ইউএনও দাবি করেছেন, তিনি কারেন্ট জালে আগুন দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন, ট্রলারে নয়।
Published : 14 Oct 2022, 06:53 PM
বরিশালের বাবুগঞ্জে মা ইলিশ রক্ষার অভিযানে উপজেলা প্রশাসনের ভাড়া করা একটি ট্রলারে আগুন দেওয়ার ঘটনা তদন্তে কমিটি করেছে জেলা প্রশাসন।
বৃহস্পতিবার রাতে অভিযান শেষে বাবুগঞ্জ খেয়া ঘাটে আসার পর ‘নির্দেশ অমান্য করায়’ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) নুসরাত ফাতিমার ‘নির্দেশে’ নিরাপত্তারক্ষী আনসার সদস্য ডিজেল ঢেলে অগ্নিসংযোগ করে বলে ‘রিকুইজিশন করা’ ট্রলার মালিক মো. আনোয়ার হোসেন অভিযোগ করেন।
শুক্রবার বিকেলে বরিশাল জেলা প্রশাসক জসীম উদ্দীন হায়দার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, এ ঘটনায় অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেটকে প্রধান করে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। আগামী পাঁচ কার্যদিবসের মধ্যে তাদের তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট শাহ মো. রফিকুল ইসলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, তদন্ত কমিটি গঠনের বিষয়টি তিনি শুনেছেন। তবে চিঠি এখনও পাননি।
“ঘটনার সময় অনেক লোক সেখানে ছিলেন। যাদের সিংহভাগ জেলা পরিষদ নির্বাচনের ভোটার। আগামী ১৭ অক্টোবর ভোট। তাই এখনই তদন্ত শুরু করা যাচ্ছে না। ভোট শেষ হওয়ার পর ১৮ অক্টোবর থেকে কাজ শুরু করতে পারবো,” যোগ করেন অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট।
ট্রলার মালিক আনোয়ার হোসেন জানান, গত ১৪ বছর ধরেই তার ট্রলারটি উপজেলা প্রশাসন ভাড়া করে অভিযান পরিচালনা করছে। বৃহস্পতিবার রাতেও ইউএনও এবং উপজেলা প্রশাসন সেই ট্রলারে করে অভিযানে যান।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “অভিযান শেষে তীরে ভিড়তে নিষেধ করার বিষয়টি জানানোর জন্য উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা আমাকে ফোন করেছিলেন। কিন্তু ইঞ্জিনের শব্দে মোবাইলের রিং শুনতে না পাওয়ায় আমি কল রিসিভ করিনি। তারপর ট্রলারটি ঘাটে ভেড়ানোর পর মৎস্য কর্মকর্তা ও ইউএনও এসে আমাকে একটি বাঁশ দিয়ে আঘাত করেন।”
তখন আনোয়ার ঘটনাস্থল থেকে চলে যান। পরে ইউএনও এবং মৎস্য কর্মকর্তার নির্দেশে ট্রলারে আগুন দেওয়া হয় বলে অভিযোগ করেন আনোয়ার।
মালিকের দাবি, ট্রলারটি পুড়িয়ে দেওয়ায় তার ৩ লাখ ৭০ হাজার টাকা ক্ষতি হয়েছে।
ট্রলারে আগুন দেওয়ার পর ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সকে খবর দেওয়া হয়। তখন বাবুগঞ্জ উপজেলা ফায়ার সার্ভিসের ভারপ্রাপ্ত স্টেশন অফিসার আব্দুল মালেকের নেতৃত্বে একটি দল গিয়ে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনার কাজ শুরু করেন। রাত ৯টা ৫ মিনিটে আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে।
এ ব্যাপারে কথা বলার জন্য বৃহস্পতিবার রাতে ইউএনও নুসরাত ফাতিমার মোবাইলে একাধিকবার কল দিলেও সেটি বন্ধ পাওয়া যায়।
তবে অগ্নিসংযোগের সময়কার একটি ভিডিওতে ইউএনও নুসরাতকে ফায়ার সার্ভিস কর্মকর্তা উদ্দেশ করে বলতে শোনা যায়, তাকে তো খবর দেওয়া হয়নি। এটা মামলার আলামত হিসেবে পুড়াচ্ছেন, এটা এমনিতেই নিভে যাচ্ছিল।
তখন ফায়ার সার্ভিস কর্মকর্তা মালেক বলেন, তাকে বাবুগঞ্জ থানার ওসি খবর দিয়েছেন।
তবে শুক্রবার এ নিয়ে ইউএনও নিজ কার্যালয়ে সংবাদকর্মীদের সঙ্গে কথা বলেছেন।
এ সময় তিনি বলেন, “আনোয়ারের ট্রলার আমি জব্দ করিনি। আমি জব্দ করেছি কারেন্ট জাল। এবং আমি কারেন্ট জাল পুড়ানোর নির্দেশ দিয়েছিলাম। আগুন কোনো না কোনোভাবে দুর্ঘটনাবশত লেগে গিয়েছে। সেটা নেভানোর জন্য আমি প্রাণান্তকর চেষ্টা করেছি এবং নিভেছে।”
ইউএনও আরও দাবি করেন, তিনি কারেন্ট জালে দেওয়া আগুনে জল ঢালতে নিষেধ করেছিলেন, ট্রলারে নয়।
সরকারকে বিব্রত করতে এবং মা ইলিশ রক্ষার সাফল্যকে বানচাল করতে বাবুগঞ্জের কিছু স্বার্থান্বেষী মহল চেষ্টা করছে বলে এই মুহূর্তে ইউএনওর মনে হচ্ছে। তিনি আরও বলেন, যেহেতু ট্রলারটি তিনি নিজেই ভাড়া করেছিলেন তাই সেটি পুড়িয়ে দিয়ে ব্যক্তিগত বা সরকারের কোনো লাভ হতো না।
ট্রলার মালিক আনোয়ারকে এ জন্য ক্ষতিপূরণ দেওয়ার আশ্বাসও দেন ইউএনও।
তবে স্থানীয় কয়েকজন জেলে বলেন, নদীতে জব্দ করা জাল তীরে এনে নৌকা বা ট্রলার থেকে নামিয়ে নিরাপদ কোনো জায়গায় পুড়ানো হয়। ট্রলাতে জাল রেখে আগুন দিতে এর আগে কখনও তারা শুনেননি।
অভিযানে জব্দ করা আলামত ধ্বংসের বিষয়ে জানতে চাইলে বরিশাল জেলা মৎস্য কর্মকর্তা (ইলিশ) বিমল চন্দ্র দাশ সন্ধ্যায় বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “নিয়ম অনুযায়ী, অভিযানে জব্দ করা জাল নিরাপদ স্থানে নিয়ে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দিতে হবে। এ ছাড়া যানবাহন অর্থাৎ নৌযান জব্দ করা হলে সেটি পরবর্তী সময়ে নিলামের মাধ্যমে বিক্রি করতে হবে।”
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে বাবুগঞ্জ থানার ওসি মাহবুবুর রহমান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমি ছিলাম না। আমি শোনা কথা বলতে পারবো। পুলিশ সদস্যদের কাছ থেকে যেটুকু জেনেছি তা হলো, অভিযানের পর আনোয়ারকে বিভিন্ন ধরনের প্রশ্ন করা হয়, তখন সে ভয়ে পালিয়ে যায়।”
“পরে ইউএনও সাহেবের সঙ্গে থাকা দেহরক্ষী আনসার সদস্যদের দিয়ে ডিজেলের মাধ্যমে ট্রলারটিতে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। কী কারণে ট্রলারটিতে আগুন দেওয়া হয়েছে সে বিষয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বলতে পারবেন।”
উপজেলা চেয়ারম্যান কাজী ইমদাদুল হক দুলাল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, একটি স্প্রিডবোট ও দুইটি ট্রলার নিয়ে অভিযান করেন তারা। অভিযান শেষে ফেরার সময় ইউএনও তার নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত ট্রলার তীরে ভেড়াতে নিষেধ করেন। কিন্তু ওই ট্রলার তীরে ভেড়ায়। এতে ইউএনও ক্ষুদ্ধ হলে ট্রলার চালক পালিয়ে যায়।
তিনি চলে আসার পর আগুনের ঘটনা ঘটেছে জানিয়ে উপজেলা চেয়ারম্যান বলেন, “অভিযানে যাওয়া এ ট্রলারটি তীরে ভেড়ার পর মাছ ও জাল সরিয়ে ফেলে। আজকেও সেই কাজ করেছে। এতে বদনাম হয়। তাই হয়তো ই্উএনও আরও বেশি ক্ষুব্ধ হয়েছেন।”
আরও পড়ুন: