“সম্প্রতি বসতবাড়ির ওপর বাঁধের মাটি ফেলায় ঠিকাদারের লোকজনের সঙ্গে স্থানীয়দের মারামারি হয়। এ নিয়ে থানায় দুপক্ষের অভিযোগের পর বাঁধের কাজ বন্ধ রয়েছে।”
Published : 11 Feb 2025, 10:18 PM
খুলনার কয়রা উপজেলার বিভিন্ন স্থানে বেড়িবাঁধ নির্মাণ ও পুনর্বাসন প্রকল্পের জন্য অধিগ্রহণ না করেই ব্যক্তিমালিকানাধীন জমিতে কাজ শুরু করছে পানি উন্নয়ন বোর্ডের ঠিকাদার। এ নিয়ে ঠিকাদার ও এলাকাবাসী মুখোমুখি অবস্থানে রয়েছেন।
এলাকাবাসীর অভিযোগ, ক্ষতিপূরণের টাকা না দিয়ে একরকম জোর করে সরিয়ে দেওয়া হচ্ছে তাদের। টাকা পাবেন কি-না তা নিয়েও শঙ্কা রয়েছে। এ নিয়ে কয়রা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) কাছে লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন তারা।
তবে পানি উন্নয়ন বোর্ড খুলনার নির্বাহী প্রকৌশলী আশরাফুল আলম বলেন, জমি অধিগ্রহণের জন্য প্রস্তাবনা দেওয়া রয়েছে। অনুমোদন হলে জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে ক্ষতিগ্রস্ত মালিকদের ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে।
পানি উন্নয়ন বোর্ড জানিয়েছে, পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের ‘পুনর্বাসন’ প্রকল্পের আওতায় এক হাজার ১৭২ কোটি ৩১ লাখ ২৫ হাজার টাকা ব্যয়ে প্রকল্পটি বাস্তবায়নে যৌথভাবে দায়িত্বে পেয়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ড খুলনা ও সাতক্ষীরা-২ বিভাগ। এ দুই বিভাগ থেকে দরপত্রের মাধ্যমে ২৫টি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান কাজের অনুমতি পেয়েছেন।
তারা সুন্দরবনের পাশে কয়রার কপোতাক্ষ ও শাকবাড়িয়া নদী তীরবর্তী প্রায় ৩২ কিলোমিটার স্থায়ী বাঁধ নির্মাণকাজ করছেন। ২০২২ সালের জানুয়ারিতে শুরু হওয়া এই প্রকল্পের মেয়াদ ছিল ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত। কিন্তু নির্ধারিত সময়ে কাজ শেষ না হওয়ায় প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে ২০২৫ সালের জুন পর্যন্ত।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, উপজেলার উত্তর বেদকাশী গ্রামের এক পাশ দিয়ে বয়ে গেছে শাকবাড়িয়া নদী, আরেক পাশে কপোতাক্ষ নদ। নদীর দুই তীরে মাটি ফেলে বেড়িবাঁধ নির্মাণের কাজ চলছে। বাঁধের পাশে বসবাসকারীদের অনেকেই তাদের ঘরবাড়ি ভেঙে নিচ্ছেন। তবে তারা জমি অধিগ্রহণের বিষয়ে কোনো তথ্য জানেন না।
কিছু স্থানে কাজ করে ফেলে রাখা হয়েছে। কিছু স্থানে বালুর বস্তা ফেলার অপেক্ষায় আছে। আবার কয়েকটি স্থানে সিসি ব্লক বানানোর কাজ চলছে।
এ বিষয়ে উত্তর বেদকাশী ইউনিয়নের সদস্য গণেশ মণ্ডল বলেন, “আমার এলাকার মতিয়ার সরদার ও রবীন্দ্রনাথ বাইনের বসতবাড়ির ওপর বাঁধের মাটি ফেলার প্রতিবাদ করায় ঠিকাদারের লোকজনের সঙ্গে কথা কাটাকাটির এক পর্যায়ে মারামারির ঘটনা ঘটে। এতে উভয় পক্ষের কয়েকজন আহত হয়ে থানায় পাল্টাপাল্টি অভিযোগ করেছেন। এরপর থেকে বেড়িবাঁধের কাজ বন্ধ রয়েছে।”
উত্তর বেদকাশী ইউনিয়নের ৮ নম্বর ওয়ার্ডের কয়েকজন জানান, বাঁধ নির্মাণের কাজ শুরু করার সময় নদীর চরের প্রায় ৫০ হাজার গাছ কেটে ফেলা হয়েছে। এসব গাছ বহু বছর ধরে ঝড়, জলোচ্ছ্বাস ও ছোট-বড় দুর্যোগে লোকালয়কে রক্ষা করত। কিন্তু বাঁধ নির্মাণের অজুহাতে গাছগুলো কেটে সাবাড় করেছে ঠিকাদারের লোকজন।
ওই এলাকার বাসিন্দা মিনারা খাতুন বলেন, “বাঁধ নির্মাণের দোহাই দিয়ে নদীর চরের গাছ কাটছিলেন ঠিকাদারের লোকজন। আমি মোবাইলে গাছ কাটার ভিডিও ধারণ করলে তারা আমাকে খারাপ ভাষায় গালাগাল দেয়।
“এর কয়েক দিন পর ইচ্ছাকৃতভাবে তারা খননযন্ত্র দিয়ে আমাদের বসতভিটার ওপরে মাটি ফেলে। আমার স্বামী প্রতিবাদ করলে তাকে মারধর করা হয়। এ ঘটনায় থানায় অভিযোগ করেছি।”
শাকবাড়িয়ার হরিহরপুর গ্রামের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক জিতেন্দ্রনাথ সরকার বলেন, ঠিকাদারের লোকজন তার এক বিঘা বিলের জমি আর বসতভিটার আট শতক জমি তছনছ করে দিয়েছেন। কিছু বলতে গেলে উল্টো হুমকি দেয় তারা।
প্রতিবাদ করায় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কাজ তত্ত্বাবধানকারী রাসেল মোল্লা কয়রা থানায় গ্রামবাসী ও শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির অভিযোগ করেছেন। এ ঘটনার প্রতিবাদে ৫ ফেব্রুয়ারি জমির মালিকরা মানববন্ধন করেছে।
উত্তর বেদকাশী এলাকায় বাঁধ নির্মাণের দায়িত্বে থাকা ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ‘মেসার্স আমিন অ্যান্ড কোম্পানির’ ব্যবস্থাপক রাসেল মোল্লা বলেন, তারা নিয়ম অনুযায়ী কাজ করছেন। কাজ করার সময় স্থানীয় কিছু মানুষ তাদের ওপর চড়াও হয়েছিল। এক পর্যায়ে তাদের লোকজনের সঙ্গে ঝগড়া বাঁধে। এতে তাদের কয়েকজন আহত হয়েছেন।
এ ঘটনায় থানায় অভিযোগ করেছেন বলে জানান তিনি।
কপোতাক্ষ ও শাকবাড়িয়া নদীতীরবর্তী বাঁধের কাজ নিয়ে সংঘর্ষের ঘটনায় দুই পক্ষের অভিযোগ পাওয়ার কথা বলেছেন কয়রা থানার ওসি মো. ইমদাদুল হক। তিনি বলেন, এ বিষয়ে তদন্ত চলছে।
ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান আমিন অ্যান্ড কোম্পানির তত্ত্বাবধায়ক আমিনুল ইসলাম বলেন, “একটি পক্ষ আমাদের ভুল বুঝিয়ে এলাকাবাসীর বিরুদ্ধে অভিযোগ দিতে উৎসাহিত করেছিল। তবে আমরা অভিযোগ তুলে নিয়েছি।
“আশা করছি, দু-এক দিনের মধ্যে বন্ধ থাকা কাজ আবার শুরু হবে। জমি অধিগ্রহণের বিষয়টি পানি উন্নয়ন বোর্ড কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে।”
পানি উন্নয়ন বোর্ড খুলনার নির্বাহী প্রকৌশলী আশরাফুল আলম বলেন, বর্ষায় বেড়িবাঁধের ঝুঁকিপূর্ণ স্থানগুলো ভেঙে পুরো এলাকা তলিয়ে যেতে পারে। এ কারণে বাঁধ নির্মাণের কাজ দ্রুত শুরু করতে হচ্ছে।
জমি অধিগ্রহণের বিষয়টি সময়সাপেক্ষ উল্লেখ করে তিনি বলেন, “বাঁধ নির্মাণের কাজে খুলনার অংশে ৩৫ একর জমি অধিগ্রহণ করতে হবে। অধিগ্রহণের জন্য প্রস্তাবনা দেওয়া হয়েছে। অনুমোদন পেলে জমি মালিকদের ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে।”
জমি অধিগ্রহণের বিষয়ে চিঠি পাওয়ার কথা বলেছেন কয়রা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) রুলী বিশ্বাস। তিনি বলেন, “অধিগ্রহণের প্রক্রিয়াটি জটিল, তবে কাজ চলমান। আবার লিখিত অভিযোগ করছেন এলাকাবাসী।”
দ্রুত সময়ের মধ্যে জমির মালিকরা ক্ষতিপূরণ পাবেন বলে আশ্বাস দেন ইউএনও রুলী বিশ্বাস।