কয়েকজন জনপ্রতিনিধি কর্মস্থলে না এসে অজ্ঞাত স্থান থেকে বিকল্পভাবে কাজ চালিয়ে যাওয়ার কথা বলেছেন।
Published : 18 Aug 2024, 10:41 PM
ছাত্র-জনতার প্রবল আন্দোলনের মুখে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দেশত্যাগের পর দলীয় জনপ্রতিনিধিরা আত্মগোপনে চলে যাওয়ায় কুমিল্লার স্থানীয় সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সেবা স্থবির হয়ে পড়েছে। এতে ভোগান্তিতে পড়েছেন সেবাপ্রার্থীরা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কুমিল্লা সিটি করপোরেশন, একটি জেলা পরিষদ, ১৭টি উপজেলা পরিষদ, আটটি পৌরসভা ও ১৯৩টি ইউনিয়ন পরিষদের জনপ্রতিনিধিদের অধিকাংশই আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী ছিলেন।
এসব প্রতিষ্ঠানের প্রায় ৩০০ জনপ্রতিনিধি এখন আত্মগোপনে রয়েছেন। অধিকাংশের ব্যবহৃত মোবাইল নম্বও বন্ধ পাওয়া যাচ্ছে।
যার কারণে বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজ, ট্রেড লাইসেন্স, জন্মনিবন্ধন ও মৃত্যুসনদ কার্যক্রম অনেকটা বন্ধ রয়েছে। সেবা নিতে এসে ভোগান্তিতে পড়ছেন সাধারণ মানুষ।
তবে, কয়েকজন জনপ্রতিনিধি কর্মস্থলে না এসে অজ্ঞাত স্থান থেকে বিকল্পভাবে কাজ চালিয়ে যাওয়ার কথা বলেছেন। যদিও তারা কোথায় থাকছেন সেটি কাউকে বলছেন না।
এদিকে, জনগণের সেবা নিশ্চিত করা, স্থবিরতা নিরসনে স্থানীয় সরকার বিভাগ থেকে আত্মগোপনে থাকা জনপ্রতিনিধিদের তালিকা করা হচ্ছে বলে জানা গেছে।
স্থানীয় সরকার বিভাগের কুমিল্লার উপ-পরিচালক এস এম গোলাম কিবরিয়া বলেন, “নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের অনুপস্থিতিতে নাগরিক সেবা ও উন্নয়ন কাজ যেন ব্যাহত না হয় সেই বিষয়টিকে আমরা অগ্রাধিকার দিচ্ছি। এজন্য আমরা মাঠ পর্যায়ে তথ্য চেয়েছি।
“কেউ অনুপস্থিত থাকলে বিধি মোতাবেক প্যানেল মেয়র ও প্যানেল চেয়ারম্যানদের দায়িত্ব দিয়ে কাজ চালিয়ে যাব। আর কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের বিষয়টি স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় থেকে সিদ্ধান্ত নেবে।”
৫ অগাস্ট শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পরপরই জেলার অধিকাংশ স্থানে আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের জনপ্রতিনিধিদের কার্যালয় ও বাসাবাড়িতে হামলা, ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে। কোথাও কোথাও অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটের ঘটনাও ঘটেছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে নিজেদের ওপর হামলার আশঙ্কায় এলাকা ছাড়েন আওয়ামী লীগের সমর্থনে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা।
এসব প্রতিষ্ঠানে এখনো প্যানেল মেয়র কিংবা প্যানেল চেয়ারম্যানের হাতে দায়িত্ব দেওয়া হয়নি। কারণ বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই যারা প্যানেল মেয়র ও প্যানেল চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পেয়েছেন- তারাও আওয়ামী লীগের। এজন্য তারাও অনেকে এলাকা থেকে গাঢাকা দিয়েছেন।
সংশ্লিদের সঙ্গে কথা কথা বলে জানা গেছে, সরকার পতনের পর কুমিল্লা থেকে গাঢাকা দেন সিটি করপোরেশনের মেয়র তাহসীন বাহার সূচনা। তিনি কুমিল্লা সদর আসনের সাংসদ আ ক ম বাহাউদ্দীন বাহারের মেয়ে। তাদের বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করেছে বিক্ষুব্ধ জনতা। তিনি কোথায় আছেন তা নিয়ে কেউ মুখ খুলছেন না।
নগরীর ২৭টি ওয়ার্ডের মধ্যে অন্তত ২৩ কাউন্সিলরই আওয়ামী লীগপন্থি। তাদের দু-একজন ছাড়া সবাই গাঢাকা দিয়েছেন। বিএনপি-জামায়াতপন্থি কয়েকজন কাউন্সিলর মাঠে রয়েছেন।
এই অবস্থায় ৫ অগাস্টের পর থেকে কুমিল্লা সিটির কার্যক্রম অনেকটাই স্থবির হয়ে পড়েছে। জানা গেছে, শিগগিরই স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় থেকে কুমিল্লা সিটিতে প্যানেল মেয়র হিসেবে কাউকে দায়িত্ব দেওয়া হতে পারে।
এ বিষয়ে জানতে কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. ছামছুল আলমকে মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি।
কুমিল্লা জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান বীর মুক্তিযোদ্ধা মফিজুর রহমান বাবলুও সরকার পতনের পর থেকে কার্যালয়ে আসছেন না। তবে তিনি সাংবাদিকদের কাছে দাবি করেছেন, তিনি উধাও হননি। অসুস্থতার কারণে বাসায় বসে দাপ্তরিক কাজ করছেন।
এদিকে, জেলার আটটি পৌরসভার মধ্যে লাকসাম, নাঙ্গলকোট, চান্দিনা, চৌদ্দগ্রাম, বরুড়া, দেবিদ্বার, দাউদকান্দি ও হোমনা পৌরসভা মেয়রদের সবাই আওয়ামী লীগের। সরকার পতনের দেবিদ্বার ও হোমনা পৌরসভা ছাড়া বাকি মেয়ররা এখনো এলাকা ছাড়া।
দেবিদ্বারের মেয়র সাইফুল ইসলাম বলেন, “৫ অগাস্ট আমার বাসভবন ভাঙচুর করা হয়। চেষ্টা করা হয়েছিল আমাকে প্রাণনাশের। এখন পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ায় দপ্তরে এসে কাজ করছি।”
লাকসাম পৌরসভার মেয়র মো. আবুল খায়ের সাবেক স্থানীয় সরকার মন্ত্রী মো. তাজুল ইসলামের অনুসারী। সরকার পতনের পর তার কার্যালয়, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও বাসায় হামলা, ভাঙচুর ও লুটপাটের ঘটনা ঘটেছে। বর্তমানে তিনি কোথায় আছেন কেউ জানেন না। তার মোবাইল ফোনও বন্ধ আছে।
কুমিল্লা আদর্শ সদর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আমিনুল ইসলাম টুটুলের বাসাবাড়িতে হামলার ঘটনা ঘটে। তিনি এলাকায় নেই। অফিস করছেন না একই পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যানরাও।
একই চিত্র দেবিদ্বার উপজেলা পরিষদেও। চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যান কেউ অফিসে আসেন না। দেবিদ্বার উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান সদ্য সাবেক সংসদ সদস্য আবুল কালাম আজাদের ছোট ভাই মামুনুর রশিদ এখন আত্মগোপনে। আত্মগোপনে আছেন চৌদ্দগ্রাম উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান রহমত উল্লাহ বাবুলও। তিনি উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের পদে রয়েছেন।
রহমত উল্লাহ বাবুল বলেন, পরিস্থিতি আরও স্বাভাবিক হলে তিনি ও চৌদ্দগ্রামের পৌর মেয়র অফিসে যাবেন।
নাঙ্গলকোট পৌরসভার মেয়র আবদুল মালেক উপজেলা যুবলীগের আহ্বায়কের পদে রয়েছেন। ৫ অগাস্ট তার বাসভবন ও অফিসে হামলা হয়েছে। বর্তমানে তিনি কোথায় আছেন, কেউ জানে না। তার মোবাইলে ফোন বন্ধ রয়েছে।
বরুড়া পৌরসভার মেয়র বকতার হোসেনের ব্যক্তিগত কার্যালয় ও বাসায় ৫ অগাস্ট হামলা হয়েছে। শনিবার পর্যন্ত তিনিও অফিসে যাননি।
বকতার মোবাইল ফোনে বলেন, “বর্তমান পরিস্থিতির কারণে বিকল্পভাবে কাজ সচল রাখতে হয়েছে। শিগগিরই অফিসে ফিরবো।”
এদিকে, পৌর ভবনে হামলা ভাঙচুরের কারণে অফিসে আসছেন না দাউদকান্দি পৌরসভার মেয়র নাঈম ইউসুফ সেইন। বন্ধ আছে তার মোবাইল ফোন।
হামলা হয় দাউদকান্দি উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আলী সুমনের সরকারি বাসভবনে।
মোহাম্মদ আলী সুমন সাংবাদিকদের বলেন, “উপজেলা পরিষদে যাওয়ার পরিস্থিতি ইতিবাচক না। তাই গ্রামের বাড়ি থেকে বিকল্পভাবে কাজ চালিয়ে যাচ্ছি।”
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, জেলার ১৯৩টি ইউনিয়ন পরিষদের অধিকাংশ চেয়ারম্যানই বর্তমানে এলাকাছাড়া।