কক্সবাজারের উখিয়ায় রোহিঙ্গাদের একটি মাদ্রাসায় ছয় খুনের পর শরনার্থী শিবিরে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে; সেখানকার বাসিন্দাদের মধ্যে রয়েছে উদ্বেগ।
Published : 24 Oct 2021, 01:36 AM
এমন পরিস্থিতির মধ্যে হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় শনিবার রাত পৌনে ১২টার দিকে ২৫০ জনকে আসামি করে উখিয়া থানায় মামলা দায়ের হয়েছে বলে জানিয়েছেন কক্সবাজারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. রফিকুল ইসলাম।
এছাড়া ঘটনায় জড়িত সন্দেহে আইনশৃংখলা বাহিনী ১০ জনকে গ্রেপ্তার করেছে।
নিহতদের স্বজন ও প্রতিবেশীদের দাবি, শরনার্থী শিবিরের ভেতরে থাকা মাদ্রাসাটির দখল নিতে মাস দুয়েক ধরে রোহিঙ্গাদের একটি সংগঠন ‘আরসা’এর সন্ত্রাসীরা হুমকি দিচ্ছিল।
বিষয়টি পুলিশকেও জানানো হয়েছিল বলে দাবি নিহত ব্যক্তিদের বন্ধু উখিয়া ৯ নম্বর ক্যাম্পের বাসিন্দা মোহাম্মদুল হকের।
তবে আগে থেকে হুমকির বিষয়ে কোনো অভিযোগ না পাওয়ার কথা জানিয়েছেন পুলিশের উখিয়া সার্কেলের সহকারি পুলিশ সুপার (এএসপি) শাকিল আহমেদ।
শুক্রবার ভোর রাত ৪টার দিকে উখিয়া উপজেলার পালংখালী ইউনিয়নের ১৮ নম্বর ময়নারঘোনা রোহিঙ্গা ক্যাম্পের একটি মাদ্রাসায় গুলি করে ছয়জনকে হত্যা করা হয়।
নিহতরা সবাই ওই ক্যাম্পের এইচ-৫২ ব্লকের ‘দারুল উলুম নাদওয়াতুল ওলামা আল-ইসলামিয়াহ' মাদ্রাসার শিক্ষক, ছাত্র বা স্বেচ্ছাসেবক।
ছয় খুনের পর শুক্রবার থেকেই ওই ক্যাম্প এলাকার নিরাপত্তা জোরদার করা হয়। একসঙ্গে ছয় জনের হত্যাকাণ্ড নিয়ে রোহিঙ্গাদের মধ্যে উদ্বেগ রয়েছে।
ওই হত্যাকাণ্ডে নিহত ব্যক্তিদের বন্ধু উখিয়া ৯ নম্বর ক্যাম্পের বাসিন্দা মোহাম্মদুল হক জানান, মাদ্রাসাটি মূলত রোহিঙ্গাদের একটি ছোট গোষ্ঠী পরিচালনা করত।
তার দাবি আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি (আরসা) এটি তাদের দখলে নেওয়ার জন্য এ হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “হামলাকারীরা এর আগে ওই মাদ্রাসার পরিচালনা সংশ্লিষ্টদের হুমকি দিয়ে বলেছিল হয় আরসাকে সমর্থন করতে হবে, না হয় তারা কেউ ক্যাম্পে থাকতে পারবে না।
“দুই মাস আগে থেকেই হুমকি দেওয়া হচ্ছিল। কয়দিন আগে থেকে এ মাদ্রাসায় হামলা করার জন্য আরসা প্রস্তুতি নিচ্ছে বলেও কথা ছড়ায়। তখন বিষয়টি পুলিশসহ নিরাপত্তা বাহিনীকে জানানো হয়।“
মোহাম্মদুল দাবি করেন, থানাতেও তারা অভিযোগ দেন। কিন্তু প্রশাসনের কাছ থেকে তারা কোনো সহায়তা পাননি। ওই সন্ত্রাসীরা বিভিন্ন ক্যাম্পে অবস্থান করলেও তারা অজানা কারণে ধরা ছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছে।
কয়েকদিনের ব্যবধানে দুটি হত্যাকাণ্ডের পর ক্ষুব্ধ ও উদ্বিগ্ন এই রোহিঙ্গা বলেন, “তারা মুহিবুল্লাহকেও হত্যা করেছে, তার ভাইকেও মেরে ফেলার হুমকি দিয়েছে। মুহিবুল্লাহ হত্যায় সন্দেহজনকভাবে কয়েকজনকে আটক বা গ্রেপ্তার করা হয়েছে। কিন্তু রোহিঙ্গারা মনে করে যারা আসল হত্যাকারী তারা ধরা পড়েনি।“
তবে শনিবার সংবাদ সম্মেলন করে ১৪ এপিবিএন (আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন) বলেছে, তারা মুহিবুল্লাহ হত্যায় সরাসরি জড়িত চারজনকে গ্রেপ্তার করেছে। এদের মধ্যে একজন আদালতে স্বীকারোক্তি দিয়েছেন।
গ্রেপ্তারদের বরাত দিয়ে পুলিশ জানিয়েছে, মুহিবুল্লাহ খুনের দুদিন আগে একটি সভায় হত্যার পরিকল্পনা হয়। ওই সভায় ‘তথাকথিত দুর্বৃত্তদের’ শীর্ষ পর্যায়ের নেতারা মুহিবুল্লাহকে হত্যার নির্দেশ দিয়েছেন।
এই ‘তথাকথিত দুর্বৃত্ত’ বলতে পুলিশ কাদের বুঝিয়েছে সে বিষয়ে সংবাদ সম্মেলনে সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা দেওয়া হয়নি। তবে হত্যাকাণ্ডের পর থেকেই মুহিবুল্লাহর স্বজন ও সহকর্মীরা বলে আসছেন ‘আরসা’ সন্ত্রাসীরা এই হত্যায় যুক্ত।
শুক্রবার ভোরে মাদ্রাসায় নিহতদের স্বজনরাও আরসার বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলছেন। তবে বাংলাদেশে এই সংগঠনের অস্তিত্ব অস্বীকার করে আসছে পুলিশ।
আরসা মিয়ানমারের রাখাইনে রোহিঙ্গাদের সশস্ত্র সংগঠন। এ সংগঠনের নামে রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে হত্যা, হুমকি, লুট, চাঁদাবাজির অভিযোগ রয়েছে। সংগঠনটি রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের বিরুদ্ধেও কাজ করছে বলে ক্যাম্পগুলোতে প্রচারণা রয়েছে।
পুলিশ বলছে, আরসার নাম ভাঙিয়ে বিভিন্ন সময় অপরাধ করে থাকে রোহিঙ্গা দুর্বৃত্তরা।
“দুই মাস আগে থেকে এ ধরনের হুমকি দিয়ে আসছিল তারা। বিষয়টি প্রশাসনের লোকজনকে জানানো হলেও তারা মাদ্রাসা পরিচালনা করে যাওয়ার জন্য অভয় দিয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু বহস্পতিবার রাতেই হঠাৎ হামলার ঘটনা ঘটে।“
তবে পুলিশকে আগে থেকে হুমকির কোনো অভিযোগ জানানো হয়নি বলে দাবি সেখানে কর্তব্যরত কর্মকর্তাদের।
পুলিশের উখিয়া সার্কেলের সহকারি পুলিশ সুপার (এএসপি) শাকিল আহমেদ বলেন, রোহিঙ্গা ক্যাম্পে মাদ্রাসায় হামলা চালানোর ব্যাপারে পূর্ব থেকে হুমকি দেয়ার বিষয়টি নিয়ে কেউ পুলিশের কাছে অভিযোগ করেনি।
“পুলিশের কাছেও এ ধরনের হামলার ব্যাপারে আগাম কোনো তথ্য ছিল না।“
মাদ্রাসার ছাত্র-শিক্ষক ও সাধারণ রোহিঙ্গাদের উপর হামলার ব্যাপারে আগে থেকে কেউ যদি অভিযোগ জানাত তখন আইনশৃংখলা বাহিনীর নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা নেয়ারও সুযোগ থাকত বলে মন্তব্য করেন তিনি।
মামলা ও গ্রেপ্তার
এদিকে হত্যার ঘটনায় ২৫ জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাতসহ মোট ২৫০ জনকে আসামি করে শনিবার রাত পৌনে ১২টার দিকে উখিয়া থানায় মামলা দায়ের হয়েছে।
নিহত মাদ্রাসা ছাত্রদের একজন আজিজুল হকের বাবা ও উখিয়ার ১৮ নম্বর রোহিঙ্গা ক্যাম্পের এইচ-ব্লকের বাসিন্দা নূরুল ইসলাম বাদী হয়ে মামলাটি দায়ের করেন বলে জানান কক্সবাজারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. রফিকুল ইসলাম।
এদিকে ঘটনায় জড়িত সন্দেহে আইনশৃংখলা বাহিনী ১০ জনকে গ্রেপ্তার করেছে। পুলিশ ও আর্মড পুলিশসহ আইন শৃংখলা বাহিনীর সদস্যরা বিভিন্ন রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অভিযান চালিয়ে তাদের গ্রেপ্তার করে।
শনিবার রাতে কক্সবাজারের ৮ আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের কমান্ডিং অফিসার (পুলিশ সুপার) মোহাম্মদ সিহাব কায়সার খান স্বাক্ষরিত সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের গ্রেপ্তারে অভিযান চলমান রয়েছে।
ইতিমধ্যে অভিযানকালে ৮ আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের পুলিশ সদস্যরা মামলার এজাহারভুক্ত পাঁচ জনসহ হামলার সঙ্গে জড়িত সন্দেহে আরও পাঁচ জন মোট ১০ জনকে গ্রেপ্তার করেছে।
গ্রেপ্তাররা হলেন- মজিবুর রহমান (১৯), দিলদার মাবুদ ওরফে পারবেজ(৩২), মোহাম্মদ আইয়ুব (৩৭), ফেরদৌস আমিন(৪০), আব্দুল মজিদ (২৪), মোহাম্মদ আমিন(৩৫), মোহাম্মদ ইউনুস ওরফে ফয়েজ (২৫), জাফর আলম (৪৫), মোহাম্মদ জাহিদ (৪০), মোহাম্মাদ আমিন (৪৮)।
এদের মধ্যে অস্ত্রসহ গ্রেপ্তার মুজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে পুলিশ বাদী হয়ে অস্ত্র আইনে উখিয়া থানায় পৃথক মামলা দায়ের করে।