গ্রামের ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, স্থানীয় প্রশাসনকে ‘ম্যানেজ’ করেই ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীরা ‘বালু লুটের মহোৎসব’ চালাচ্ছেন।
Published : 19 Jun 2024, 01:12 AM
নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করে কোনো ধরনের ইজারা ছাড়াই সিলেটের গোয়াইনঘাট উপজেলার পিয়াইন নদীতে ড্রেজার দিয়ে বালু উত্তোলন করায় হুমকির মধ্যে পড়েছে গ্রামের পর গ্রাম।
নদীতীর সংলগ্ন পশ্চিম জাফলং ইউনিয়নের অন্তত ছয়টি গ্রামের ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, স্থানীয় প্রশাসনকে ‘ম্যানেজ’ করেই ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীরা ‘বালু লুটের মহোৎসব’ চালাচ্ছেন। তাতে তাদের বাড়িঘর, জমি, কবরস্থান বিলীন হওয়ার পাশাপাশি পরিবেশ ও জীব-বৈচিত্র্যের ওপরও মারাত্মক প্রভাব পড়ছে।
দিন-রাত প্রশাসনের চোখের সামনে এ ঘটনা ঘটলেও ‘অজানা কারণে’ তারা নীরব রয়েছে অভিযোগ করে গ্রামের মানুষ বলছে, বালু লুটকারীরা প্রভাবশালী। লুটে বাধা দেওয়ায় উত্তোলনকারীদের সঙ্গে মারামারির ঘটনাও ঘটেছে। আহত হয়ে এক গ্রামবাসী হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন।
পশ্চিম জাফলং ইউনিয়নের ১ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি ইসলাম উদ্দিন শুক্রবার বলেন, সন্ধ্যার শুরু থাকি সকাল ৯টা পর্যন্ত শতাধিক বোমা মেশিন (স্থানীয়ভাবে তৈরি ড্রেজার) চলে নদীতে। একটার পর একটা নৌকা লাগিয়ে মেশিন চালানো হয়।
নদীর পাড়ে থাকা মানুষের বাড়িঘরের সামনে থেকে বালু নেওয়ার কারণে মারামারিও হয় জানিয়ে ১ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি ইসলাম উদ্দিন বলেন, “ডেইলি যদি গাঙও মারামারি ওয়, আমরা কিলা ইনো (এখানে) থাকতাম? ড্রেজার যে সময় চলে, গাঙ দিয়া একটা নৌকা যাইবার ক্ষমতা নাই। গাঙ ব্লক করিয়া তারা ড্রেজার চলাইন। রোগী লইয়াও যাওয়া যাইত না।”
ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের এই নেতা সাংবাদিক পরিচয় পেয়ে বলেন, “আফনারা ইগু বন্ধ করার ব্যবস্থা করইন। আমরার মাদরাসা, স্কুল ও গোরস্থানে ভাঙন ধরছে। আমারার মানুষ সব অসহায়। গাঙর বালু লুটে ত সবাই জড়িত।”
এর পেছনে কারা জড়িত জানতে চাইলে ভুক্তভোগীদের অনেকেই পশ্চিম জাফলং ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি শফিক আহমদের কথা বলেন।
তবে শফিক আহমেদ তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ ‘রাজনৈতিক উদ্দেশ্যেপ্রণোদিত’ দাবি করে বলেন, “আমি এই কাজের সঙ্গে জড়িত না। এখান থেকে থানা, ইউনিয়ন আর উপজেলার বড় নেতারা টাকা নিচ্ছেন তাদের লোক দিয়ে।”
দীর্ঘদিন ধরে ড্রেজার দিয়ে বালু উত্তোলন করা হলেও বিষয়টি এই ‘প্রথম শুনেছেন’ বলে দাবি করেন গোয়াইনঘাটের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. তৌহিদুল ইসলাম।
তিনি বলেন, “আগে না জানলেও আজ থেকে আমাদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সেখানে থাকবে। ওই জায়গাটা আমাদের ঘোষিত বালুমহাল না; ঘোষিত বালুমহাল ছাড়া কোথাও থেকে বালু উত্তোলন বা পরিবেশবিরোধী কোনো কাজ করা হলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
মেঘালয় রাজ্য থেকে নেমে আসা সুনামগঞ্জের তাহিরপুরের যাদুকাটা নদীতেও গত কয়েক বছর ধরে অবৈধভাবে ড্রেজার দিয়ে বালু ও পাথর উত্তোলন চলছে।
সরকারিভাবে যাদুকাটা নদীর কিছু অংশ বালুমহাল হিসেবে ইজারা দেওয়া হয়। কিন্তু ইজারাদাররা সরকার নির্ধারিত মহালের বাইরে গিয়ে অবাধে বালু উত্তোলন করায় সেখানে গ্রামে পর গ্রাম নদীতে বিলীন হয়ে যাওয়ার অভিযোগ রয়েছে।
যাদুকাটা নদীর মতই পিয়াইন নদীরও উৎপত্তিস্থল ভারত। আসাম রাজ্য থেকে বেরিয়ে প্রায় দেড়শ কিলোমিটারের সীমান্ত নদী পিয়াইন বাংলাদেশের সিলেট ও সুনামগঞ্জ অঞ্চলের ওপর দিয়ে ৮০ কিলোমিটারের মত প্রবাহিত হয়েছে। এই নদী দিয়েও উজান থেকে প্রচুর বালু ও পাথর আসে।
তবে যাদুকাটা নদীর মত পিয়াইন নদীতে জেলা প্রশাসনের নির্ধারিত কোনো বালুমহাল নেই। ফলে ইজারা দেওয়ারও বিষয় নেই। কিন্তু আইনের তোয়াক্কা না করে দিনেরাতে ড্রেজার চালানো হচ্ছে।
এই অবস্থায় গোয়াইনঘাট উপজেলার পশ্চিম জাফলং ইউনিয়নের গুড়াগ্রাম, উপরগ্রাম, মনরতল, বুগলকান্দি, ইসলামাবাদ, মনাইকান্দি, নোয়াগ্রাম, নালুভাগ গ্রামের লোকজন আতঙ্কের মধ্যে আছেন তাদের জায়গা-জমি নিয়ে। তারা পিয়াইন নদীর অবস্থা যাদুকাটা নদীর মত হওয়ার আশঙ্কা করছেন। জাফলং ও পিয়াইন নদী বাংলাদেশের পর্যটনকেন্দ্রগুলোর মধ্যে অন্যতম।
ঘাটে ঘাটে বাঁধা ড্রেজার
শুক্রবার সকাল সাড়ে ৯টার দিকে গোয়াইনঘাট উপজেলার হাদারপাড় বাজারের নৌকাঘাটে গিয়ে দেখা যায়, পিয়াইন নদীর এপার-ওপারে বেঁধে রাখা হয়েছে অন্তত ১৫টি নৌকা, যেগুলো ড্রেজার মেশিন হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
হাদারপাড় বাজার থেকে নৌকায় করে ভারতের মেঘালয় রাজ্যের পাহাড়ের পাদদেশে দিকে এগিয়ে গেলে নদী তীরবর্তী গ্রামগুলোতে ড্রেজারের দেখা মেলে। দিনের বেলায়ও ড্রেজার দিয়ে বালু উত্তোলন করতে দেখা যায়।
মনাইকান্দি বড় মাদ্রাসার সামনে বড় চারটি নৌকায় (বাল্কহেড) বসানো ড্রেজার দিয়ে বালু তুলতে দেখা গেছে শুক্রবার সকাল সাড়ে ১১টার দিকে। স্থানীয়রা জানান, দিনের বেলা ১০ থেকে ১৫টি ড্রেজার মেশিন দিয়ে বালু তুলে নৌকা ভরাট করা হয়।
নদীর বিভিন্ন স্থানে ভাঙনও দেখা দিয়েছে। মনাইকান্দি ও নোয়াগ্রামের কবরস্থান ভেঙে নদীতে বিলীন হচ্ছে।
ওই সময় বারকি নৌকা দিয়ে পাথর নিয়ে আসতেও দেখা গেছে। এ ছাড়া ছোট-বড় নৌকা নদীর দুই পাড়ে বাঁধা থাকতে দেখা গেছে। স্থানীয়রা বলছেন, এগুলো ভারতীয় চিনি বোঝাই নৌকা।
মূলত নদীর ওই অংশের দক্ষিণ থেকে উত্তরের দিকে ড্রেজার চালিয়ে যাচ্ছে চক্রটি।
এদিন সাংবাদিক আসার খবর পেয়ে পিয়াইন নদী তীরবর্তী গ্রামের বাসিন্দারা একসঙ্গে জড়ো হন। তারা তাদের শঙ্কার কথা তুলে ধরার পাশাপাশি কারা এই বালু লুটের সঙ্গে জড়িত তাদের নাম-পরিচয় বলেন।
ক্ষোভে ফুঁসছেন স্থানীয় বাসিন্দারা
বুগলকান্দির গ্রামের প্রবীণ ব্যক্তি হাজী মো. আলী (৭০) বলছিলেন, গত বছর ড্রেজার মেশিন দিয়ে হাদারপাড় এলাকায় বালু উত্তোলন করা হয়। এবার বুগলকান্দির গ্রামের দিকে চালানো হচ্ছে। এতে রাস্তাঘাট, মাদরাসা, স্কুল, ক্লিনিক ভাঙনের মুখে পড়েছে।
“আমাদের বাড়ির সামনের গাঁওয়ের জায়গা খেয়ে ফেলছে এবার। এক সাথে ৫০ থেকে ৬০টি নৌকা লাগিয়ে সারারাত চলে। শব্দের কারণে আশপাশের গ্রামের কারো ঘুম নাই। যে অবস্থা শুরু হয়েছে আমাদের গ্রামগুলো টিকবে না।
“নদীর পাড়ে থাকা কৃষিজমি চলে গেছে। আমাদের গরু-ছাগলের ঘাস খাওয়ানের জায়গা নেই। এই নদীর কোনো লিজ নাই, তারপরও এসব চলছে। কেউ দেখার নাই।”
বছর সত্তরের আফতাব উদ্দিনেরও একই ধরনের অভিযোগ। তিনি বলেন, “রাইত যেলা গাঙে বোমার (ড্রেজার) নৌকা লাগে দেখলে বুঝতা, ইলা চললে বাড়িঘর শেষ, আমরার কিচ্ছু থাকতায় না।”
একই কথা বলছিলেন ফখরুল ইসলাম (৫৫) ও আব্দুল মান্নান। তাদের আকুতি ছিল, এটা যেন বন্ধ হয়। না হলে এখানে সব বসতি নদীগর্ভে চলে যাবে।
বুগলকান্দির গ্রাম থেকে কিছুটা গেলেই নোয়াগ্রাম। সেটাও নদী তীরবর্তী।
সেখানে গিয়ে কথা হয় পশ্চিম জাফলং ইউনিয়নের ১ নম্বর ওয়ার্ড যুবলীগের সভাপতি সুজন মিয়ার সঙ্গে। তিনি বলছিলেন, “যা শুরু ওইছে, নিবগি সবতা। আমারার দাবি, গাঙটা (নদী) খাওয়া (ড্রেজার না চালানো) হইত না।”
একই গ্রামের আশফর মিয়া বলেন, “গাঙের দুই পারে চার ওয়ার্ডে পাঁচ হাজার বাড়ি-ঘর আছে। গাঙ (নদী) থাকি যদি বালু তুলে নেয়গি তে দুই পারের মানুষ টিকার মত কোনো অবস্থা নাই। অনুরোধ করিয়ার এই গাঙটা যেন না খাওয়া হয়। খাইলে কিন্তু আমরার অনেক ক্ষতি হইব, ঘরবাড়ি থাকত না। ইতা বন্ধ হওক।”
পাশে দাঁড়ানো মাসুক মিয়া (৬০) বলেন, “বালু নেওয়াতে আমরার অনেক ক্ষতি হইব। বাড়িঘর ভাঙি যার, গরিব মানুষ, আমরা কই যাব? গরু, বাছুর গাঙয়ের পার ঘাস খাইত, ওউ জায়গাটাও নাই। ইগু বন্ধ করলে বালা হইব আমরার।”
একই আকুতি জানান গ্রামের জলির মিয়া, মো. ডালই মিয়া, মো. নিজাম উদ্দিন, মো. আলমছ মিয়া, শওকত আলী, মো. হুসেন মিয়া, রফিক মিয়া, মো. ফরিদ মিয়া, মো. আতাউল্লাহ মিয়া, মো. আফছর মিয়া ও ওয়ার্ড মেম্বার জালাল উদ্দিন।
পশ্চিম জাফলং ইউনিয়নের ৩ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য আবুল কাদির বলেন, “প্রতিদিন সন্ধ্যা থেকে সকাল ৬টা পর্যন্ত শত শত ড্রেজার চলে। এসব দেখার কেউ নাই, পারলে কিছু করেন।”
একই ইউনিয়নের ২ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য বোরহান উদ্দিনের অভিযোগ, আশপাশের আট-দশটা গ্রামের মানুষ সমস্যায় পড়বে ড্রেজার বন্ধ না হলে।
নিজেদের বাড়িঘর চলে গেলে কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না বলে হুঁশিয়ারি দেন ৪ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য কামাল উদ্দিন।
‘ইউএনও-এসিল্যান্ড, থানা দেখে না কেন’
সেদিন যারা নদীর পাড়ে জড়ো হয়েছিলেন, তাদের একজন গোয়াইনঘাটের স্থানীয় বালু-পাথর ব্যবসায়ী মো. রিয়াজ উদ্দিন তালুকদার। তিনি বলছিলেন, “এই নদীর কোনো লিজ নাই তারপরও এসব হচ্ছে। ইউএনও, ভূমি কমিশানার ও থানা পুলিশ দেখে না কেন? দিনে-রাতে ড্রেজার দিয়ে বালু তোলা হচ্ছে।”
সবার সম্মতি ছাড়া এভাবে শত শত ড্রেজার চালানো সম্ভব নয় মন্তব্য করে এই ব্যবসায়ী বলেন, “থানার পাশেই ইউনিয়ন পরিষদের অফিস। তার সামনে নদী দিয়ে চলাচলকারী বালুর নৌকা থেকে প্রতিদিন চাঁদা তোলা হয়। জেলা পরিষদের সদস্য সুবাস, মুজিব, রাসেল, সারোয়ার এসব করাচ্ছে।”
“হাদারপাড় ছাড়াও জাফলং বাংলাবাজার এলাকায় ড্রেজার চলে। এসব বন্ধে অনেক আবেদন করেছি কোনো কাজ হয়নি। আমরা এখন আমরা আদালতে যাওয়ার চিন্তা করছি।”
বুগলকান্দির গ্রামের বুশরা বেগম (৫৫) বলেন, “আমার ভাই বাজার থেকে এসে বের হয়েছিল। কোথায় গিয়েছিল তা জানি না। পরে বুধবার রাত ১০টার দিকে আমার ভাই নদীতে গিয়ে আমাদের বাড়ির সমানে নৌকা লাগিয়ে বালু না নিতে নিষেধ করলে তাকে মারা হয়। দা দিয়ে কোপ দেওয়া হয়েছে মাথার পিছনে। আমাদের কেউ নাই, গরিব মানুষ আমরা।”
“পরে গোয়াইনঘাট হাসপাতাল থেকে সিলেট ওসমানীতে নেওয়া হয়েছে চিকিৎসার জন্য। রোগী নিয়ে ব্যস্ত থাকার কারণে মামলা করতে সময় পাচ্ছি না। মামলা করব।”
ফয়জুর রহমান নামের এক যুবক বলেন, “নদীর বালু লুটের টাকা বস্তা ভরে সবখানে যাচ্ছে, তাই সবাই চুপ ভাই। অনেকে আবার বাড়ির সামনে থাকা নদীর জায়গা বিক্রি করছেন। তবে নদীর পাড়ের এই জায়গা খাস জমি। কেমনে বিক্রি করে? এসব বন্ধ হবে না। কারণ সবাই জড়িত।”
‘প্রশাসন ও এলাকার বড় বড় লিডাররা সিস্টেম করে টাকা খাইতেছে’ বলে মনে করেন আবুল কালাম। তিনি বলেন, “এখানে তো সবাই জড়িত। প্রতিদিন ৪০০-৫০০ নৌকা যাচ্ছে।”
পশ্চিম জাফলং ইউনিয়নের ১ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য জালাল উদ্দিন বলেন, “কয়েকদিন ধরে নদীতে প্রতিদিন রাতে বোমা মেশিন চলে। আমরা গ্রামবাসী এক হয়েছি, যাতে আমাদের গ্রামের সমানে না চলে। তবে যারা চালাচ্ছেন তারা দিন দিন সামনের দিকে এগিয়ে আসতেছেন।”
স্থানীয় দুইজন জনপ্রতিনিধি ও কয়েকজন যুবকের দাবি, গোয়াইনঘাট থানার দুই পুলিশ কর্মকর্তা ও এক কনস্টেবল সরাসরি টাকা নেওয়ায় জড়িত। আর ইউনিয়ন যুবলীগের সভাপতিসহ আরও দুইজন টাকা উত্তোলন করেন।
‘প্রশাসন ব্যর্থ’, বলছেন পরিবেশকর্মীরা
চলতি বছরের ১২ জুন ‘সিলেট বিভাগে পাথরমহাল, বালুমহাল ও মাটি ব্যবস্থাপনা সহজিকরণ: অংশীজনের করণীয়’ বিষয়ে সভা হয়। সেখানে বিভিন্ন সংগঠনের পরিবেশকর্মীরাও ছিলেন।
সভায় প্রশাসনের কর্মকর্তরা সিলেটের বালু-পাথর মহালগুলো খুলে দেওয়ার জন্য মতামত দেন। আর পরিবেশকর্মীরা বলেন, সরকারি ইজারাভুক্ত বালু-পাথর মহাল সনাতন পদ্ধতিতে খুলে দিলে তাদের কোনো আপত্তি নেই।
তবে পরিবেশ ধ্বংসকারী কার্যক্রম বন্ধের দাবি জানান পরিবেশকর্মীরা।
ধরিত্রী রক্ষায় আমরা (ধরা) কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য এবং বাপা সিলেটের সাধারণ সম্পাদক আবদুল করিম চৌধুরী কিম বলেন, “অবৈধভাবে বালু-পাথর উত্তোলন বন্ধ হয়নি। যারা বালু-পাথর উত্তোলন করছেন, তারা প্রশাসনের থেকেও শাক্তিশালী। কারণ প্রশাসন অভিযানে যাওয়া আগেই তারা খবর পেয়ে যায়। না হয় বালু-পাথর উত্তোলন বন্ধে প্রশাসন ব্যর্থ। তা নাহলে এমনটি হওয়ার কথা নয়।”
তিনি বলেন, “যেসব স্থানে অবৈধভাবে বালু-পাথর উত্তোলন হয়, সেখানে ড্রোন দিয়ে ছবি-ভিডিও ধারণ করলেই সবকিছু উঠে আসবে। সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া যায়।”
বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) সিলেট বিভাগীয় সমন্বয়ক অ্যাডভোকেট শাহ সাহেদা আখতার বলেন, “অবৈধভাবে বালু-পাথর উত্তোলন বন্ধে দায়িত্বে থাকা সংশ্লিষ্টরা যথাযথভাবে দায়িত্ব পালন করছেন না। প্রশাসন চাইলে যে কোনো অবৈধ কাজ বন্ধ করতে পারে। প্রশাসন যদি ইজারা দেওয়া স্থান ছাড়া অন্য স্থান থেকে অবৈধ বালু উত্তোলন বন্ধ না করতে পারে এর থেকে লজ্জাজনক আর কিছু নেই। তাই প্রশাসনকে আরও কঠোর হতে হবে।”
প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধি যা বলছেন
সিলেটের অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার (রাজস্ব) মো. জসিম উদ্দিন বলেন, “ইজারা ছাড়া নদী থেকে কেউ বালু উত্তোলন করলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এজন্য উপজেলা প্রশাসনকে বলে দেওয়া হয়েছে।”
পিয়াইন নদীতে পরিবেশবিনাশী কার্যক্রমের বিষয়ে জানতে চাইলে পরিবেশ অধিদপ্তর সিলেটের বিভাগীয় পরিচালক এ কে এম রফিকুল ইসলাম বলেন, “এ বিষয়ে খোঁজ-খবর নিয়ে আমাদের সামর্থ্য অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
গোয়াইনঘাট উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মোহাম্মদ আসলাম বলেন, “অবৈধ কাজে জড়িতদের আওয়ামী লীগ কোনো সময় সমর্থন করে না। এ বিষয়ে আমি উপজেলা প্রশাসনের সঙ্গে কথা বলব। প্রমাণিত হলে বিরুদ্ধে দলের গঠনতন্ত্র আনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
গোয়াইনঘাট উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান শাহ আলম স্বপন বলেন, “কে বা কারা এই ড্রেজার চালাচ্ছে তা আমি জানি না। তবে কোনো ধরনের অবৈধ কাজের পক্ষে আমি না। আপনারা রিপোর্ট করেন।”
পশ্চিম জাফলং ইউনিয়ন চেয়ারম্যান মামুন পারভেজ বলেন, “আমি একটু ঝামেলায় আছি। ফ্রি হয়ে আপনাকে ফোন দিচ্ছি।”
‘আমি জড়িত না, দলে আছি তাই বলে’
বালু উত্তোলনের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগ নিয়ে প্রশ্ন করলে পশ্চিম জাফলং ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি শফিক আহমদ বলেন, “আমি এই কাজের সঙ্গে জড়িত না। আমি দলের দায়িত্বে আছি বিধায় মানুষজন নাম বলে। ড্রেজার চলে এটা আমরাও জানি। আমার গ্রামের মানুষজনের কাছে জানতে পারেন আমাদের পরিবার সম্পর্কে। আমরা মানুষের ক্ষতি করে কোনো কাজ করি না।”
ড্রেজার চালানোর বিষয়ে সিলেট জেলা পরিষদ সদস্য সুবাস দাস বলেন, “আমি ড্রেজার চালানোর সঙ্গে জড়িত না। আমার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ ইচ্ছা করে আমার নাম বলছে। আমি থাকি সিলেট শহরে, এখান থেকে আমি কীভাবে ড্রেজার চলাব? আমি এই প্রক্রিয়াতে জড়িত না। আমার বাড়িও ওই জায়গায় না।”
পিয়াইন নদী থেকে ড্রেজার দিয়ে বালু উত্তোলনের বিষয়ে থানা-পুলিশের কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই বলে দাবি করেন গোয়াইনঘাট থানার ওসি রফিকুল ইসলাম। বালু উত্তোলন নিয়ে মারামারির বিষয়ে থানায় কোনো অভিযোগ আসেনি বলেও জানান তিনি।
পুলিশের জড়িত থাকার অভিযোগের বিষয়ে বক্তব্য জানতে সিলেট জেলার পুলিশ সুপার মোহাম্মদ আবদুল্লাহ আল মামুনকে ফোন করা হলেও তিনি ধরেননি।
সিলেট জেলা পুলিশের মিডিয়া ফোকাল পয়েন্ট কর্মকর্তা (সহকারী পুলিশ সুপার) মো. সম্রাট তালুকদার বলেন, “আমি এ বিষয়ে অবগত না।”