এবার ১৫ থেকে ২০ কেজি ওজনের কাতলা কেজিপ্রতি সর্বোচ্চ ১ হাজার ১০০ টাকা ; ১২ কেজি ওজনের মাছ ৮৫০–৯০০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে।
Published : 14 Apr 2025, 09:07 PM
ডালায় সাজানো আছে বড় বড় কাতলা, কোনটি ডালার মধ্যেই লাফালাফি করছে। কিছু আবার পানিতে জিইয়েও রাখা হয়েছে। রয়েছে ২০ কেজি ওজনের কাতলাও। ঘুরে ঘুরে দরদাম করছেন ক্রেতারা, মাছ যত বড় দামও তত বেশি।
সোমবার ক্রেতা-বিক্রেতার এমন ব্যস্ততার দৃশ্য দেখা গেল কুমিল্লা নগরীর রাজগঞ্জে। যেখানে প্রতিবছর বাংলা নববর্ষের প্রথম দিনে বসে কাতলা মাছের মেলা।
রাজগঞ্জ বাজার ও এর আশপাশের সড়কে বসা দুদিনব্যাপি এ মেলায় দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে মাছ নিয়ে আসেন শৌখিন বিক্রেতারা। শত বছরের পুরোনো ঐতিহ্য মেনে হাজির হন ক্রেতারাও।
এতে জমজমাট হয়ে ওঠা মেলায় দিনে কোটি টাকার বেঁচাকেনা হয় বলে দাবি ব্যবসায়ীদের।
মাছ বিক্রেতারা বলছেন, মূলত কাতলা মাছের মেলা হলেও অন্যান্য মাছও পাওয়া যায়। এবার অন্যান্য বছরের তুলনায় কাতলা মাছ বেশি এসেছে মেলায়। মাছের ৮০ শতাংশই কাতলা। এই মেলা চলবে মঙ্গলবার রাত পর্যন্ত।
তবে এবার মাছের দাম অনেকটাই বেশি বলে জানলেন মেলায় মাছ কিনতে আসা মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান।
তিনি বলেন, “গত পরশু যেই মাছ ৫৫০ টাকায় কিনেছি, সেই মাছ আজ বিক্রি হচ্ছে ৮৫০ টাকায়। তবে এবার প্রচুর মাছ এসেছে, যার বেশির ভাগই কাতলা।”
দীর্ঘদিন ধরে এই মেলায় মাছ কিনতে আসেন কুমিল্লা নগরের বিষ্ণুপুর এলাকার বাসিন্দা শাহানুল হক।
তিনি বলেন, “এই মেলায় এসে মাছ কেনা আমার শখ। ৪০ বছরের বেশি সময় ধরে পয়লা বৈশাখে মেলা থেকে মাছ কিনেছি। এবার তিন হাজার ৪০০ টাকা দিয়ে প্রায় ৬ কেজি ওজনের কাতলা কিনেছি।”
সোমবার সকাল ৯টা থেকে বেলা ১২টা পর্যন্ত মেলায় ঘুরে দেখা যায়, মেলাকে কেন্দ্র করে নানা শ্রেণি-পেশার মানুষের ঢল নেমেছে রাজগঞ্জ বাজারে। রয়েছে উৎসুক জনতার ভিড়ও। মেলায় ৩ থেকে ২০ কেজি ওজনের কাতলা মাছ রয়েছে।
এছাড়াও ডালায় সাজানো আছে বড় আকারের রুই, মৃগেল, আইড়, শোল ও কার্প মাছও। এছাড়াও বড় সাইজের টেংরা, শিং, পুটি, চিংড়ি মাছেরও পসরা সাজিয়ে বসেছেন বিক্রেতা।
বিক্রেতারা বলছেন, উৎপাদন খরচ বাড়ায় তার প্রভাব পড়েছে মাছের দামে। এবার ১৫ থেকে ২০ কেজি ওজনের কাতলা কেজিপ্রতি সর্বোচ্চ ১ হাজার ১০০ টাকা ; ১২ কেজি ওজনের কাতলা মাছ ৮৫০–৯০০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। সর্বনিম্ন প্রতি কেজির দাম ৪০০ টাকা; সে ক্ষেত্রে মাছের ওজন ৩ কেজির মতো।
অন্যদিকে রুই মাছ ৪০০ থেকে ৮০০ টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে। এবারের মেলায় ১০ কেজি ওজনের রুই মাছ বিক্রি হচ্ছে ৭৫০–৮০০ টাকা দরে। ১০ কেজি ওজনের কম হলে দাম নেমে আসে ৪৫০-৬৫০ টাকায়।
রাজগঞ্জ বাজারে প্রায় ৪৫ বছর ধরে মাছ বিক্রি করেন আবুল হাশেম। তিনি বলেন, মেলায় কুমিল্লা ছাড়াও চাঁদপুর, নোয়াখালী, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, নোয়াখালী, ফেনীসহ যশোর, সাতক্ষীরা, রাজশাহী থেকেও মাছ এসেছে। এবার অন্তত ৩০০ মাছ বিক্রেতা এসেছেন।
“আকার ও ওজন অনুযায়ী মাছের দরদাম নির্ধারিত হয়ে থাকে। জীবিত মাছের দাম একটু বেশি। এর মধ্যে পুকুর-দিঘিতে চাষ হওয়া মাছের চাহিদা বেশি। আকারে খুব বেশি বড় না হলেও স্বাদ ভালো হওয়ায় এই মাছের দামও কিছুটা বেশি।”
দেবিদ্বার থেকে কাতলা মাছ নিয়ে মেলায় এসেছেন মন্টু দাস। তিনি প্রতিবছর মেলায় বিক্রির জন্য তিনি পুকুর ও দিঘিতে কাতলা মাছ চাষ করেন।
তিনি বলেন, “সোমবার পহেলা বৈশাখের দিন সকালে ২০০টি কাতল মাছ নিয়ে আসি। বিকাল পর্যন্ত দেড়শোটির উপরে বিক্রি হয়ে গেছে। মাছ বড় হলে কেজিপ্রতি দাম বাড়তে থাকে। তবে মাঝারি মাপের মাছের চাহিদা বেশি।”
রাজগঞ্জ বাজারের প্রবীণ মাছ ব্যবসায়ী মো. বাদল বলেন, “বৈশাখী মেলা উপলক্ষে কুমিল্লার রাজগঞ্জ বাজারের এ মেলায় প্রতিদিন প্রায় কোটি টাকার মাছ বিক্রি হয়। শুধুমাত্র কুমিল্লা জেলার নয় দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে মাছ ব্যবসায়ীরা এখানে মাছ নিয়ে আসেন। কিছু মাছ ব্যবসায়ী আছেন, যাঁরা এই মেলায় বিক্রির জন্যই মাছ বড় করে থাকেন।”
এই মাছের মেলা কুমিল্লার ঐতিহ্যের অংশ বলে জানালেন কুমিল্লার ইতিহাস–গবেষক আহসানুল কবীর।
তিনি বলেন, “এই মেলা ঠিক কবে শুরু হয়েছিল সেটি নির্দিষ্ট করে বলা যাচ্ছে না। তবে এই মেলার বয়স শত বছরের বেশি এবং এটি কুমিল্লার ঐতিহ্য।”
“মেলা থেকে বড় মাছ কিনে আত্মীয়স্বজনের বাসায় পাঠানো হয় এবং অনেকে মেলার মাছ দিয়ে অতিথি আপ্যায়নও করেন।”
এই মেলায় একসময় শুধুই কাতলা মাছ উঠত। এখন অন্যান্য মাছও আসে; তবে অধিকাংশই কাতলা মাছ, বলেন এই ইতিহাস গবেষক।