এবারের আখ মৌসুম শুরুর আগে অন্তর্বর্তী সরকার দেশের ১৫টি চিনিকলের মধ্যে নয়টি চালুর ঘোষণা দিয়েছে।
Published : 07 Dec 2024, 01:23 AM
লোকসানের কথা বলে চার বছর ধরে বন্ধ রংপুরের শ্যামপুর চিনিকলটি জঙ্গলাকীর্ণ হয়ে যন্ত্রপাতি ও মালামাল প্রতিনিয়ত নষ্ট ও চুরি হচ্ছে; এরমধ্যেই নতুন সরকার আসার পর ক্ষতিগ্রস্ত-ভুক্তভোগী চাষিরা মিলটি চালু হবে এমন আশ্বাসে মাঠে নেমেছেন, ‘স্বপ্নের মতই’ বপন করছেন আখের নতুন চারা।
এবারের আখ মৌসুম শুরুর আগে অন্তর্বর্তী সরকার দেশের ১৫টি চিনিকলের মধ্যে নয়টি চালুর ঘোষণা দিয়েছে। বাকি যে ছয়টি করখানা চালুর জন্য ১১ সদস্যের টাস্কফোর্স গঠন করে যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে সেটির মধ্যে শ্যামপুর চিনিকলও রয়েছে।
কাছাকাছি থাকা দিনাজপুরের সেতাবগঞ্জ সুগার মিল, গাইবান্ধার রংপুর সুগার মিল ও পঞ্চগড় সুগার মিল বন্ধ থাকায় সেখানকার চাষিদেরও অবস্থাও শ্যামপুরের আশপাশের আখ চাষিদের মত।
চিনিকল বন্ধ থাকায় এক সময়ের কোলাহলমুখর জনপদে এখন সুনসান নিরবতা। তবে আবার মিল চালুর খবরে আশায় শ্যামপুরের ক্ষতিগ্রস্ত-ভুক্তভোগী প্রায় ১০ হাজার চাষি।
বছরের পর বছর লোকসানে থাকা এসব চিনিকলকে আগের সরকার চালু করতে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগের চেষ্টা করেছিল। তখন জাপান, থাইল্যান্ড, সংযুক্ত আরব আমিরাত আগ্রহ দেখালেও সেগুলো আর আলোর মুখ দেখিনি। চট্টগ্রামভিত্তিক শিল্পগোষ্ঠী এস আলম গ্রুপের বিনিয়োগের বিষয়ে সম্ভাবতা যাচাইয়ের একটি সমঝোতা স্মারক সই হলেও পরে অনিয়মের কারণে সেটি বাতিল করে দেওয়া হয়।
রংপুরের শ্যামপুর চিনিকলের নিবন্ধিত চাষি মোহাম্মদ আব্দুল জলিল মিল বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর তিন বছর কোনো ক্ষেতে আখ চাষ করেননি। তবে এ বছর ‘আশ্বাসের’ পর চাষে নেমেছেন।
আব্দুল জলিল বলেন, “আমি এবার ১১ একর ৭৪ শতক জমিতে আখ চাষ করছি। আমার আখ তো ভাল হইছে। আমাদের এখানে শ্যামপুরের সবাই আখ লাগাইতে চায়। অনেকে লাগাচ্ছেও। এখন দামটা একটু বাড়িয়ে, এই মিলটা চালু করা হোক- এটাই হামরার দাবি।”
যদিও এখনো এ বিষয়ে কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত আসেনি জানিয়ে টাস্কফোর্সের সদস্য ও শ্যামপুর সুগার মিল আখ চাষি কল্যাণ সমিতির সাবেক সভাপতি আলতাফ হোসেন বলেন, “জাতীয় শ্রমিক-কর্মচারী সংগ্রাম পরিষদের স্মারকলিপির পরিপ্রেক্ষিতে মাড়াই স্থগিত হওয়া ছয়টি চিনিকল পর্যায়ক্রমে চালু করার জন্য টাস্কফোর্স সরকারকে সুপারিশ করেছে।
“২০২৪-২৫ রোপণ-বর্ষ অর্থাৎ সবকিছু ঠিক থাকলে এবং প্রধান উপদেষ্টার অনুমোদন পেলে ডিসেম্বর থেকে উৎপাদন শুরু হতে পারে। আমরা সেরকম আশাই করছি।”
বন্ধ চিনিকলগুলো সচল করতে টাস্কফোর্স গঠনের তথ্য দিয়ে বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশনের সচিব আনোয়ার কবীর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, কমিটি এরই মধ্যে বেশ কয়েকটি বৈঠক করেছে।
“সেতাবগঞ্জ, শ্যামপুরসহ আরো কয়েকটি বন্ধ চিনিকল চালু করতে একটি প্রস্তাব প্রধান উপদেষ্টার দপ্তরে পাঠানো হয়েছে। সেখানে পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর যে সিদ্ধান্ত আসবে সেই আলোকে করপোরেশন পদক্ষেপ গ্রহণ করবে।”
রংপুরের শ্যামপুর চিনিকল প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “সেখানে অন্য চিনিকলের জন্য সীমিত পরিসরে আখ চাষ হচ্ছে। কারখানা চালুর সিদ্ধান্ত হলে তখন চাষাবাদের পরিমাণ বাড়াতে উদ্যোগ নেওয়া হবে।”
শ্যামপুর চিনিকলের আওতায় থাকা প্রায় অর্ধেক কৃষক তাদের জমিতে এবার আখ রোপণ করেছেন, এটাকে আশার দিক হিসেবে দেখছেন গোপালপুর ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান আলতাফ হোসেন।
শ্যামপুর চিনিকলের সহকারী ব্যবস্থাপক জাহেদুল ইসলাম বলেন, “২০২০ সালের ২ ডিসেম্বর সরকারি প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে শ্যামপুর চিনিকল বন্ধ হয়ে যায়। পরবর্তীতে ২০২৩ সালে এ মিলের সম্ভাবতা যাচাইয়ের লক্ষ্যে একটি কমিটি গঠন করা হয়। সেই কমিটির কার্যক্রম চলমান আছে।”
“অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসার পর জাতীয় টাস্কফোর্স ১১ সদস্যবিশিষ্ট কমিটি গঠন করে বন্ধ মিল চালুর বিষয়ে। সেই কমিটির কার্যক্রম চালু আছে, এখনো কোনো সিদ্ধান্ত আসেনি।”
মিল বন্ধে দিশেহারা চাষি
১৯৬৪ সালে বদরগঞ্জের শ্যামপুরে রংপুরের একমাত্র ভারী শিল্প হিসেবে প্রায় ১১২ একর জমিতে চিনিকলটি স্থাপিত হয়। তিন বছর পর আখ মাড়াই শুরু হয়। শুরুতে সক্ষমতা ছিল দৈনিক এক হাজার ১৬ টন আখ মাড়াইয়ের। বার্ষিক উৎপাদনের ক্ষমতা ছিল ১০ হাজার ১৬১ টন।
মিল কর্তৃপক্ষের হিসাব অনুযায়ী, এলাকায় চার হাজার ৬০০ একর জমিতে আখ চাষ হত। এর সঙ্গে জড়িয়ে ছিল মিলের নিবন্ধিত পাঁচ হাজার ২১০ জন চাষি।
স্থানীয়রা বলেছেন, এর বাইরেও অনেক আখ চাষি আছেন। সব মিলিয়ে ১০ হাজারের কাছাকাছি। তাদের পরিবারের লোকজন, আখ চাষের মৌসুমি শ্রমিক, এলাকার মানুষজনের ব্যবসা-বাণিজ্য, পরিবহন ব্যবসা সবকিছু মিলিয়ে অর্ধ লক্ষাধিক মানুষ এই চিনিকলকে কেন্দ্র করে জীবিকা ধারণ করতেন।
মিল কর্তৃপক্ষের ভাষ্য, শ্যামপুর চিনিকলটি অবস্থানের দিক থেকে দ্বিতীয় ছিল। এর যন্ত্রপাতি উন্নতমানের, উৎপাদনও ভালো ছিল। ২০২০ সাল পর্যন্ত চিনিকলে স্থায়ী-অস্থায়ী কর্মকর্তা-কর্মচারী ছিলেন ৭৪৪ জন। এখন শুধু দাপ্তরিক কাজ করার জন্য ৬১ জন রয়েছেন।
প্রায় আড়াইশ কোটি টাকা লোকসানের মুখে ২০২০-২১ অর্থবছরে এ চিনিকলে আখমাড়াই কার্যক্রম বন্ধ করে দেওয়া হয়। তখন চিনিকলের অধিকাংশ শ্রমিক-কর্মচারী ও কর্মকর্তাকে অন্যান্য কারখানায় বদলি করে চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশন। অধিকাংশ গাড়ি অন্যত্র সরিয়ে নেওয়া হয়।
তবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতির শিকার হয়েছেন সেখানকার চাষিরা। কারণ, তারা তাদের ক্ষেতে অন্য ফসল ফলিয়ে লাভের মুখ দেখতে পাচ্ছেন না। আখ বছরব্যাপী ফসল হলেও তারা সেখান থেকে একসঙ্গে টাকা পেতেন। সেই টাকায় তাদের পরিবারের যাবতীয় কাজকর্ম চলত। ফলে মিল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় তারা অনেকে বেকার হয়ে পড়েছেন।
এরপর মিল চালুর দাবিতে শ্যামপুর সুগার মিল শ্রমিক-কর্মচারী এমপ্লয়িজ ইউনিয়ন এবং আখচাষি কল্যাণ সমিতি আন্দোলনে নামে। তাদের পক্ষ থেকে বার বার দাবি জানানো হলেও আওয়ামী লীগ সরকার আর চিনিকলটি চালু করেনি।
শ্যামপুর গ্রামের আখচাষি স্বপন মিয়া বলছিলেন, তিনি আগে দুই একর জমিতে আখ চাষ করতেন। এখন করেন না। কিন্তু আখ এলাকার প্রধান অর্থকরী ফসল ছিল। এখন আর সেটি নেই।
“আগে আখ চাষ করে বছরে যে পরিমাণ লাভ হত, এখন একই পরিমাণ জমিতে অন্য ফসল চাষে তিন ভাগের এক ভাগও লাভ হচ্ছে না। এতে অনেক ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পড়েছি। মিলটি দ্রুত চালু হওয়া দরকার।”
শ্যামপুর আখচাষি কল্যাণ কমিটির সভাপতি ইমদাদুল হক বলেন, “চিনিকলটি বন্ধ থাকায় এলাকার অর্থনীতি মুখ থুবড়ে পড়েছে। আমাদের এই অঞ্চল থেকে কোটি কোটি টাকা সার্কুলেট হত। গ্রামে থেকেও আমরা শহুরে জীবনযাপন করতাম। কিন্তু এখন দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করছি।
“অন্য ফসল চাষ করে আখচাষিরা সংসারের খরচ চালাতে পারছেন না। আমাদের একমাত্র প্রাণের দাবি, শ্যামপুর চিনকল পুনরায় চালু করা হোক। তাহলে এই অঞ্চলের কৃষক, ব্যবসায়ী ও সাধারণ মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তি ঘটবে। এতে করে ব্যবসা-বাণিজ্যেরও প্রসার হবে।”
জঙ্গলাকীর্ণ মিল, নষ্ট হচ্ছে যন্ত্রপাতি
মিলটি যখন চালু ছিল তখন শ্যামপুরসহ আশপাশের কয়েকটি গ্রাম কোলাহলমুখর ছিল। চার বছরের ব্যবধানে সেই এলাকা এখন অনেকটাই অর্থনৈতিকভাবে ভেঙে পড়েছে।
গত সপ্তাহে কারখানা এলাকায় গিয়ে দেখা গেছে, পুরো এলাকায় ভুতুড়ে পরিবেশ। চারদিক খাঁ খাঁ করছে, সুনসান নিরবতা। কারখানার টিনের চালে অসংখ্য ছিদ্র। কোথাও কোথাও আবার পুরোপুরি নষ্ট হয়ে গেছে। মরিচা পড়েছে অধিকাংশ মূল্যবান যন্ত্রপাতিতে। কোনোটি বৃষ্টির পানি থেকে রক্ষায় ঢেকে রাখা হয়েছে পলিথিন দিয়ে।
কারখানার বাইরের চিত্র আরও ভয়াবহ। পুরো কারখানা ঢেকে গেছে ঝোপঝাড়-জঙ্গলে। দেখলে মনে হবে, পরিত্যক্ত কোনো জনপদ। চিনিকল চত্বরটিও গাছগাছালিতে ভরা। শ্রমিকদের নামাজের জন্য মিলের ভেতরে একটি ঘর ছিল। সেটিও এখন জরাজীর্ণ।
চিনিকলের ফটকে বসে ছিলেন তিনজন নিরাপত্তাকর্মী। তাদের সঙ্গে নিয়ে কারখানার ভেতরে প্রবেশ করে দেখা যায়, আখ পরিবহনের কাজে ব্যবহৃত ট্রাক্টর, ট্রলিগুলো অযত্ন–অবহেলায় পড়ে রয়েছে। ঝোপঝাড় ও লতাপাতায় সেগুলো ঢেকে গেছে। রোদ-বৃষ্টিতে মরিচা পড়ে তা নষ্ট হওয়ার উপক্রম।
নিরাপত্তাকর্মী মাহমুদ হোসেন বলেন, “আখ পরিবহন কাজে ব্যবহৃত গাড়ি এবং চিনিকলের অনেক যন্ত্রাংশ রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। দেখার কেউ নেই। চিনিকল বন্ধ থাকায় অনেকে নিয়মিত বেতন-ভাতাও পাচ্ছেন না।”
আরেক নিরাপত্তাকর্মী শহিদুল আলম সেখানে চুক্তিভিক্তিক কাজ করেন। তিনি মিলটি আবার চালু করার জন্য অন্তর্বতী সরকারের কাছে আহ্বান জানিয়ে বলেন, “মিলটি আবার চালু করার একটা প্রসেস চলছে বলে শুনছি। আমাদের এই মিলটির যন্ত্রপাতি জাপানি মিৎসুবেশির। কোনো ব্রেকডাউন ছিল না। এখানকার আখচাষিরাও ফসল করতে আগ্রহী।”
নিরাপত্তা হাবিলদার শমসের আলী ১৯৮১ সাল থেকে এই মিলে চাকরি করেছেন। ২০১৭ সালে তিনি অবসরে যান। এখন চুক্তিভিক্তিক কাজ করছেন। দুই-এক মাস পর পর হলেও তিনি বেতন পাচ্ছেন।
তিনি বলেন, “শুনতেছি দিনাজপুরের সেতাবগঞ্জ ও শ্যামপুর মিল চালু হবে। এমডি স্যারও আখ লাগানোর জন্য বলছেন। চাষিরা তাতে ইচ্ছুক।”
এলাকার কয়েকজন চাষি ও বাসিন্দাদের অভিযোগ, দীর্ঘদিন ধরে কারখানাটি বন্ধ থাকায় চিনিকলের অনেক যন্ত্রাংশ চুরি হয়ে যাচ্ছে। আখ পরিবহনে এবং কর্মকর্তাদের কাজে ব্যবহৃত গাড়ির চাকাসহ অন্য যন্ত্রাংশ খুলে বিক্রি করা হচ্ছে। কারখানার আসবাবপত্র অনেকে ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহার করছেন।
‘আশ্বাসে’ আখ রোপণ
আখ চাষিরা বলেন, আখ বছরব্যাপী ফসল। তবে এতে অন্য ফসলের তুলনায় লাভ বেশি। এর বাইরে কারখানা কর্তৃপক্ষ কিছু প্রণোদনা ছাড়াও সার ও বীজের জন্য ঋণ দিয়ে থাকে।
২০২০ সালে চিনিকল বন্ধের পর চাষিরা বিপাকে পড়ে যান। তারা বুঝতে পারছিলেন না, এই জমিতে তারা কী করবেন? ফলে প্রথম বছর অনেক জমি অনাবাদী ছিল। দ্বিতীয় বছর থেকে কেউ কেউ জমিতে অন্য ফসল লাগাতে শুরু করেন। কেউ কেউ এক জমিতে তিনটি ফসলও করেছেন। কিন্তু তিন ফসল মিলেও তারা আখের মত লাভ পাননি।
শ্যামপুর সুগার মিল আখ চাষি কল্যাণ সমিতির সাবেক সভাপতি আলতাফ হোসেন বলেন, মিলটি চালুর ব্যাপারে একটি সম্ভাবতা যাচাই করা হচ্ছে। এর মধ্যে একটি হচ্ছে, মিল এলাকায় আখের চাষ পর্যাপ্ত হচ্ছে কি না। এখানে যদি পর্যাপ্ত আখ চাষ হয় তাহলে মিলটি আলোর মুখ দেখতে পারে। সেই কারণেই মানুষ আগ্রহী হয়ে এখন আখ চাষ করছে।
সাধারণত অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত আখ চাষ করা হয়। নভেম্বরের মধ্যেই অধিকাংশ আখ রোপণ হয়ে যায়। এবার এখানকার অর্ধেকের বেশি চাষি আখ চাষ করেছেন। আর এখন আখের দামও বেশ ভাল।
চাষিদের প্রণোদনার বিষয়ে আলতাফ বলেন, যারা সঠিক সময়ে আখ রোপণ করতে পারেন তারা একর প্রতি তিন হাজার টাকা প্রণোদনা পান। এছাড়া আখের সঙ্গে যদি অন্যান্য ‘সাথি’ ফসল যেমন- আলু, পেঁয়াজ, পেঁপে এসব চাষ করে তাহলে প্রতি একরে পাঁচ হাজার টাকা প্রণোদণা দেয় কারখানা কর্তৃপক্ষ। (আখ চাষের ‘লাইন টু লাইন’ যে ফাঁক থাকে সেখানে সাথি ফসল চাষ হয়।)
অপরদিকে যারা আখের চারা তৈরি করেন তারা প্রতি একরে সাড়ে চার হাজার টাকা করে পান।
আখ চাষিরা বলেন, মিল বন্ধ হওয়ার পর দুই বছর তাদের একেবারেই বাজে গেছে। ২০২২ সাল থেকে জয়পুরহাট চিনিকল কর্তৃপক্ষ চাষিদের আখ চাষে উদ্বুদ্ধ করতে এগিয়ে আসে। ফলে কিছু কিছু চাষ শুরু হয়। কারণ মিল আখ না কিনলে সেই ফসল ক্ষেতেই নষ্ট হবে।
চার বছর আগে মিলটি যখন বন্ধ হয় তখন আখের কেজি ছিল সাড়ে তিন টাকা। কিন্তু এখন সরকার প্রতি কেজি আখের মূল্য দিচ্ছে ছয় টাকা। ফলে চাষিদের লাভের অঙ্কটা বেড়েছে। আগে যেখানে প্রতি কুইন্টাল (১০০ কেজি) সাড়ে ৩০০ টাকায় বিক্রি করতেন; এখন তার দামে পাচ্ছেন ৬০০ টাকা।
প্রতি একরে একজন চাষি ৪০০ কুইন্টাল পর্যন্ত আখ চাষ করতে পারেন। ক্ষেত্রে প্রতি একরে দাম পান দুই লাখ ৪০ হাজার টাকা থেকে আড়াই লাখ টাকা। এর সঙ্গে প্রণোদনার অর্থ যোগ হয়।
এছাড়া সার ও বীজের জন্য চাষিকে কোনো বিনিয়োগ করতে হয় না। এই টাকা কারখানাগুলো চাষিদের ঋণ হিসেবে দেয়। যখন আখের টাকা পরিশোধ করে তখন কর্তৃপক্ষ সেই টাকা কেটে রেখে দেয়।
শ্যামপুরের চাষিরা যে আখ চাষ করছেন, মিল যদি চালু না হয় তাহলে তাদের প্রণোদনা বা অর্থের কী হবে- জানতে চাইলে আলতাফ হোসেন বলেন, “সেটি অন্যান্য মিল কিনে নেবে।”
শিল্প মন্ত্রণালয়ের তথ্য তুলে ধরে তিনি বলেন, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে আড়াই হাজার একর জমিতে আখ চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। পরের বছরের লক্ষ্য চার হাজার একর।
তার মতে, চিনিকলটি চালু রাখতে কমপক্ষে চার হাজার একর জমিতে আখ চাষ করা দরকার।
‘৪২ টাকায় চিনি বিক্রি, সেটা কোন পলিসি?’
শ্যামপুর কলেজ পাড়ার বাসিন্দা মফিজুল ইসলাম ক্ষোভ প্রকাশ করে বলছিলেন, “আগে কুশেল চাষ করে যে টাকা পেতাম তা দিয়ে ছেলেমেয়ের লেখাপড়া, মেয়ের বিয়েসাদি, সংসার চালানো সবকিছু হত। মিল বন্ধ করে সরকার সব ধ্বংস করে দিল। অন্তত কিছু দিনের জন্য কঠিন ক্ষতি করে ফেলেছে সরকার।
“এমনটা কী লস হইছে, সেই লসের কারণে মিল বন্ধ করে দিল। এখন যে চিনি দেড়শ টাকা, ১৭০ টাকা। ৪২ টাকা কেজিতে চিনি বিক্রি করলে লাভ হবে, না লস হবে? এই তো হইল সরকারের পলিসি। এখন ইন্ডিয়ান চিনি খাচ্ছি ১৬০ টাকা করে। এটা কোন পলিসি?”
চিনিকলের অফিস সহকারী (প্রশাসন) মোশাররফ হোসেন বলছিলেন, এখানে যে ২৫ থেকে ৩০ হাজার টন আখ কারখানায় আসে সেটা চাষি নিয়ে এসে দেয়। কারখানার কোনো খরচ হয় না। এটা বাংলাদেশে সবচেয়ে কম খরচে চলে। তারপরও এটা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এখানকার চাষিরা অর্থকরী ফসল বলতে আখকেই বুঝে। কারণ আলুর দাম আজকে আছে কালকে নাই।
“মিলটা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় চাষিরা মেয়ের বিয়ে থেকে শুরু করে ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া- সবকিছু মিলিয়ে খুব সমস্যার মধ্যে আছে। একজন প্রান্তিক চাষির সঙ্গে কথা বলছিলাম, সে বলল, আমার মেয়ের বিয়ের টাকা জোগাড় করতে পারছি না। আমি জিজ্ঞাসা করলাম কেন? সে বলল, মিল বন্ধ। কারণ, অন্য ফসল থেকে তো এত টাকা আসে না।”
শ্রমিক নেতা এমদাদুল হক বলেন, “মিল চালু না হলে এই এলাকা আর ঘুরে দাঁড়াবে না। আবার মিল চালু হলে এখানে আখ ছাড়া আর কিছু থাকবে না। আমরা তো সব কাগজপত্র জমা দিছি, আশা করছি, সরকার খুব দ্রুতই মিলটা চালু করবে।”
‘বাই- প্রোডাক্ট ছাড়া লাভ করা কঠিন’
মিল বন্ধের পর এখানকার অধিকাংশ গাড়ি ও শ্রমিক সরকারের নির্দেশে আশপাশের অন্যান্য কারখানায় পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে বলে জানান শ্যামপুর চিনিকলের সহকারী ব্যবস্থাপক (সম্প্রসারণ) জাহেদুল ইসলাম।
আখ পরিবহনের গাড়িগুলো এখানে আছে। কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ব্যবহারের ৪০টা গাড়ির মধ্যে ৩৫টি অন্যান্য জায়গায় সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। কিছু পুরনো গাড়ি এখানে আছে। সেগুলো ব্যবহারের অভাবে নষ্ট হচ্ছে। তবে মিল যখন বন্ধ হয় তখন চাষিদের সব পাওনা বুঝিয়ে দেওয়া হয়।
এখন যদি মিল চালুও হয় তাহলে বিদ্যমান যন্ত্রপাতি দিয়ে সেটা হবে না; আরও কিছু সংগ্রহের প্রয়োজনীয়তার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, “শুধু চিনি উৎপাদন করে এরকম একটি কারখানা লাভজনক করা খুব কঠিন। বাই-প্রোডাক্ট থাকতে হবে। কেরু কোম্পানি সেটা করেই লাভজনক হয়েছে। ডিস্টিলারি, জৈব সার করে বছরে তারা ৩০০ থেকে ৪০০ কোটি টাকা লাভ করে। নর্থ বেঙ্গল সুপার মিল পর্যাপ্ত উৎপাদন করে গত বছর ৩০ কোটি টাকা লাখ করেছে।”
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “যন্ত্রাংশ পড়ে থাকলে নষ্ট হওয়াটা অস্বাভাবিক নয়। চিনিকল চত্বরে চুরি ও গাছপালা লুট যেন না হয়, সে ব্যাপারে আমরা সজাগ রয়েছি।”