পাউবো জানায়, উপকূলীয় তিন জেলা খুলনা, সাতক্ষীরা ও বাগেরহাটে মোট দুই হাজার ৬ কিলোমিটারের মধ্যে প্রায় ৫১ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ জরাজীর্ণ ও ঝুঁকিপূর্ণ।
Published : 25 May 2024, 06:23 PM
বঙ্গোপসাগরে সৃষ্টি হওয়া নিম্নচাপটি গভীর নিম্নচাপে পরিণত হয়েছে; সেটি ঘূর্ণিঝড়ে রূপ নিতে পারে বলে জানিয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তর। এ কারণে খুলনার ঝুঁকিপূর্ণ বেড়িবাঁধ নিয়ে উৎকণ্ঠায় পড়েছেন উপকূলের মানুষ।
পানি উন্নয়ন বোর্ড-পাউবো জানায়, উপকূলীয় তিন জেলা খুলনা, সাতক্ষীরা ও বাগেরহাটে মোট দুই হাজার ৬ কিলোমিটারের মধ্যে প্রায় ৫১ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ জরাজীর্ণ ও ঝুঁকিপূর্ণ।
পাউবোর কর্মকর্তাদের দাবি, উপকূলীয় ওই তিন জেলার ঝুঁকিপূর্ণ বেড়িবাঁধ অনেকটাই সংস্কার করা হয়েছে। আরও কিছু এলাকা সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বেশ কিছু এলাকায় টেকসই বাঁধ নির্মাণের কাজ চলছে।
এদিকে খুলনা জেলা প্রশাসক খন্দকার ইয়াসির আরেফীন বলেন, ঘূর্ণিঝড় ‘রেমাল’ মোকাবিলায় ৬০৪টি আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত রাখা হয়েছে। যাতে পরিস্থিতি অনুযায়ী ঝুঁকিপূর্ণ লোকজন সেখানে আশ্রয় নিতে পারেন। এসব সাইক্লোন শেল্টারে মোট ৩ লাখ ১৫ হাজার ১৮০ জন মানুষ আশ্রয় নিতে পারবেন।
এ ছাড়া তিনটি মুজিব কিল্লায় ৪৩০ জন মানুষ আশ্রয় নিতে পারবেন। সেখানে ৫৬০টি গবাদি পশুও রাখা যাবে বলে জানান তিনি।
জেলা প্রশাসক বলেন, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নিজ নিজ কর্মস্থলে থাকার জন্য বলা হয়েছে। সতর্ক থাকার জন্য উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদেরকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। বিপদ সংকেত জারি হলে তারা এলাকায় মাইকিংয়ের ব্যবস্থা করবেন।
পাশাপাশি কয়রা, দাকোপ ও পাইকগাছা উপজেলায় পাঁচ হাজার ২৮০ জন স্বেচ্ছাসেবককে প্রস্তুত থাকতে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে বলে জানান এই জেলা প্রশাসক।
ইয়াসির আরেফীন বলেন, শুকনো খাবার, ওষুধ, ঢেউটিন ও নগদ টাকা প্রস্তত রাখা হয়েছে। প্রস্তত রয়েছে স্বাস্থ্য বিভাগ, জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল বিভাগ, ফায়ার সার্ভিস, পুলিশ, নৌ বাহিনী, কোস্ট গার্ড, পাউবো।
এদিকে কয়রা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. তারিক উজ জামান বলেন, ঘূর্ণিঝড় আর জলোচ্ছ্বাস হলে যে কয়টা জনপদ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে, কয়রা তার মধ্যে অন্যতম। উপজেলাটি তিন দিক নদীবেষ্টিত।
“জেলা শহর খুলনা থেকে সড়কপথে ১০০ কিলোমিটার দক্ষিণের এ উপজেলাটিকে ঘিরে রেখেছে কপোতাক্ষ, কয়রা এবং শাকবাড়িয়া নদী আর এ উপজেলার ছয়টি ইউনিয়নই সুন্দরবনের সীমানায় অবস্থিত। যে কারণে ছোটখাটো দুর্যোগেও প্লাবিত হয়ে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের সংখ্যা বাড়ে।”
তিনি আরও বলেন, ঘূর্ণিঝড়ের খবরে সতর্কতামূলক প্রস্তুতি গ্রহণ করা হয়েছে। আশ্রয়কেন্দ্রগুলো প্রস্তুত, দুর্যোগকালীন ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের খাদ্য, পানীয়ের ব্যবস্থাসহ সামগ্রিক পরিস্থিতি মোকাবিলায় স্বেচ্ছাসেবক টিম গঠন করা হয়েছে। সুন্দরবনে অবস্থানরত জেলেরাও যেন নিরাপদে তীরে ফিরে আসেন, সে জন্য মৎস্যজীবী সমিতির সঙ্গেও যোগাযোগ করা হয়েছে।
এলাকাবাসী, জনপ্রতিনিধি ও পাউবো কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, কয়রা উপজেলাটির সদর ইউনিয়নের মদিনাবাদ লঞ্চঘাট থেকে গোবরা পর্যন্ত প্রায় ১ কিলোমিটার, হরিণখোলা-ঘাটাখালি এলাকায় ১ কিলোমিটার, ৬ নম্বর কয়রা এলাকায় ৬০০ মিটার, ২ নম্বর কয়রা এলাকায় ৫০০ মিটার, মহারাজপুর ইউনিয়নের মঠবাড়ি-দশহালিয়া এলাকায় ২ কিলোমিটার, উত্তর বেদকাশি ইউনিয়নের কাটকাটা থেকে শাকবাড়িয়া গ্রাম পর্যন্ত ১ কিলোমিটার, কাশিরহাটখোলা থেকে কাটমারচর পর্যন্ত ৭০০ মিটার, পাথরখালী এলাকায় ৬০০ মিটার ও মহেশ্বরীপুর ইউনিয়নের শেখেরকোনা, নয়ানি, শাপলা স্কুল, তেঁতুলতলার চর ও চৌকুনি এলাকায় ৩ কিলোমিটারের মতো বাঁধ ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় আছে।
এ সব এলাকায় স্বাভাবিক জোয়ারের চেয়ে নদীর পানি বাড়লে বিভিন্ন স্থানে বাঁধ উপচে লোকালয়ে পানি প্রবেশের শঙ্কা তৈরি হয়েছে।
পাউবোর খুলনার উপ-সহকারী প্রকৌশলী মো. মশিউল আবেদীন জানান, তারা ঝুঁকিপূর্ণ বাঁধের তালিকা করে বরাদ্দের জন্য মন্ত্রণালয়ে পাঠান। কিন্তু তা অনুমোদন হতে সময় লাগে।
মশিউল বলেন, কয়রার উত্তর বেদকাশী ও দক্ষিণ বেদকাশী ইউনিয়নে বাঁধ নির্মাণসহ প্রায় ১ হাজার ২০০ কোটি টাকার মেগা প্রকল্পের কাজ চলমান। সাতটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান প্রকল্প বাস্তবায়নে কাজ করছেন। এ প্রকল্প শেষ হলে ৩২ কিলোমিটার বাঁধ ঝুঁকিমুক্ত হবে।
পাউবোর এই কর্মকর্তা বলেন, “দুর্যোগে বাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হলে সেখানে তাৎক্ষণিক প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে আমাদের প্রস্তুতি আছে। তবে বড় প্রাকৃতিক দুর্যোগ না হলে সমস্যা হবে না।”
তবে এলাকাবাসী বলছেন, বাঁধ নির্মাণের এ কাজে বালু সরবরাহের জন্য স্থানীয় ড্রেজার মালিকদের সঙ্গে চুক্তি করেছেন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। ড্রেজার মালিকরা বাঁধের পাশের শাকবাড়িয়া নদী থেকে বালু তুলছেন। অব্যাহত বালু তোলায় সুন্দরবনে ভাঙন যেমন বাড়ছে, তেমনি ঝুঁকিতে পড়ছে নির্মাণাধীন বাঁধও।
৩৭ লাখ টাকা চুক্তি মূল্যে কয়রার মহেশ্বরীপুর ইউনিয়নের হড্ডা থেকে বানিয়াখালী পর্যন্ত ১ হাজার ৩৫০ মিটার বাঁধ মেরামতকাজ সম্পন্ন করা হয়েছে। খুলনার ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মেসার্স আমিন অ্যান্ড কোম্পানিকে গত মার্চে কার্যাদেশ দেওয়া হয়।
আগামী ৩০ জুন পর্যন্ত কাজের মেয়াদ রয়েছে। মেরামতের মাস না যেতেই ধস দেখা দিয়েছে। মেরামতকাজ করার সময় এক্সক্যাভেটর দিয়ে বাঁধের গোড়া থেকে মাটি কেটে ফেলা হয়েছে। সেই মাটি দিয়ে খানিকটা উঁচু করা হয়েছে বাঁধ। সেই মাটি আবার গোড়ার গর্তে ধসে পড়েছে।
কয়রা উপজেলার স্থানীয় সংবাদকর্মী ও ‘ক্লাইমেট মুভমেন্ট বাংলাদেশ’র উপজেলা সমন্বয়ক শেখ সিরাজউদ্দৌলা বলেন, “ঝড়ের চেয়ে আমাদের বড় ভয় বেড়িবাঁধ। আগে থেকে ক্ষতিগ্রস্ত বাঁধগুলো কোনো রকমে টিকে আছে। যেকোনো দুর্যোগ বা বৈরী আবহাওয়ায় নদীতে জোয়ারের পানি বাড়লে বাঁধে ভাঙন তৈরি হয়, বাঁধ ভাঙে। প্লাবিত হয় বিস্তীর্ণ এলাকা। নষ্ট হয় ঘরবাড়ি, ফসল। ভিটেবাড়ি হারিয়ে নিঃস্ব হয় মানুষ।”
কয়রা উন্নয়ন সংগ্রাম সমন্বয় কমিটির সভাপতি বিদেশ রঞ্জন মৃধা বলেন, “টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণের দাবি আমাদের বহুদিনের। ঝুঁকিপূর্ণ বাঁধের বিষয়ে জনপ্রতিনিধিদের জানালেও তারা শুধু আশ্বাস দেন। পরিকল্পিত ও স্থায়ী বাঁধ নির্মিত না হওয়ায় প্রতিবছর ভাঙন দেখা দেয়। এ জন্য পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তাদের গাফিলতিই দায়ী।”
কয়রার দক্ষিণ বেদকাশি ইউনিয়নের সাবেক ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান আবদুস সালাম খান বলেন, “উপকূলীয় এ জনপদ স্বভাবতই, প্রায়ই প্রাকৃতিক দুর্যোগের কবলে পড়ে। তবে এতকাল যত দুর্যোগ এসেছে, অধিকাংশই মে মাসে। এ জন্য মে মাস এলেই আতঙ্কে থাকেন উপকূলবাসী। ঘূর্ণিঝড় না হলেও এসময় নদীর পানি বেড়ে বাঁধ ভেঙে এলাকা প্লাবিত হওয়ার শঙ্কা থেকেই যায়।”
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক দিলীপ কুমার দত্ত বলেন, বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে প্রতিবছরই উপকূলে নদীভাঙন, জলোচ্ছ্বাস ও ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানছে। এর থেকে ক্ষতি কমাতে সরকারের বড় পরিকল্পনা দরকার।
নানা কারণে উপকূলের বাঁধগুলোর সক্ষমতা কমেছে। পানিতে লবণের পরিমাণ বেড়ে যাওয়ায় মাটির কণাগুলো একে অপরের সঙ্গে আঁকড়ে ধরে রাখার ক্ষমতা হারাচ্ছে, অর্থাৎ ঝুরঝুরে হয়ে যাচ্ছে। ফলে ভাঙন বাড়ছে, বাঁধগুলো টিকছে না বলে জানান তিনি।