কুমিল্লা মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষাবোর্ড থেকে পরীক্ষায় অংশ নিতে নবম শ্রেণিতে থাকা অবস্থায় রেজিস্ট্রেশন করা ৫৭ হাজারের বেশি শিক্ষার্থী এবারের এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নেয়নি।
এই শিক্ষা বোর্ডের দায়িত্বপ্রাপ্তরা বলছেন, ঝরে পড়াদের মধ্যে অধিকাংশই মেয়ে শিক্ষার্থী, সংখ্যায় ৩২ হাজারের বেশি। তারা বেশিরভাগই বাল্যবিয়ের শিকার হয়েছেন।
রেকর্ড সংখ্যক শিক্ষার্থীর ঝরে পড়ার পেছনে অল্প বয়সে বিদেশ যাওয়ার প্রবণতাকেও দুষছেন তারা। এ ছাড়া শহরের প্রতিষ্ঠানগুলোর চেয়ে গ্রামের শিক্ষার্থীরা বেশি ঝরে পড়েছে বলে জানিয়েছেন তারা।
কুমিল্লা, ফেনী, নোয়াখালী, চাঁদপুর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও লক্ষ্মীপুর জেলা নিয়ে গঠিত এই শিক্ষা বোর্ড থেকে জানা গেছে, চলতি বছরের এসএসসি পরীক্ষার অংশ নিতে কুমিল্লা বোর্ডের অধীনে মোট রেজিস্ট্রেশন করেছিলেন ২ লাখ ৩১ হাজার ২৩২ জন শিক্ষার্থী।
এর মধ্যে এ বছরের এসএসসি পরীক্ষায় বসতে ফরম পূরণ করেছেন ১ লাখ ৭৪ হাজার ৭৯ জন শিক্ষার্থী। অর্থাৎ রেজিস্ট্রেশন করেও ৫৭ হাজার ১৫৩ জন শিক্ষার্থী পরীক্ষা কার্যক্রম থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন।
অতীতে এই বোর্ড থেকে এক বছরে এতো সংখ্যক শিক্ষার্থী ঝরে পড়েনি জানিয়ে উদ্বিগ্ন হবার কথা জানিয়েছেন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক ও অভিভাবকসহ সচেতন মহল।
২০২২ সালের এসএসসি পরীক্ষার জন্য কুমিল্লা বোর্ড থেকে রেজিস্ট্রেশন করেছিলেন ২ লাখ ২০ হাজার ২৮৮ জন শিক্ষার্থী। এর মধ্যে ফরম পূরণ করেন ১ লাখ ৮৩ হাজার ৩৪৩ জন। অর্থাৎ ঝরে পড়েছিলেন ৩৬ হাজার ৯৪৫ জন পরীক্ষার্থী।
এই হিসেবে ২০২৩ সালে যেমন শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়ার সংখ্যা বেড়েছে ব্যাপক হারে; একই সঙ্গে কমেছে পরীক্ষার্থীর সংখ্যাও।
শিক্ষা বোর্ড কর্তৃপক্ষ বলছে- করোনা পরবর্তী অর্থনৈতিক অবস্থায় বদলে গেছে ছাত্র-ছাত্রীদের জীবনের গতিপথ। ছাত্রীদের বেশিরভাগই বাল্যবিয়ের শিকার হয়েছেন। আর ছাত্ররা জড়িয়ে পড়েছেন বিভিন্ন কাজে-কর্মে। অনেকে অল্প বয়সে পাড়ি জমিয়েছেন বিদেশে।
কুমিল্লা শিক্ষা বোর্ড সরকারি মডেল কলেজের অধ্যক্ষ মো. আবুল হোসেন মনে করেন- পারিবারিক উপার্জনের সীমাবদ্ধতা, পরিবারের অভিভাবকরা শিক্ষার প্রতি সচেতন না হওয়ার কারণে ঝরে পড়ার ক্ষেত্রে এই পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। আর বাল্যবিয়ের মতো সামাজিক ব্যাধি রোধ করতে ব্যর্থ হওয়ায় গ্রামের মেয়ে শিক্ষার্থীরা বেশি ঝরে পড়েছে।
বিষয়টি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে নারী সংগঠক ও কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম উপজেলা পরিষদের মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান রাশেদা আখতার বলেন, “এক বছরে এতো সংখ্যক শিক্ষার্থী ছিটকে পড়ায় আমরা উদ্বিগ্ন। আমি মনে করি বিষয়টি নিয়ে নীতিনির্ধারকদের এখনই ভাবতে হবে।
“বিশেষ করে প্রশাসন ও তৃণমূলের জনপ্রতিনিধিদের বিষয়টি নিয়ে কাজ করে অভিভাবকদের সচেতন করতে হবে। যাতে এসব শিক্ষার্থীরা আবারও তাদের শিক্ষা জীবনে ফিরে আসতে পারে।”
এ ছাড়া অভিভাবকদের বাল্যবিয়ের ক্ষতিকর দিকগুলো সম্পর্কে সচেতন করতে পারলেই মেয়েদের ঝরে পড়ার হার অনেক কমে যাবে বলে মনে করেন তিনি।
তবে কুমিল্লা শিক্ষা বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক মো. আসাদুজ্জামান জানান, করোনা মহামারির পর একটি বিষয় লক্ষ্যণীয় যে- অর্থনৈতিক সংকটের কারণে অনেক শিক্ষার্থীকেই দেখা গেছে অষ্টম শ্রেণি পাশের সনদ দিয়ে কোনো না কোনো চাকরি খুঁজছেন। যে কারণে অনেকে রেজিস্ট্রেশন করলেও পরীক্ষায় বসছে না।
“ছেলেদের ক্ষেত্রে বিদেশ চলে যাওয়ার একটা প্রবণতা আছে। আর মেয়ে শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়ার মূল কারণ হচ্ছে বাল্যবিয়ে। এ ছাড়া পারিবারিক কারণে দেশের মধ্যেই চাকরির খোঁজ করার আগ্রহ তৈরি হওয়ায় এমন হয়েছে।
তবে রেজিস্ট্রেশন করেও ফরম পূরণ না করা শিক্ষার্থীদের মধ্যে সবাই যে শিক্ষা জীবন থেকে ঝরে পড়েছে বিষয়টি এমন নয় বলে জানান তিনি।
“কারণ এর মধ্যে অনেক শিক্ষার্থী আছেন এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় স্থানান্তরিত হয়েছেন।”
কুমিল্লা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক জামাল নাছের বলেন, নবম শ্রেণিতে কিছু ছাত্র-ছাত্রী অকৃতকার্য হওয়ার কারণে তারা ফরম ফিলাপ করতে পারেনি। আবার করোনা মহামারির কারণে অনেক ছোট-ছোট ছেলেরা জীবিকার তাগিদে বিদেশে চলে গেছে আবার কেউ অটোরিকশা বা মিশুক চালাচ্ছে।