প্রবল বৃষ্টিতে উজানের ঢলে সিলেটে একের পর এক এলাকা তলিয়ে বানভাসি মানুষের সংখ্যা বাড়লেও তাদের উদ্ধারে হিমশিম খাচ্ছে প্রশাসন।
Published : 18 Jun 2022, 11:23 AM
সিলেটের জেলা প্রশাসক মো. মুজিবুর রহমান শনিবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, অনেক মানুষ পানিবন্দি, কিন্তু নৌকার অভাবে আশ্রয় কেন্দ্রে আসতে পারছে না।
“বন্যায় অনাহারে থাকা লোকজন এখন কেবল প্রাণে বাঁচতে চান। কিন্তু একটি নৌকা মেলানো তাদের কাছে এখন সোনার হরিণ।”
চলতি মৌসুমে এটা সিলেটে তৃতীয় দফা বন্যা। ভারতের মেঘালয় ও আসামে রেকর্ড বৃষ্টিপাতের কারণে এবার পরিস্থিতির আরও অবনতির শঙ্কা করা হচ্ছে।
সিলেটের বিভাগীয় কমিশনারের হিসাবে, সিলেট ও সুনামগঞ্জের ৩৫ লাখের মতো মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে।
সিলেটের বিভাগীয় কমিশনার মুহাম্মদ মোশাররফ হোসেন।
তবে উদ্ধারে নৌকা সঙ্কট নিয়ে জেলা প্রশাসকের কথার প্রতিফলন পাওয়া যায় গোয়াইনঘাট উপজেলার আলিরগাঁও এলাকার আজিজ মিয়ার কথায়।
তার ভাষ্যে, উপজেলার প্রায় শতভাগ মানুষ পানিবন্দি। কেউ ত্রাণ চায় না, প্রাণে বাঁচতে চায়। কিন্তু তাদের উদ্ধারের জন্য নৌকা পাওয়া যাচ্ছে না।
আজিজ বলছেন, এমন ভয়ানক দুর্যোগ তিনি গত কয়েক দশকে দেখেননি।
“সিলেট অঞ্চল এক খারাপ সময় পার করছে,” বলছেন জেলা প্রশাসক মজিবরও।
পানিবন্দি মানুষদের উদ্ধারে সেনাবাহিনী ও নৌবাহিনী মাঠে নেমেছে। বানভাসি মানুষকে আশ্রয় কেন্দ্রে নেওয়া হলেও সেখানে মুড়ি ছাড়া খাবার ও পানি জুটছে না বলেও অভিযোগ উঠেছে।
উজান থেকে আসা ঢলে উপকেন্দ্র এবং সঞ্চালন লাইন তলিয়ে যাওয়ায় জেলা এবং নগরীর অনেক এলাকায় বিদ্যুৎ নেই।
দুর্যোগপূণ আবহওয়ায় নেই মোবাইলের নেটওয়ার্কও। পানিবন্দি জীবনে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ায় দুর্ভোগ বেড়েছে বহু গুণ।
সিলেটের দক্ষিণ সুরমার কুচাই এলাকার কবির আহমদ বলেন, “বৈদ্যুতিক সাবস্টেশন পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় বৃহস্পতিবার রাত থেকে এলাকায় বিদ্যুৎ নেই। মোবাইল নেটওয়ার্ক এবং ইন্টারনেটও নেই।”
শহরের উঁচু উঁচু স্থান, পাহাড়ি এলাকাছাড়া অন্যান্য এলাকার ঘরবাড়িগুলোতে পানি ঢুকেছে।
বিশেষ করে টিনের ছাউনির বাড়ি এবং একতলা বাড়িঘর ডুবে যাওয়া বহু মানুষ থাকছেন এখন আশ্রয় কেন্দ্রে।
ঘর পানির নিচে থাকায় আশ্রয় কেন্দ্রে এসেছেন কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার ইসলামপুর এলাকার রমিজ উদ্দিন। মাত্র এক মাসের ব্যবধানে দুবারের বন্যায় সহায় সম্বলহীন হলেন তিনি।
আশ্রয় কেন্দ্রে উঠলেও সামান্য কিছু শুকনো খাবার ছাড়া আর কিছু জোটেনি বলে অভিযোগ করেন তিনি।
নগরীর মিরাবাজার কিশোরীমোহন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় আশ্রয়কেন্দ্রে আসা ছড়ারপাড় এলাকার বকুল মিয়া জানান, আশ্রয় কেন্দ্রে এখনও কোনো ত্রাণ তারা পাননি। এখানে রান্নার ব্যবস্থাও নেই।
সবার খাবারের কষ্ট হচ্ছে জানিয়ে ক্ষুব্ধ বকুল মিয়া বলেন, “এ অবস্থায় আমরা এখানে থেকেও কী করব? কাজ নেই, বাচ্চাদের মুখে খাবার কীভাবে তুলে দেব?”
“সবমিলিয়ে এক বিভীষিকাময় সময় পার করছি আমরা,” বলেন গোয়াইনঘাটের আজিজ মিয়া।
তাসনিম খন্দকার থাকেন নগরীর উপশহর এলাকার, সেখানে বিদ্যুৎ নেই দুদিন হল, তিনি বলেন, “এখন পানির কষ্ট বেশি ভোগাচ্ছে। বাজার থেকে বোতলজাত পানি কিনে কোনোমতে চলছে।“
উপশহরের এই বাসিন্দা জানান, মে মাসের বন্যায় তাদের এলাকায় পানি ছিল না প্রায় আট দিন। গৃহস্থালির কাজে হিমশিম খেয়েছিলেন তখন।
বিদ্যুৎ না থাকায় উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোতে সেবা কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়াও কঠিন হয়ে পড়েছে।
জেনারেটরের সাহায্যে এক্স-রে মেশিনসহ বিভিন্ন যন্ত্রপাতি চালানো সম্ভব হয় না বলে সেই সেবাগুলো রয়েছে বন্ধ।
এই অবস্থা চলতে থাকলে সেবা আরও ব্যাহত হবে বলে আশঙ্কা এই স্বাস্থ্য কর্মকর্তার।
এদিকে আগামী ২০ জুন পর্যন্ত সিলেট ও সুনামগঞ্জে ভারি বর্ষণ অব্যাহত থাকবে বলে জানিয়েছেন সিলেট আবহাওয়া অফিসের জ্যেষ্ঠ আবহাওয়াবিদ সাঈদ আহমদ চৌধুরী
সিলেট অঞ্চলের এই বন্যার মূল কারণ উজানে ভারতের আসাম ও মেঘালয়ে প্রবল বৃষ্টিপাত। গত তিন দিনে প্রায় আড়াই হাজার মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে সেখানে। কেবল চেরাপুঞ্জিতেই ২৪ ঘণ্টায় ৯৭২ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে, যা ১২২ বছরের মধ্যে তৃতীয় সর্বোচ্চ।
ওই অঞ্চলের পানি আন্তঃসীমান্ত নদী হয়ে ঢুকছে বাংলাদেশে, ফলে আগামী কয়েকদিনে সিলেট অঞ্চলে বন্যার অবনতি ঘটার শঙ্কা রয়েছে।