ফেনীর ফুলগাজী ও পরশুরামের অনেক জায়গা সড়ক যোগযোগ ভেঙে পড়েছে; পাশাপাশি ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে দেখা দিয়েছে খানাখন্দ।
Published : 01 Sep 2024, 11:55 PM
বন্যার পানি নেমে যাওয়ার পর ফেনী ও কুমিল্লায় ভেসে উঠেছে বেহাল সড়ক। এক-একটি ইউনিয়নের গ্রামীণ জনপদ ভেঙে ক্ষত-বিক্ষত হয়েছে। এতে যানচলাচল করতে না পারায় বিপাকে পড়েছেন গ্রামবাসী ও স্থানীয়রা।
স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যায় ফেনীর ছয় উপজেলার মধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ফুলগাজী ও পরশুরামের বিস্তীর্ণ জনপদ।
১০ দিনের বন্যার কারণে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম অংশের ৪৫ কিলোমিটারেও দেখা দিয়েছে স্থানে স্থানে খানা-খন্দ। এতে ভোগান্তিতে পড়ছেন পরিবহন চালক ও যাত্রীরা।
রোববার দিনভর ফেনীর ফুলগাজী ও পরশুরাম উপজেলার বিস্তীর্ণ জনপদ এবং চৌদ্দগ্রামের বিভিন্ন এলাকা পরিদর্শন করে এই চিত্র দেখা গেছে।
ফেনীর ফুলগাজী উপজেলার মুন্সিরহাট ইউনিয়নের নতুন মুন্সিরহাট থেকে জগতপুর হয়ে আমজাদহাট যাওয়ার এলজিইডির নির্মাণাধীন সড়কটির বিভিন্ন স্থানে ভেঙে যানচলাচল সম্পূর্ণ বন্ধ রয়েছে। ২১ অগাস্ট বন্যার পর ১৩ দিন ধরে এই সড়কে কোনো যানবাহন চলাচল করতে পারছে না।
জগতপুর গ্রামের সত্তরোর্ধ্ব আবুল হাশেম বলেন, ভয়ঙ্কর এই বন্যায় জানমালের ক্ষতির পাশাপাশি সড়ক বেহাল হয়েছে। ছোট-বড় কোনো ধরনের গাড়ি চলাচল করতে পারছে না। বৃদ্ধদের চলাচলে খুব কষ্ট হচ্ছে।
দক্ষিণ বড়াইয়া গ্রামের স্নাতক শ্রেণির শিক্ষার্থী আখতারুজ্জামান বিজয় বলেন, উজানের পানির তোড়ে মুহুরী নদীর বড়ইয়া ও জগতপুর গ্রামের বাঁধের বিভিন্ন স্থান ভেঙে সড়কের উপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হয়। সড়কের পাশে থাকা দোকানপাট ও বাড়িঘর ভেঙে যোগাযোগ পুরোপুরি ব্যাহত হয়েছে। যানচলাচল ব্যাহত হওয়ায় বেশি দুর্ভোগে পড়েছে শিশু, নারী ও বৃদ্ধরা।
আমজাদ হাটের বাসিন্দা সেলিনা আক্তার বলেন, “বন্যায় ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ঘরে কোনো পুরুষ লোক নেই। বাজার-সদাই করে ভাঙা রাস্তা দিয়ে হেঁটে চলাচল করতে হচ্ছে। দ্রুত রাস্তা সংস্কার করা প্রয়োজন।”
সড়ক সংস্কারে শিক্ষার্থীরা
ফুলগাজীর মতো একই চিত্র দেখা গেছে পরশুরাম উপজেলার বিস্তীর্ণ এলাকায়।
পরশুরাম বাজার থেকে মির্জানগর ইউনিয়নের উত্তর কাউকে গ্রামে যাওয়ার সড়কটি ভেঙে বেহাল হয়েছে। বন্যায় সড়কটির উপর দিয়ে প্রায় আট ফুটের অধিক পানি প্রবাহিত হয়েছিল বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা।
রোববার সকালে কোদাল দিয়ে সড়ক সংস্কারে বেশকিছু শিক্ষার্থীকে কাজ করতে দেখা যায়।
স্থানীয় আবুল খায়ের জানান, ২১ অগাস্ট বন্যা শুরু হলে এই সড়কটি ভেঙে একেবারে যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। কয়েকদিন আগে স্থানীয় শিক্ষার্থীরা স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে কিছু মাটি ও কংকর দিয়ে সড়কটিতে ছোট যানবাহন চলাচলের ব্যবস্থা করেছে।
স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে দ্রুত সড়কটি মেরামত করে গ্রামবাসীর চলাচলের ব্যবস্থা করা উচিত বলে মনে করেন আবুল খায়ের।
পরশুরাম উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আফরোজা হাবিব শাপলা বলেন, উপজেলায় ক্ষতিগ্রস্ত সড়কের জরিপ করা হয়েছে। বরাদ্দ সাপেক্ষে দ্রুত সড়কগুলো মেরামত করার জন্য সংশ্লিষ্ট দপ্তরকে জানানো হয়েছে।
বন্যায় জেলায় এলজিইডি ও সড়ক বিভাগের আওতাধীন সড়কের আনুমানিক ১৪০ কোটি ৪৮ লাখ ৪৭ হাজার টাকা ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে বলে জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে।
এদিকে ফেনীতে বন্যায় এ পর্যন্ত ২৬ জনের মৃত্যু হয়েছে বলে জানিয়েছেন জেলা প্রশাসক মোসাম্মৎ শাহীনা আক্তার।
তিনি বলেন, রোববার রাত পর্যন্ত বন্যায় ফুলগাজীতে সাতজন, সোনাগাজীতে ছয়জন, সদরে পাঁচজন, ছাগলনাইয়ায় তিনজন, দাগনভূঞাতে তিনজন এবং পরশুরামে দুইজনের মৃত্যু হয়েছে।
ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে ভোগান্তি
বন্যার শুরুতে প্লাবিত হয়েছিল ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক। মহাসড়কের কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম অংশেও পানি ওঠে। মহাসড়ক থেকে নেমে গেছে বন্যার পানি, তবে রয়ে গেছে ক্ষতচিহ্ন।
মহাসড়কে খানাখন্দের সৃষ্টি হওয়ায় যান চলাচলে দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন চালকরা। পাশাপাশি চলাচলের কষ্ট হচ্ছে যাত্রীদেরও। নষ্ট হচ্ছে মালামাল।
বন্যায় ২২ অগাস্ট দেশের অর্থনীতির ‘লাইফলাইন’ খ্যাত ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের চৌদ্দগ্রামের বিভিন্ন এলাকা প্লাবিত হয়। কোথাও কোথাও হাঁটুসমান পানি হয়।
টানা দুইদিন মহাসড়কে পানি থাকার কারণে বিভিন্ন স্থানে কার্পেটিং উঠে গিয়ে অসংখ্য ছোট-বড় গর্তের সৃষ্টি হয়েছে। এখন একটু বৃষ্টি হলেই সেগুলো ভরে যায় পানিতে।
মহাসড়ক দিয়ে চলাচলকারী কয়েকজন বাসচালক ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, সড়কে প্রচুর খানাখন্দ। যাত্রীবাহী বাসসহ সব ধরনের যানবাহন চলাচলে মারাত্মক ব্যাঘাত ঘটছে।
মহাসড়কের কালিবাজার এলাকা হাঁটু পানিতে প্লাবিত হয়েছিল। চৌদ্দগ্রাম উপজেলার লালবাগ থেকে পদুয়া পর্যন্ত পুরো সড়কজুড়ে ছোট-বড় অনেক গর্ত হয়েছে। গর্ত থাকায় ট্রাক, লরি, কাভার্ড ভ্যান, প্রাইভেট কার বেশ ঝুঁকি নিয়েই চলাচল করছে। পুরো গতিতে গাড়ি যেতে পারছে না।
কুমিল্লা শহরের বাসিন্দা ও বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী রনি ও সোলেইমানকে প্রতিদিন এই সড়ক ধরে যাতায়াত করতে হয়। তারা বলছিলেন, গত সপ্তাহে একদিন সন্ধ্যার পর তারা চৌদ্দগ্রাম থেকে কুমিল্লা ফিরছিলেন। মহাসড়কের মিরশ্বানী এলাকায় একটি বড় গর্তে বাইক নিয়ে পড়ে গুরুতর আহত হন তারা। পরে তাদের হাসপাতালে গিয়ে চিকিৎসা নিতে হয়েছিল। মহাসড়কে বৃষ্টির পানি জমে থাকায় গর্ত বুঝতে পারেননি তারা।
ট্রাকচালক মো. কামাল হোসেন বলেন, “আমি ঢাকা থেকে মালপত্র নিয়ে চট্টগ্রাম যাই। কিন্তু গত কয়েকদিন গর্তের কারণে রাতের বেলায় গাড়ি চালাতে অনেক কষ্ট হচ্ছে। তার মধ্যে সামান্য বৃষ্টিতে গর্তগুলো বড় হওয়ায় এবং পিচ উঠে যাওয়ায় পানি আটকে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়।”
কুমিল্লা-চট্টগ্রাম রুটে চলাচলকারী তিশা পরিবহনের বাসচালক রুস্তম আলী বলেন, “ভাঙা রাস্তার কারণেই এই মহাসড়কে প্রতিদিন কোথাও না কোথাও দুর্ঘটনা ঘটছে। বড় বড় গর্তগুলোতে আটকে পড়ার কারণে অনেক সময় গাড়ি বিকল হয়ে যায়। একই কারণে গাড়ির গতি অনেক ধীর হওয়ায় সময় অপচয় হয়, তৈরি হয় যানজট।”
তিনি বলছিলেন, “চৌদ্দগ্রামের চেয়ে ফেনীর পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ। দ্রুত মহাসড়ক পুরোপুরি সংস্কার করা দরকার। না হলে মহাসড়কের অবস্থা আরো নাজুক হয়ে পড়বে।”
চৌদ্দগ্রামের মিয়াবাজার হাইওয়ে থানার এসআই সুজন বলেন, “সড়কে গর্ত থাকায় চালকদেরকে সতর্কভাবে গাড়ি চালাতে বলা হয়েছে। এ ছাড়া হাইওয়ে পুলিশ সদস্যরাও মহাসড়কের দায়িত্ব পালন করছেন দুর্ঘটনার রোধে।”
এ বিষয়ে সড়ক ও জনপথ (সওজ) বিভাগের কুমিল্লার নির্বাহী প্রকৌশলী সুনীতি চাকমা বলেন, “টানা বৃষ্টি ও বন্যার কারণে মহাসড়কের কিছু কিছু অংশে খানাখন্দের সৃষ্টি হয়েছে। সংস্কার করা হচ্ছে। দু-এক দিনেই সমস্যা সমাধান হয়ে যাবে বলে আশা করছি।”