আবার কোনো কোনো গবেষকের মতে, মোন-ক্ষেমে লিপি থেকেও মারমা বর্ণমালার উৎপত্তি। এটি খ্রিষ্টপূর্ব ২৭৩ থেকে ৩২ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত প্রচলিত ছিল। তবে এর আকার কালক্রমে ছয়বার পরিবর্তিত হয়েছে।
তার মধ্যে সর্বপ্রথম ‘ব্রাহ্মী লিপি’ পাওয়া যায় প্রাচীন ভারতবর্ষে সম্রাট অশোকের রাজত্বকালের খ্রিষ্টপূর্ব ৩০০ অব্দে, দ্বিতীয় পরিবর্তিতরূপ পাথরের শিলালিপিতে ‘কুশানাহ’ পাওয়া যায় খ্রিষ্টীয় ষষ্ঠ শতাব্দীতে, তৃতীয় পরিবতির্তরূপ পিউ-মোন যুগে ম্রাজাদি পাথরে শিলালিপিতে ‘গুট্টাহ’ পাওয়া যায় ১১১২-১৩০০ শতকে, চতুর্থ পরিবর্তিত রূপ হাইসাউইদি যুগের শিলালিপিতে ‘পুগাইঙ’ পাওয়া যায় ১৫০০ শতকে, পঞ্চম পরিবতির্তরূপ পিতলের ঘণ্টী ও বুদ্ধশাস্ত্রীয় গ্রন্থে ‘আংওয়াহ’ পাওয়া যায় ১৬০০ শতকে এবং সর্বশেষ পরিবতির্তরূপ ম্রাইম্মা (মারমা) পাওয়া যায় ১৭০০ শতকে।
বর্তমানে ম্রাইম্মা (মারমা) রূপটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। মারমা ভাষার বর্ণমালায় হরফ আছে ৪৫টি। যার মধ্যে ৩৩টি ব্যঞ্জনবর্ণ ও ১২টি স্বরবর্ণ রয়েছে।
মারমা, রাখাইন ও বার্মিজ ভাষার বর্ণমালা একই রকম। ভৌগোলিকভাবে কেবল দেশ, অঞ্চল ও এলাকাভেদে সুর ও উচ্চারণের একটু পার্থক্য দেখা যায়।
তার মধ্যে মারমা ও রাখাইন উচ্চারণ প্রায় কাছাকাছি। তারা পরস্পরের সঙ্গে অনায়াসে ভাববিনিময় করতে পারেন। কিন্তু একই বর্ণমালা হলেও বর্মি ভাষার উচ্চারণ ও সুরে ভিন্নতা আছে।
আনুষ্ঠানিকভাবে আলাদা করে এখনও পর্যন্ত মারমা ভাষা শিক্ষা কার্যক্রম কোথাও চালু করা হয়নি। কোথাও বৌদ্ধ বিহারভিত্তিক, কোথাও পাড়াভিত্তিক কিছুটা ভাষা ও বর্ণমালা শিক্ষার কার্যক্রম রয়েছে। তবে সেগুলো একেবারেই সীমিত পরিসরে। তার মধ্যে ক্লাস, পরীক্ষা ও প্রাইভেট নানা ব্যস্ততার মধ্যে আলাদাভাবে ভাষা শিক্ষা শেখার সুযোগ হয় না তাদের।
কিন্তু গত এক দশক ধরে উচ্চশিক্ষায় আসা নতুন প্রজন্ম একাডেমিক পড়াশোনার বাইরে সময় বের করে নিজেদের উদ্যোগে মাতৃভাষা শিক্ষা চর্চা করে যাচ্ছে। সম্প্রতি বিভিন্ন উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা হয় বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের। নিজেদের উদ্যোগে ভাষা শিক্ষার কথা তুলে ধরেন তারা।
ভাষার জন্য শ্রমণ
বান্দরবানের রোয়াংছড়ি এলাকার বাসিন্দা নুথোয়াই মারমা দুই বছর আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা বিভাগ থেকে লেখাপড়া শেষ করেছেন। এখন লেখালেখির দিকে মনোযোগ দিয়েছেন।
তিনি ২০২২ সালে মারমাদের ইতিহাস নিয়ে মারমা ভাষায় ২৫৬ পৃষ্ঠার একটি বইও প্রকাশ করেছেন। নিজেদের হারানো ইতিহাস ও ঐতিহ্য মাতৃভাষায় তুলে ধরছেন তিনি। যদিও নিজের মাতৃভাষায় ভালোভাবে পড়তে পারে এমন মারমার সংখ্যা এখনও কম।
ছোটবেলা থেকে কীভাবে মাতৃভাষার চর্চা করেছেন তার বর্ণনা দিয়ে নুথোয়াই মারমা বলেন, “ক্লাস ফোরে থাকতে কোনো লম্বা ছুটি পেলে জুমঘরে দাদুর কাছে গিয়ে থাকতাম। সেখানে মারমা ভাষার প্রাথমিক পর্যায়ে অক্ষরগুলো শিখতাম। কিন্তু এই শেখা পর্যাপ্ত মনে হয়নি। এইভাবে শিখে নিজেও সন্তুষ্ট হতাম না। বাবাকে বলতাম, ভাষা শেখার সুবিধার জন্য শ্রমণ করে কোনো একটি বৌদ্ধ বিহারে রাখতে। মারমা ভাষা আরও ভালভাবে রপ্ত করতে চাই।
“বৌদ্ধ বিহারের ভান্তেরা মারমা ভাষায় খুবই পারদর্শী। তারা ধর্মীয় দেশনা ও বিভিন্ন ধরনের জাতক কাহিনী মারমা ভাষায় বলে থাকেন। তাদের কাছে শিখলে দ্রুত এবং ভালভাবে বোঝা যায়। পরবর্তীতে শ্রমণ হয়ে এক বছর বিহারেই ছিলাম। আমি যা শিখেছি ওই সময়ে ভালোভাবে শিখেছি। আরও চর্চা করার পর এখন নিজের মাতৃভাষায় ভালোভাবে লিখতে ও পড়তে পারি। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে মারমা ভাষায় একটি বইও লিখে ফেললাম।”
বঙ্গবন্ধুর ‘অসমাপ্ত জীবনী’ বইটি মারমা ভাষায় অনুবাদ করেছেন নুথোয়াই মারমা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বুধবার বইটির মোড়ক উন্মোচন করবেন।
মারমা ভাষায় ফেইসবুক পোস্ট
পুরোদমে নিজের আগ্রহে মারমা ভাষা শিক্ষা রপ্ত করে নিয়েছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের প্রাক্তন শিক্ষার্থী মংক্যথোয়াই মারমা।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এখন নিজের মাতৃভাষায় অনায়াসে যোগাযোগ করতে পারেন তিনি। ফেইসবুকেও বাংলার পাশাপাশি পোস্ট দেন মারমা ভাষায়। তার আশা, এসব দেখে অন্যদেরও এমন আাগ্রহ হবে, মাতৃভাষায় লেখালেখির অভ্যাস গড়ে উঠবে।
নিজে নিজে মাতৃভাষা শেখার পর মংক্যথোয়াই মারমাই প্রথম অন্য শিক্ষার্থীদের জন্য মারমা ভাষা শিক্ষার কোর্স চালু করেছিলেন বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে।
তিনি বলেন, “প্রথমে খাগড়াছড়ি মারমা ভাষা কমিটির উদ্যোগে নেওয়া একটি কোর্সে অংশ নিয়েছিলাম। প্রায় এক বছরের মত পড়েছি। পরে নিজে নিজে চর্চা শুরু করি। এরপর নিজের মাতৃভাষায় লিখতে, পড়তে আর কোনো সমস্যা হয়নি। পরে ভাবলাম, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে শিক্ষার্থীদের একটা ভাষা কোর্স চালু করি।”
২০১৭-১৮ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে সপ্তাহে একবার করে মারমা ভাষা শিক্ষার সেই কোর্স চালু করেন মংক্যথোয়াই মারমা। শুক্রবার বিকাল ৪টা থেকে ৬টা পর্যন্ত কখনও খোলা মাঠে, কখনও কোনো ফ্যাকাল্টি বিল্ডিংয়ে তারা বসতেন।
শুরুর দিকে প্রতিদিন ৩০-৪০ জনের মত আসতেন ক্লাসে। পরে পরীক্ষা, টিউশনিসহ নানা ব্যস্ততায় কমতে কমতে ১০ জনের মধ্যে নেমে আসে।
মংক্যথোয়াই মারমা বলেন, “এই ভাষা শিক্ষা কোর্সে যারা মনযোগ দিয়ে ঠিকমত চর্চা করতে পেরেছে তারা পরবর্তীতে অন্তত ভালভাবে লিখতে, পড়তে পারে। যে কোনো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তারাও নিজের মাতৃভাষায় ভালভাবে যোগাযোগ রক্ষা করতে পারে।”
বিশ্ববিদ্যালয়ভিত্তিক সেই মাতৃভাষা কোর্স এখনও চালু রয়েছে বলে জানান তিনি।
বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে মাতৃভাষা শিক্ষা কোর্সে অংশ নেওয়া চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী উকিওয়াং মারমা বলেন, “প্রথমে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাষা শিক্ষা কোর্সে অংশ নিই। সে সময় মোটামুটি সহজগুলো দেখে দেখে পড়তে পারতাম। এরপর কোভিডের সময় নিজের এলাকার একটা বৌদ্ধ বিহারে একটানা দুই মাস ছিলাম। সেখানে মাতৃভাষা শিক্ষা একদম পাকাপোক্ত হয়েছে আমার। কারণ এর আগে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে মাতৃভাষার প্রাথমিক পর্যায়ে অক্ষরগুলো ঠিকমত রপ্ত করে নিতে পেরেছি।
“আমাদের নিজের মাতৃভাষা শিক্ষা শুরুর সময়টায় একটা সিলেবাস ছিল। কোর্স নেওয়া শেষে একটা পরীক্ষা হত। এটার জন্য নিদিষ্ট নম্বরও দেওয়া হত। পরে কার কী রকম পারফরমেন্স বোঝা যেত। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের নানা ব্যস্ততার কারণে সবাই একটানা সময় দিতে পারে না। যারা ভালোভাবে সময় দিয়ে চর্চা করে তারা দ্রুত নিজের মাতৃভাষা রপ্ত করে ফেলতে পারে,” বলেন উকিওয়াং মারমা।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় চতুর্থ বর্ষের ছাত্র মংখিং মারমা বলেন, “আমি নিজেই ২০১২ সালের দিকে এলাকার একটি বৌদ্ধ বিহারে ভান্তের কাছে মাতৃভাষা শিখেছি। চর্চা করতে করতে এখন বেশ ভালো বুঝি। এ বছর জানুয়ারি মাস থেকে ঢাকাকেন্দ্রিক মারমা শিক্ষার্থীদের নিয়ে ভাষা শিক্ষা কোর্স চালু করা হয়েছে। আমি নিজেই পড়াই। নিয়মিত ২৫-৩০ জনের মত শিক্ষার্থী উপস্থিত থাকে। সপ্তাহে শুক্রবার অথবা শনিবার সকাল ১১টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলের প্রাঙ্গণে খোলা মাঠে বসে ক্লাস নিই।”
শিক্ষার্থীদের মধ্যে মাতৃভাষা শেখার ‘ব্যাপক আগ্রহ দেখার কথা জানিয়ে মংখিং মারমা বলেন, “বিশেষ করে কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীরা এখন নিজের মাতৃভাষা শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা বেশ গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছে। তারা আসলে খুব আগ্রহের সঙ্গে বুঝতে চায়। যত্ন করে শেখে। আমরা ভাষা শিক্ষা কার্যক্রমটা ধারবাহিকভাবে রাখতে পারলে শিক্ষার্থী আরও বাড়বে।”
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বুয়েট) ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক্স ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ থেকে সদ্য স্নাতক করা অংশৈসিং মারমা বলেন, মহামারীর লকডাউনের সময় বান্দরবানের রোয়াংছড়ি বৌদ্ধ বিহারে এক ভান্তের কাছে মারমা ভাষা শেখেন তিনি। এখন যে কোনো বইয়ের মারমা ভাষা দেখে দেখে পড়তে পারেন। কিন্তু লিখতে গেলে বানানের একটু সমস্যা হয়। মারমা ভাষা জানে এমন যে কারও সঙ্গে লিখিতভাবে ভালো তথ্য আদান-প্রদান করতে পারেন।
আমন্ত্রণপত্র-পোস্টারে মাতৃভাষা
বছরব্যাপী বিভিন্ন উৎসব ও পার্বণ উপলক্ষে মারমা ভাষায় আমন্ত্রণপত্র, বিয়ের কার্ড ও পোস্টার ছাপানো হয়। এমনকি বিভিন্ন এলাকায় পাড়ার নাম, বৌদ্ধ বিহারে নাম লেখা হয় মারমা ভাষায়। বিভিন্ন দোকাপাটের নামও সাইনবোর্ডে মারমা ভাষায় লিখতে দেখা যায়।
বিয়ের কার্ডে বাংলার পাশাপাশি আবশ্যিকভাবে মারমা ভাষা লেখেন বেশিরভাগ লোকজন। বান্দরবানের সাত উপজেলা থেকে বিভিন্ন সময় মারমা ভাষায় লেখানোর জন্য ছুটে আসেন শহরে উজানি পাড়ার ‘বনতুলি আর্ট’ এর দোকানে। বিশেষ করে শীত মৌসুমে বিভিন্ন এলাকায় নানারকম অনুষ্ঠান থাকায় এ সময়টাতে বেশি ভিড় দেখা যায় এই দোকানে।
‘বনতুলি আর্ট’ এর স্বত্ত্বাধিকারী মংহাইচিং মারমা বলেন, দোকানে বেশিরভাগ ছাপানো হয় মারমা ভাষায় বিয়ের কার্ডের আমন্ত্রণপত্র। এটা বছরব্যাপী চলে। মারমাদের পাড়ার বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠান ও প্রথাগত নিয়মে কারবারি-হেডম্যানদের কোনো খাজনা আদায় অনুষ্ঠানে নিজের মাতৃভাষায় আমন্ত্রণপত্র ছাপাতে আসে।
তার বাইরে বৌদ্ধ ভিক্ষুর অন্ত্যোষ্টিক্রিয়া ও ধর্মীয় অনুষ্ঠানে পুরোদমে নিজের মাতৃভাষায় পোস্টার ও আমন্ত্রপত্র কার্ড ছাপানো হয়। যে কোনো নির্বাচনি পোস্টারও নিজের মাতৃভাষাতে ছাপান তারা। কারণ অনেক পাড়ার বয়স্ক ব্যক্তিরা এখনও মারমা ভাষা ভালভাবে পড়তে পারেন।
পথিকৃৎ ‘মারমা শিল্পী গোষ্ঠী’
সরাসরি ভাষা শিক্ষার কোনো কার্যক্রম নেই এই সাংস্কৃতিক সংগঠনের। কিন্তু গান ও সাংস্কৃতিক চর্চার মাধ্যমে মাতৃভাষার বিকাশে একটি পথিকৃৎ সংগঠন হয়ে উঠেছে ‘মারমা শিল্পী গোষ্ঠী’।
দুই যুগের বেশি সময় ধরে নাচ-গানের মাধ্যমে তারা তুলে ধরছেন মারমা ভাষার শুদ্ধতম চর্চা। তাদের উপস্থাপনায় ভাষারীতি, শব্দচয়ন, পোশাক ও অনুষ্ঠান সাজানোতে প্রকাশ পায় মননশীলতার ছাপ।
এই শিল্পী গোষ্ঠীর উদ্যোগে এ পর্যন্ত অসংখ্য মারমা গান লেখা হয়েছে। তাদের লেখা এসব গানের কথা, ছন্দ ও সুরেও রয়েছে ভাষার সুশৃঙ্খল ধারা।
১৯৯৬ সালে প্রতিষ্ঠিত ‘মারমা শিল্পী গোষ্ঠী’র প্রতিষ্ঠাতা বান্দরবান ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী ইন্সটিউিটটের প্রাক্তন কালচালার অফিসার চুথইপ্রু মারমা। এই সাংস্কৃতিক সংগঠনের সভাপতি তিনি।
চথুইপ্রু মারমা বলেন, “গানের জন্য ভাষার শুদ্ধ উচ্চারণকে প্রাধান্য দিয়ে থাকি আমরা। এখানে যারা গানের চর্চা করেন, তারা সবাই মারমা ভাষা শুদ্ধরূপে উচ্চারণ করতে পারে। অনেকেই কথা বলার সময় শব্দের অভাবে মারমা কথার মধ্যে কিছু বাংলা শব্দ ঢুকিয়ে কথা বলে। এমন কিছু শব্দ আছে যা নতুন প্রজন্ম বলতে পারে না। সেসব শব্দকে ছন্দ মিলিয়ে গানের মধ্যে নিয়ে আসি। শিল্পীদের সেভাবে গানের চর্চা করার মাধ্যমে ভাষা শিক্ষার চর্চাও করাই।
“আগে আমাদের সব গানের কথা লেখা হত মারমা মাতৃভাষায়। এখন অনেকে পড়তে না জানার কারণে মারমা ভাষাকে বাংলা দিয়ে লিখি। তারপরও জ্যেষ্ঠ শিল্পীরা এখনও নিজের মাতৃভাষা লিখে গানের চর্চা করে থাকেন।”
কেএসআইয়ের উদ্যোগ
মাতৃভাষা চর্চা আরও কীভাবে বাড়ানো যায় এ বিষয়ে মারমা ভাষার লেখক ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক মহাব্যবস্থাপক মংক্যশোয়েনু নেভী বলেন, মারমাদের অনেকেই একসময় বৌদ্ধ বিহারে এবং পালি টোলে গিয়ে মাতৃভাষা পড়তেন। এখনও কেউ কেউ বৌদ্ধ বিহারে শেখেন। কিন্তু বেশিরভাগ মানুষ প্রাথমিক পর্যায়ে আয়ত্ব করে নিয়ে নিজে নিজে চর্চা করে থাকেন। বর্তমানে মারমা ভাষায় যারা পারদর্শী ও লেখালেখিতেও দক্ষ, তারা প্রত্যেকে নিজ উদ্যোগে চর্চা করা মানুষ। কেউ আনুষ্ঠানিকভাবে শিখে আসেননি।
“যেহেতু বিভিন্ন বাস্তবতার কারণে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে শেখার সুযোগ নেই। সে কারণে ব্যক্তি উদ্যোগে চর্চা করে যেতে হবে। বর্তমানে সরকারিভাবে প্রথম থেকে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত যে মারমা ভাষা শিক্ষার কারিকুলাম রয়েছে, সেখানেও অনেক ধরনের ঘাটতি আছে। শিশুরা কেবল কিছু নাম এবং অক্ষরের সঙ্গে পরিচিত হতে পারবে। কিন্তু ভাষা শিখতে পারবে না।”
তবে প্রাতিষ্ঠানিকভাবেও মারমাদের মাতৃভাষা শিক্ষা কার্যক্রম রয়েছে জানিয়ে বান্দরবান ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী ইন্সটিউিটের (কেএসআই) পরিচালক মংনুচিং মারমা বলেন, বছরব্যাপী বিভিন্ন এলাকায় মারমা মাতৃভাষা শিক্ষা ব্যবস্থা চালু রয়েছে। বিশেষ করে একটা নির্দিষ্ট বয়সসীমা পর্যন্ত শিশুরা ভাষা শিক্ষা কার্যক্রমে ভর্তি হতে পারে। এই কার্যক্রম থেকে অনেকেই উপকৃত হচ্ছে। ভাষাশিক্ষা কার্যক্রমের মাধ্যমে অন্তত নিজের মাতৃভাষায় লিখতে-পড়তে পারে তারা।