“সংস্কার না করায় সড়কের বেশিরভাগ স্থানে বড় বড় গর্ত হয়েছে। অনেক স্থান দেবে গেছে। সামান্য বৃষ্টিতেই কাদাপানিতে একাকার হয়ে যাচ্ছে।”
Published : 02 Oct 2024, 09:19 AM
পটুয়াখালী-কুয়াকাটা সড়কের কলাপাড়া উপজেলার ১১ কিলোমিটার ইট-বালু-খোয়া উঠে খানাখন্দ আর বড় বড় গর্তের সৃষ্টি হয়েছে। একাকার হয়ে গেছে কাদাপানিতে। এতে ‘সাগরকন্যা’ কুয়াকাটা সমুদ্রসৈকতে বেড়াতে আসা পর্যটক ও এলাকাবাসী দুর্ভোগের শিকার হচ্ছেন প্রতিনিয়ত।
উপজেলার পাখিমারা বাজার থেকে লতাচাপলী ইউনিয়নের আলীপুর শেখ রাসেল সেতুর দক্ষিণ প্রান্তে ত্রিমুখী (তিন রাস্তার) মোড় পর্যন্ত মূলত ভোগান্তির এলাকা। পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর থেকে দক্ষিণ জনপদে আসতে উন্নত সড়ক ও যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে ওঠায় পর্যটকরা এখন বেশি বেশি কুয়াকাটামুখী হচ্ছেন। পর্যটকদের কুয়াকাটায় যেতেও হয় পটুয়াখালী-কুয়াকাটা মহাসড়কের ওই পথ ধরেই।
কিন্তু ১০ বছরেও এ সড়কের কোনো সংস্কার না হওয়ায় ভোগান্তি নিত্যদিনের সঙ্গী হয়ে দাঁড়িয়েছে; এতে অতিষ্ট পর্যটকরাও। গর্তের কারণে এই সড়ক দিয়ে চলাচল করতে গিয়ে প্রায়ই ছোট-বড় দুর্ঘটনা ঘটছে। বিকল হচ্ছে যানবাহন।
দক্ষিণাঞ্চলের অন্যতম মাছের মোকাম মহিপুর, আলীপুর ও কুয়াকাটা থেকে মাছ দেশের বিভিন্ন স্থানে বাজারজাত করতেও ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে খানাখন্দের কারণে। ফলে দ্রুত সড়কটি সংস্কারের দাবি জানিয়েছে ব্যবসায়ী ও স্থানীয়রা।
পাখিমারা বাজারের মুদি দোকানি মো. ইসমাইল হোসেন বলেন, “আমাদের এলাকার রাস্তা তো দীর্ঘদিন ধরেই খারাপ। খানাখন্দ তো সারাবছর আছেই। এখন বর্ষায় কাদাপানিতে একাকার হয়ে যাওয়ায় ভোগান্তি বেড়েছে। এই কাদা পার হয়ে লোকজন বাজারে-দোকানে আসতে পারে না। ফলে আমাদের ব্যবসা-বাণিজ্যও কমে গেছে।”
পাখিমারা বাজারের একটি রেস্তোরাঁর মালিক আলতাফ মীর বলেন, “সংস্কার না করায় সড়কের বেশিরভাগ স্থানে বড় বড় গর্ত হয়েছে। অনেক স্থান দেবে গেছে। সামান্য বৃষ্টিতেই কাদাপানিতে একাকার হয়ে যাচ্ছে পুরো সড়কটি। শুকনা সিজনে দূরপাল্লার গাড়িগুলো যাত্রীদের নাস্তা-পানির জন্য এখানে থামায়। কিন্তু কাদার কারণে এখন সেটা বন্ধ।”
সরেজমিনে দেখা গেছে, কলাপাড়া-কুয়াকাটা মহাসড়কের পাখিমারা বাজার থেকে মহিপুরের শেখ রাসেল সেতুর দক্ষিণ প্রান্ত পর্যন্ত সড়কের বেশির ভাগ স্থানের পিচ-ঢালাই উঠে গেছে। বেরিয়ে গেছে ইট-বালু-খোয়া। বর্ষা মৌসুমে বৃষ্টির কারণে কাদামাটি পানিতে মিশে একাকার হয়ে আছে। কর্দমাক্ত পানিতে কোথাও কোথাও বড় বড় গর্তের সৃষ্টি হয়েছে।
সড়কের এ অংশে অসংখ্য ছোট-বড় গর্ত রয়েছে। বৃষ্টির পানি ওই গর্তে জমে সড়কের অবস্থা আরও খারাপ হয়েছে। প্রতিনিয়ত ঘটছে ছোট বড় বহু দুর্ঘটনা। গর্তে ইট ফেলে ভরাট করে সড়কটি সচল রাখার চেষ্টা করা হচ্ছে বলে সড়ক বিভাগ বলে দাবি করলেও দুর্ভোগ একটুও কমেনি বলে অভিযোগ করেছেন ভুক্তভোগীরা।
মহিপুর এলাকার সুমন হা্ওলাদার বলছিলেন, “দীর্ঘদিন ধরেই তো এই অবস্থা। বর্ষাকাল আসলে তো ভীষণ অসুবিধা হয় আমাদের। কিন্তু কর্তৃপক্ষের কোনো নজর নেই। সড়ক ও জনপথ বিভাগ দুই দফায় ইটের খোয়া ফেলে গর্তগুলো ভরাট করলেও কয়েকদিন যেতে না যেতেই আবার আগের মত হয়ে গেছে। আগের চেয়ে এখন আরও খারাপ অবস্থা হয়েছে। সড়কে পানি জমে চাষের জমিতে পরিনত হয়েছে। আমরা এই দুর্ভোগ থেকে মুক্তি চাই।”
বরিশাল-কুয়াকাটার সড়কে চলাচলকারী আলী পরিবহনের চালক রফিক মিয়া বলেছেন, “রাস্তার যে অবস্থা তাতে গাড়ি মাঝেমধ্যেই অটকে যায়। ওই ১১ কিলোমিটার পথ পর হতে এক ঘণ্টার বেশি সময় লাগে। গাড়ি গর্তে পড়ে দুলতে থাকে। ফলে যাত্রীরাও ভয় পায়।”
পটুয়াখালী সড়ক ও জনপথ (সওজ) বিভাগ থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০০৯-২০১৪ অর্থবছরে পটুয়াখালী-কুয়াকাটা মহাসড়কের কলাপাড়া উপজেলার পাখিমারা বাজার থেকে আলীপুর মৎস্য বন্দরের শেখ রাসেল সেতু পর্যন্ত সাড়ে ১১ কিলোমিটার অংশের উন্নয়ন কাজ বাস্তবায়ন করে খুলনার ‘দি রূপসা ইঞ্জিনিয়ার্স লিমিটেড’ নামের একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। তখন এর নির্মাণ ব্যয় ধরা হয়েছিল ২০ কোটি টাকা। কিন্তু কাজটি ‘মানসম্মত না হওয়ায়’ তখন ঠিকাদারের বিল আটকে দেয় সওজ কর্তৃপক্ষ। এ নিয়ে সওজ-এর প্রধান প্রকৌশলীর কার্যালয় থেকে আলাদা দুটি দল সরেজমিন তদন্তও করে।
পরে তদন্তকারী দলের পক্ষ থেকেও কাজের ‘গুণগত মান ভালো হয়নি’ জানিয়ে প্রতিবেদন দেওয়া হয়। এরপর সওজ কর্তৃপক্ষ আট কোটি টাকার বিল আটকে দেয়। অবশ্য বাকি ১২ কোটি টাকার বিল পরিশোধ করা হয়।
এ ঘটনায় দি রূপসা ইঞ্জিনিয়ার্স লিমিটেডের প্রতিনিধি রাশেদুল ইসলাম ‘চুড়ান্ত বিল দাবি করে’ ২০১৪ সালে আদালতে মামলা করেন। মামলার কারণে এ মহাসড়কের ওপর সংস্কার কাজে অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়। যার ফলে সংস্কারবিহীন অবস্থায় পড়ে থাকে এ অংশের সড়কটি।
তবে কুয়াকাটা পর্যটন এলাকায় যাতায়াতের গুরুত্বপূর্ণ সড়ক হওয়ার কারণে সওজ কর্তৃপক্ষ এ অংশে ‘দায়সারাভাবে’ জরুরি মেরামত কাজ করে থাকে বলে জানা গেছে।
সওজ বিভাগের পটুয়াখালীর নির্বাহী প্রকৌশলী মো. জামিল আক্তার লিমন বলেন, “আদালতের আদেশে ওই মহাসড়কে বড় ধরনের সংস্কার কাজ করা যায়নি। তবে উচ্চ আদালত নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করেছেন। সড়কের নির্মাণকাজের জন্য আর কোনো বাধা নেই। বৃষ্টি কমলেই রাস্তার কাজ শুরু করা হবে।”
বরিশালের কলসকাঠি ইউনিয়নের বাসিন্দা সুদেব দাস বলেন, “বরিশাল হয়ে পটুয়াখালী শহর থেকে ভালই আসছিলাম। কিন্তু শেষ পথটুকু যেন ভয়ঙ্কর বিপজ্জনক। কথায় আছে, শেষ ভাল যার সব ভাল তার। এখানে সেটার উল্টো দেখতে পাচ্ছি। সারা পথটা পাড়ি দিলাম ভালভাবে; এখানে পরিবহন হেলেদুলে চলে। মনে হয়, যেন এই রাস্তার খাদে পড়বে বাস।”
ঝালকাঠির সাইফুল ইসলাম বলছিলেন, “কুয়াকাটার কাছাকাছি এসে এমন ভোগান্তি আসলে পর্যটকদের অনুৎসাহিত করবে বা তারা মুখ ফিরিয়ে নেবেন। দ্রুত সময়ের মধ্যে এ সড়কের মেরামত কাজ করা হলে পর্যটকদের ভোগান্তি কমবে বলে আশা করছি।”
মহিপুর মৎস্য বন্দরের ব্যবসায়ী মজনু বলছিলেন, “দক্ষিণাঞ্চলের অন্যতম মাছের মোকাম মহিপুর, আলীপুর ও কুয়াকাটা। মৌসুমের সময় প্রতিদিন এখান থেকে লাখ লাখ টাকার ইলিশসহ নানা ধরনের মাছ দেশের বিভিন্ন স্থানে বাজারজাত করা হয়। কোনো কোনো সময় মাছবোঝাই ট্রাক, পিকআপ বা লরির চাকা গর্তে আটকে যায়।
“এতে সময়ের পাশাপাশি খরচও বাড়ছে। এখন এই রাস্তা স্থায়ী সংস্কার করা খুবই জরুরি।”
প্রভাব পড়েছে পর্যটনে
ট্যুর অ্যাসোসিয়েশন অব কুয়াকাটার সভাপতি রুমান ইমতিয়াজ তুষার বলেন, “দেশের অন্যতম পর্যটনকেন্দ্র কুয়াকাটায় প্রতিদিন দেশ-বিদেশ থেকেও পর্যটক আসছেন বিনোদনের জন্য। কিন্তু চলতি বর্ষা মৌসুমে পাখিমারা থেকে সাড়ে ১১ কিলোমিটার সড়ক যেভাবে কাদাপানিতে একাকার হয়ে গেছে। দেশের কোথাও মনে হয় এ রকম ভোগান্তির সড়ক নেই। পর্যটকরা বেশ ভোগান্তি পোহাচ্ছেন। এতে ব্যবসার ক্ষতি হচ্ছে।”
তিনি বলেন, “এতে কুয়াকাটার বদনাম হচ্ছে। আমরা সংগঠনের পক্ষ থেকে বেশ কয়েকবার সভা করেছি। প্রশাসনের সঙ্গেও কয়েক দফা বৈঠক হয়েছে। তারা আমাদের আশ্বস্ত করেছেন আগামী এক মাসের মধ্যে রাস্তা ঠিক হয়ে যাবে। যদি তা না হয় আমরা কঠোর কর্মসূচি দেব।”
কুয়াকাটা হোটেল মোটেল ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মোতালেব শরীফ বলেন, “পদ্মা সেতু চালু হবার পরও দেশের সেরা সেরা পরিবহনগুলো ঢুকতে পারছে না শুধু সড়ক বেহালের কারণে। পর্যটকরা দিন দিন উৎসাহ হারাচ্ছে। কয়েক বছর ধরে প্রশাসনকে তাগাদা দেওয়া হচ্ছে। তারা শুধু হবে; হচ্ছে বলতেছে। সবশেষ কুয়াকাটা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও জেলা প্রশাসক জানিয়েছেন, টেন্ডার হয়েছে, অচিরেই কাজ শুরু করা হবে। বর্ষার কারণে একটু দেরি হচ্ছে।”
যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে কক্সবাজারে এখন পর্যটকদের উপচেপড়া ভিড়; আর বেহাল সড়কের কারণে কুয়াকাটার বিনিয়োগকারীরা আস্তে আস্তে মুখ ফিরিয়ে নেওয়ার চিন্তাও করছেন বলেও মন্তব্য করেন এ ব্যবসায়ী। কুয়াকাটা বিচ ম্যানেজমেন্ট কমিটির সদস্যসচিব ও কলাপাড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. রবিউল ইসলাম বলেন, “এ ব্যাপারে সড়ক ও জনপদ বিভাগের সঙ্গে শুধু আলোচনাই না, তাদের ওপর চাপ অব্যাহত রেখেছি। তার পরিপ্রেক্ষিতে মাঝখানে যে কয়দিন বর্ষা ছিলো না, সে সময় হাজীপুর থেকে বেশ কিছু মেরামত কাজ হয়েছে। আবার বেশ কয়েকদিন বৃষ্টি হওয়ায় এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। বর্ষা শেষ হলে কাজটা যেন ত্বরান্বিত হয়, সেজন্য আমাদের চাপ অব্যাহত রেখেছি।”