“মুড়ি-চিড়া, শুকনো বিস্কুটসহ বড়দের খাবার একেবারেই মুখে নিতে চায় না বাচ্চারা।”
Published : 27 Aug 2024, 01:14 PM
স্মরণকালের ভয়াবহ আকস্মিক বন্যায় ভাসছে কুমিল্লা। বানভাসিদের সহায়তায় এগিয়ে এসেছে সারাদেশের মানুষ। তবে বন্যাদুর্গতদের জন্য বিভিন্ন ধরনের খাদ্য সহায়তা মিললেও তীব্র খাদ্য সংকটে রয়েছে আশ্রয়কেন্দ্র ও পানিবন্দি এলাকায় থাকা শিশুরা।
ভারতের উজান থেকে নেমে আসা ঢল ও বেশ কয়েকদিনের টানা ভারীবর্ষণে জেলার ১৭টি উপজেলার মধ্যে ১৪টিতেই বন্যা পরিস্থিতি প্রতিনিয়ত ভয়াবহ হয়ে উঠছে। জেলা প্রশাসনের তথ্যেই পানিবন্দি মানুষের সংখ্যা অন্তত ১০ লাখ। এরই মধ্যে প্রাণ বাঁচাতে ঘরবাড়ি ছেড়ে আশ্রয়কেন্দ্রে ঠাঁই নিয়েছেন প্রায় ৬৭ হাজার মানুষ।
বন্যা কবলিত এলাকায় গেলেই দেখা যাচ্ছে- ক্ষুধার জ্বালায় কাঁদছে শিশুরা। শিশু খাদ্য না পেয়ে আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতেও এখন শিশুদের কান্নার রোল।
সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, গুড়াদুধসহ শিশুদের উপযোগী খাদ্য না মেলায় শুধুমাত্র শুকনো বিস্কুট আর কলাই বর্তমানে শিশুদের খাওয়ানো হচ্ছে। আর বেশিরভাগই খাচ্ছে চিড়া-মুড়ি। তবে শিশুরা সেগুলো খেতে চাচ্ছে না।
ফলে স্বাস্থ্যঝুঁকির পাশাপাশি ক্ষুধার্ত থাকছে অধিকাংশ শিশু। খাবারের জন্য বারবার বিরক্ত করলেও কিন্তু অসহায় বাবা-মা ছোট্ট সন্তানদের মুখে তুলে দিতে পারছেন না চাহিদা মতো খাবার।
এমন পরিস্থিতিতে বন্যা দুর্গত এলাকায় শিশু খাদ্য সরবরাহের জন্য রাজনৈতিক, সামাজিক ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানানো হয়েছে।
বুড়িচং উপজেলার ফকিরবাজার উচ্চ বিদ্যালয় আশ্রয়কেন্দ্র ঘুরে দেখা গেছে, সেখানে আশ্রয় নিয়েছেন দুই শতাধিক বানভাসি মানুষ। তাদের মধ্যে অন্তত ১৫ জন শিশু। যাদের মধ্যে ১ থেকে ৩ বছরের শিশু আছে অন্তত ১০ জন।
এসব শিশুদের মধ্যে যাদের বয়স ৩ বছরের ওপরে তাদের শুকনো বিস্কুট ও কলা খাইয়ে কোনোরকম দিন পার করা গেলেও যাদের বয়স এক থেকে তিন বছরের মধ্যে সেসব শিশুদের নিয়ে মহাদুশ্চিন্তায় আছেন তাদের অভিভাবকরা।
এসব শিশুরা সবসময় যে খাবারে অভ্যস্ত তারা এখন তা পাচ্ছে না। যার কারণে প্রতিনিয়ত কান্না করছে। আর বাবা-মায়ের কাছে খাবার চাইছে। কিন্তু অসহায় বাবা-মা খাবার দিতে না পেরে নিজেরাও কান্নায় ভেঙে পড়ছেন।
বাকশীমুল গ্রাম থেকে আশ্রয়কেন্দ্রটিতে স্ত্রী ও দুই বছরের মেয়ে মরিয়মকে নিয়ে এসেছেন জসিম উদ্দিন। তিনি বলেন, মাস দুয়েক আগে মায়ের দুধ খাওয়া ছাড়েছে মরিয়ম। দুই বছর বয়সী মেয়েটা শক্ত কোনো খাবার খেতে চায় না।
“গরুর দুধ মিশিয়ে নরম ভাত ও সুজি খাওয়ানো হতো তাকে। কিন্তু গত তিনদিন মেয়েটা আমার অনেক কষ্টে আছে। চিড়া-মুড়ি দিলে খায় না। দুধ খেতে চায়। আমি তাকে কোথা থেকে দুধ দেব বলেন?”
উপজেলার বাকশিমুল এলাকার দিনমজুর কামাল হোসেন বলেন, বৃহস্পতিবার রাত থেকে পানিতে তলিয়ে যেতে শুরু করে বুড়িচং। ভেবেছিলাম পানি কমে যাবে বা ভেঙে যাওয়া বাঁধ মেরামত করা হবে- এজন্য বাড়িতে ছিলাম শনিবার পর্যন্ত। কিন্তু কিছুই হয়নি।
“ঘরের ভেতরে কোমরসমান পানি দেখে স্থানীয় আশ্রয়কেন্দ্রে এসেছি। কিন্তু খাবার না থাকায় দুই বছরের মেয়েটা বারবার কান্না করছে। আশ্রয় কেন্দ্রে চিড়া-মুড়ি দেয়। এসব মেয়েটা খেতে চায় না।”
অসহায় এই বাবা বলেন, “অনেক কষ্টে শুকনো বিস্কুট আর কলা দিয়েছি। কিন্তু মেয়েটার কান্না থামছে না। টাকার অভাবে মেয়েটাকে একটু দুধও কিনে খাওয়াতে পারছি না। কারণ আমি এক নিঃস্ব বাবা।”
বুড়িচংয়ের ফকির বাজার এলাকার বাসিন্দা মানিক মিয়া বলেন, “বৃহস্পতিবার রাতে গোমতী নদীর প্রতিরক্ষা বাঁধ ভাঙার পর পানিতে তলিয়ে যায় পুরো উপজেলা। আমাদের গ্রামে শুকনো জায়গা নেই। ঘরের ভেতর পানি উঠে গেছে। তাই স্ত্রী ও দেড় বছরের শিশু সন্তানকে নিয়ে আশ্রয়কেন্দ্রে এসেছি।”
কিন্তু শিশুটির খাবার নিয়ে তীব্র সংকটে পড়েছেন জানিয়ে তিনি বলেন, “আমরা চিড়া মুড়ি খেয়ে থাকতে পারলেও আমার ছেলেটা এসব খেতে চায় না। আশ্রয়কেন্দ্র ও গ্রামের অন্য শিশুদেরও একই অবস্থা। যারা ত্রাণ নিয়ে আসছেন তারা যেন শিশুদের কথাও মাথায় রাখেন- এটাই আমার অনুরোধ।”
পানিতে তলিয়ে গেছে জেলার মনোহরগঞ্জ উপজেলার মান্দুয়ারা গ্রামটিও।
ওই গ্রামের বাবুল মিয়া স্ত্রী ও ২২ মাস বয়সী শিশুকে নিয়ে এসেছেন স্থানীয় একটি আশ্রয়কেন্দ্রে। কিন্তু এখানে শিশুদের কোনো খাদ্য দেওয়া হয় না। যার কারণে চরম কষ্টে দিন কাটছে তার।
বাবুলের বড় ছেলে মাসুমের বয়স ৪ বছর। সেও মুড়ি খেয়ে থাকতে চায় না।
বাবুল মিয়া বলেন, “পুরো আশ্রয়কেন্দ্রে ২০ জনের মতো শিশু আছে। রাত হলে শিশুদের কান্নায় কেউ ঘুমাতে পারে না। ক্ষুধার জ্বালা শিশুরা মুখ ফুটে বলতে পারে না, শুধু কান্না করে।”
জেলার চৌদ্দগ্রাম সদরের একটি আশ্রয়কেন্দ্রে থাকা দিদার হোসেন বলেন, ছোট্ট দুইটা শিশু সন্তানকে নিয়ে আশ্রয়কেন্দ্রে এসেছি চারদিন হলো। গত দুদিন ধরে আশ্রয়কেন্দ্রে দেওয়া খাবার খেতে চাচ্ছে না শিশুরা।
“বিভিন্ন মাধ্যমে বড়দের জন্য খাবার এলেও শিশুদের জন্য খাবার আসছে না। মুড়ি-চিড়া, শুকনো বিস্কুটসহ বড়দের খাবার একেবারেই মুখে নিতে চায় না বাচ্চারা।”
জেলার বুড়িচং উপজেলার ভরাসার উচ্চ বিদ্যালয় আশ্রয়কেন্দ্রে এসেছেন বানভাসি স্থানীয় ইছাপুরা এলাকার রুমা আক্তার ও জয়নাল আবেদীন। তাদের কোলে ১৬ মাসের ছেলে আব্দুল্লাহ।
এই দম্পতি বলেন, আব্দুল্লাহ এখনও মায়ের দুধ খায়। তিনদিন ধরে আশ্রয়কেন্দ্রে আছি। আশ্রয়কেন্দ্রে ওঠার পর থেকে বুকের দুধ একেবারেই মুখে নিতে চাচ্ছে না ছেলেটা। আশ্রয়কেন্দ্রে অপরিচিত মানুষ আর মানুষের কোলাহল থাকে সবসময়। মানুষের কারণে যত্ন করে দুধ খাওয়ানোর সঠিক পরিবেশ থাকে না।
ফলে শিশু আব্দুল্লাহর খাদ্য নিয়ে দুশ্চিন্তায় মা-বাবা। নিয়মমতো খাবার মুখে না নিলে পুষ্টিহীনতাসহ নানান স্বাস্থ্য ঝুঁকির আশঙ্কা করে সরকার ও মানবিক সংগঠনগুলোর প্রতি শিশুখাদ্য সহায়তা প্রদানের আহ্বান জানান এই দম্পতি।
শিশুদের খাদ্য সংকটের বিষয়ে কেন্দ্রীয় বিএনপির ত্রাণ ও পুনর্বাসন বিষয়ক সম্পাদক এবং কুমিল্লা দক্ষিণ জেলা বিএনপির আহ্বায়ক হাজী আমিন উর রশিদ ইয়াছিন বলেন, “শুকনো খাবারের পাশাপাশি আমরা খিচুড়ি বিতরণের উদ্যোগ নিয়েছি। তবে বন্যা দুর্গত এলাকায় মূল সমস্যা হলে নৌযান সংকট। নৌযান সংকটের কারণে রান্না করা খিচুড়ি সব জায়গায় পৌঁছানো যাচ্ছে না। দেখা গেছে কয়েক ঘণ্টার বেশি সময় রাখলে খাবার নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।”
“তবুও শিশুদের বিষয়ে মাথায় রেখে জুস, দুধসহ নরম খাবার বিতরণের জন্য আমাদের নেতাকর্মীদের বলা হয়েছে”, বলেন তিনি।
জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা মোহাম্মদ আবেদ আলী বলেন, কুমিল্লায় সরকারিভাবে মোট ৭১৪টি আশ্রয়কেন্দ্রে ১৫ হাজার ৫৯জন বিভিন্ন বয়সের শিশু আশ্রয় নিয়েছেন।
কুমিল্লা জেলা প্রশাসনের তথ্যমতে, ভয়াবহ বন্যায় জেলার ১৪টি উপজেলায় সোমবার পর্যন্ত ৯ লাখ ৫১ হাজার ১০৯জন পানিবন্দি অবস্থায় রয়েছেন। বন্যাকবলিত উপজেলাগুলোর দুর্গত এলাকার সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। আশ্রয়কেন্দ্রে এসেছেন ৬৬ হাজার ৯৬৬ জন।
কুমিল্লার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) পঙ্কজ বড়ুয়া বলেন, “শিশুদের বিষয়টি মাথায় রেখে আমরা সংশ্লিষ্ট সবাইকে দিকনির্দেশনা দিচ্ছি। বন্যাকবলিত মানুষের মাঝে শুকনা খাবার, স্যালাইন ও ওষুধ বিতরণ করা হচ্ছে। অন্যান্য ত্রাণসামগ্রী বিতরণও অব্যাহত আছে। আমরা সার্বক্ষণিক খোঁজ-খবর রাখছি।”