পেশায় স্কুলশিক্ষক নাজমুলের নেশা দুর্লভ জিনিস সংগ্রহ করা; ৩৮ বছর ধরে তিনি সাজিয়েছেন জাদুঘরটি।
Published : 07 Jul 2024, 12:43 PM
সাড়ে ৩০০ বছর আগে ঘরের তালা কেমন ছিল? এক কালে পাগলা ঘণ্টি না, বিপজ্জনক যে সংকেত ধ্বনি বাজানো হত, সেটি দেখতে কেমন? প্রথম যে টেলিভিশনগুলো বাজারে ছাড়া হয়, সেগুলোই বা কেমন ছিল?
এই যুগের মানুষদের ইতিহাসের কোলে ফিরিয়ে নিয়ে তা দেখাচ্ছেন কুমিল্লার স্কুলশিক্ষক নাজমুল আবেদীন। তিনি পেশায় একজন স্কুল শিক্ষক হলেও নেশায় একজন সংগ্রাহক।
৩৮ বছর ধরে দেশ-বিদেশের নানা এলাকা থেকে সংগ্রহ করেছেন দুর্লভ, দুষ্প্রাপ্য ও বিলুপ্ত পাঁচ শতাধিক জিনিস। সেগুলো নিজের বাক্সে ভরে না রেখে সাধারণ মানুষকে দেখার সুযোগ করে দিয়েছেন তিনি।
২০১৫ সালে নাজমুল চিন্তা করলেন, তার সংগ্রহগুলো দেখুক মানুষও, কুমিল্লা নগরীতে ভাড়া বাসায় প্রতিষ্ঠা করেন ‘কুমিল্লা জাদুঘর’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান।
নগরীর মগবাড়ি চৌমুহনী এলাকায় প্রতিষ্ঠিত ওই জাদুঘরটি বিনা খরচে সকাল ১০টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত দর্শনার্থীরা দেখেছে ২০২১ সাল পর্যন্ত।
২০২১ সালে এগিয়ে আসে কুমিল্লা সিটি করপোরেশন। তারা কুমিল্লা নগর উদ্যানের এক কোণে একটি ছোট আকৃতির ঘর নির্মাণ করে দেয় নাজমুলকে। এরপর থেকে সেখানেই দুর্লভ জিনিসপত্রগুলোর প্রদর্শন চলছে।
এখন আর বিনামূল্যে নেই, ১০ ও ২০ টাকার টিকেট কাটতে হয়, এই টিকেট বিক্রির আয়ে জাদুঘরটি দেখাশোনা এবং দর্শনার্থীদের দিক-নির্দেশনা দিতে একজন লোক রেখেছেন নাজমুল।
নাজমুল আগে কুমিল্লা জিলা স্কুল ও নবাব ফয়জুন্নেছা স্কুলে শিক্ষকতা করেছেন। বর্তমানে পড়াচ্ছেন চাঁদপুর গভর্নমেন্ট টেকনিক্যাল হাইস্কুলে। তার গ্রামের বাড়ি কুমিল্লার আদর্শ সদর উপজেলার কালিরবাজার এলাকার বারাইপুরে।
শিক্ষকতার পাশাপাশি বিভিন্ন সৃজনশীল কাজ, ফটোগ্রাফি ও লেখালেখি করেন তিনি।
তার জাদুঘরের সংগ্রহশালায় রয়েছে প্রথম দিককার টেলিভিশন, শত বছরের পুরোনো ইট, বিভিন্ন খনিজ সম্পদ-পাথর, তাঁতের চরকি, কাঁসা পিতলের ডেগ, দুধের পুরোনো পাত্র।
৫০ কেজি ওজনের বাটখারা, পুরনো পাগলা ঘণ্টা, শত শত বছর আগের কৃষকদের বিভিন্ন কৃষি সরঞ্জাম, ৩২ কেজি ওজনের প্রাচীন ফ্যান, হ্যাজাক লাইটের দেখাও মেলে সেখানে।
বিভিন্ন পশু-পাখির হাড়, প্রাচীন সের মাপার বাটখারা, লোহার পাল্লা, বাবুই পাখির বাসা, ১০০ দেশের প্রাচীন মুদ্রা, প্রাচীন রেডিও, মিশরের কাঠের ভাস্কর্য, পিতলের বদনা-চেরাগ, আছে সাপের বীণও।
আরও রয়েছে সাড়ে ৩০০ বছরের পুরনো তালা, প্রাচীন রূপার মুদ্রা, টেলিফোন, ঘোড়ার চামড়া. প্রাচীন ঘড়ি, হরিণ-বুনো মহিষের শিং, প্রাচীন ছুরি, জায়গা মাপার লোহার শিকল, বেয়ারিংয়ের গাড়ি, গরুর কাইর, খড়ম, এমনকি বাংলা সিনেমার পুরনো রিল।
তালের নৌকা, ঢেঁকি, পালকি, কলের গানের মতো সরঞ্জামও আছে এই সংগ্রহশালায়।
তবে জায়গার অভাবে আরও অনেক জিনিসপত্রের প্রদর্শন করতে পারেননি বলে জানান নাজমুল।
স্কুল জীবন থেকেই এসব জিনিস সংগ্রহের কাজ শুরু হয় জানিয়ে তিনি বলেন, “একসময় অনেকে এগুলোকে পাগলামি বলত, তবে এখন উৎসাহ দেয়।”
এসব সংগ্রহের জন্য এখন পর্যন্ত দেশের ৫০টি মত জেলায় গিয়েছেন নাজমুল, গিয়েছেন দেশের বাইরেও। এ কাজে তাকে সহায়তা করেন তাঁর স্ত্রী ফারহানা মরিয়ম, ছেলে রূপক ও পুলক।
জাদুঘর প্রতিষ্ঠার চিন্তা তুলে ধরে তিনি বলেন, “এক পর্যায়ে চিন্তা করলাম এসব ঐহিত্য ও বিলুপ্ত জিনিসপত্র নিয়ে যদি একটি প্রতিষ্ঠান করা যায় তাহলে সবাই এগুলো দেখতে পারবে। সেই চিন্তা থেকে ২০১৫ সালে প্রতিষ্ঠা করলাম ‘কুমিল্লা জাদুঘর’।
“আমার মূল উদ্দেশ্য হল নতুন প্রজন্মের কাছে প্রাচীন ঐতিহ্য ও বিলুপ্ত এবং দুর্লভ সব জিনিস তুলে ধরা।”
অনেকে এখন পুরনো সামগ্রী দিয়ে যান জানিয়ে তিনি বলেন, “সেগুলোর গায়ে দাতার নাম লিখে প্রদর্শন করি।”
এ ছাড়া প্রদর্শন হওয়া বেশিরভাগ জিনিসের গায়ে সেটির পরিচয় লিখে রাখা হয়েছে।
জাদুঘরের জন্য দেওয়া স্থানটি আরেকটু বড় হলে সব জিনিসপত্র আরও ভালোভাবে প্রদর্শন করা যেত, বলেন তিনি।
ঐতিহ্যের নগরী কুমিল্লা (দি সিটি অব হেরিটেজ), সরকারি টেলি যোগাযোগ কোম্পানি বিটিসিএল এর স্লোগান ‘দেশ ও মানুষের সেবায়’ এবং রাজধানীর হোটেল রূপসী বাংলার নামকরণও করেছেন নাজমুল।
এমন একটি জাদুঘর প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেওয়ার প্রশংসা করে কুমিল্লার ইতিহাসবিদ ও গবেষক আহসানুল কবীর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আধুনিকতার নামে আমরা যখন ইতিহাস-ঐতিহ্য বিনাশের পথে হাঁটছি, সেই সময় একজন সত্যিকারের ঐতিহ্য প্রেমীর এই কাজটি আমাদের সবার জন্য অনুকরণীয়।
“আমি এ কাজে তাকে ধন্যবাদ জানাই এবং আশা করছি, তিনি এই কাজ অব্যাহত রাখবেন। আর কুমিল্লার জনগণের উচিত তার এই কাজে সহযোগিতার হাত প্রসারিত করা।”
জাদুঘরটি ঘুরতে আসা আতিকুর রহমানসহ কয়েকজন দর্শনার্থী বলেন, এসব জিনিসপত্রের বেশিরভাগই নতুন প্রজন্ম চেনে না, ব্যবহারও জানা নেই।
জান্নাতুল ফেরদৌস নামে একজন বলেন, “আপাতদৃষ্টিতে এসবের কোনো মূল্য না থাকলেও একসময় এগুলোই ছিল নিত্যব্যবহার্য, জীবনযাপনের অপরিহার্য অংশ। জিনিসগুলো একটি সময়কে ধরে রেখেছে। হয়ে উঠেছে ঐতিহ্য।”
কামরুল ইসলাম নামে আরেক দর্শনার্থী বলেন, “ঐতিহ্যকে হারিয়ে যেতে দিতে নেই, টিকিয়ে রাখতে হয়। সেই কাজটি করা হয়েছে এই জাদুঘরে। আমরা চাই, এটি আরও সমৃদ্ধ হোক।”