আদালতে জবানবন্দি: হত্যার আগে নুসরাতকে ‘ছাদে নিয়ে যান’ পপি

ফেনীর মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাত জাহান রাফিকে পুড়িয়ে হত্যার আগে তাকে ছাদে ডেকে নেওয়ার কথা স্বীকার করে অধ্যক্ষের ভাগ্নি উম্মে সুলতানা পপি আদালতে জবানবন্দি দিয়েছেন বলে জানিয়েছে পুলিশ।

ফেনী প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 19 April 2019, 05:15 PM
Updated : 19 April 2019, 07:33 PM

পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন-পিবিআইয়ের চট্টগ্রাম বিভাগীয় বিশেষ সুপার মোহাম্মদ ইকবাল জানান, শুক্রবার বিকেল ৪টায় পপিকে ফেনীর জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম শরাফ উদ্দিন আহম্মেদের আদালতে হাজির করা হয়।

“আদালতের কাছে দায় স্বীকার করে তিনি ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছেন। প্রায় সাড়ে ৫ ঘণ্টা পর রাত সাড়ে ৯টায় তার জবানবন্দি দেওয়া শেষ হয়।”

পিবিআই কর্মকর্তা ইকবাল বলেন, “পপি ঘটনার দিন সকালে পরীক্ষা কেন্দ্র থেকে নুসরাতকে ছাদে ডেকে নেন। পপি এ হত্যার ঘটনার সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিলেন।”

এদিকে মামলার এজাহারভুক্ত আসামি জাবেদ হোসেনকে একই বিচারক আরও তিন দিনের রিমান্ডে পাঠিয়েছেন।

সাত দিনের রিমান্ড শেষে পুলিশ তাকে আরও পাঁচ দিনের রিমান্ডে চাইলে আদালত তিন দিন মঞ্জুর করে আদেশ দেয়।

এর আগে এ মামলায় চার আসামি নুসরাত হত্যার সঙ্গে সম্পৃক্ততার কথা স্বীকার করে আদালতে জবানবন্দি দেন। তারা হলেন- মামলার এজহারভুক্ত আসামি নূর উদ্দিন, শাহাদাত হোসেন শামীম, আবদুর রহিম শরীফ ও হাফেজ আবদুল কাদের।

এদিকে নুসরাতকে পুড়িয়ে হত্যার ঘটনায় ‘সরাসরি অংশ নেওয়া’ সহপাঠী কামরুন নাহার মণিকে নিয়ে এদিন ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন পিবিআই কর্মকর্তারা।

মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ফেনীর পিবিআই পরিদর্শক মো. শাহ আলম জানান, শুক্রবার মনিকে নিয়ে পিবিআই কর্মকর্তারা মাদ্রাসা ভবনের ছাদ ও বোরকার দোকান পরিদর্শন করেন।

হত্যার ঘটনায় সরাসরি জড়িত থাকার অভিযোগে গ্রেপ্তার মনি বুধবার থেকে পাঁচ দিনের রিমান্ডে রয়েছেন।

পরিদর্শক শাহ আলম বলেন, জিজ্ঞাসাবাদে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে পিবিআইয়ের বিশেষ পুলিশ সুপার মোহাম্মদ ইকবালের নেতৃত্বে একটি দল মণিকে নিয়ে সোনাগাজী পৌরশহরের মানিক মিয়া প্লাজায় একটি বোরকার দোকানে যায়। সেখানে তারা দোকানমালিকের সঙ্গে কথা বলেন।

“পরে তারা সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল মাদ্রাসার প্রশাসনিক ভবনের ছাদের ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে। সেখানে নুসরাতকে কীভাবে কেরোসিন ঢেলে আগুন লাগিয়ে হত্যা করা হয়েছে তার বিবরণ দেন কামরুন নাহার মণি।”

মণিকে জিজ্ঞাসাবাদে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে হত্যাকাণ্ডে অংশ নেওয়া পুরুষদের ব্যবহৃত বোরকাগুলো উদ্ধারের চেষ্টা চলছে বলে তিনি জানান।

নুসরাত ছিলেন ওই মাদ্রাসার আলিম পরীক্ষার্থী। গত ৬ এপ্রিল আরবি প্রথম পত্র পরীক্ষা দিতে গেলে ছাদে ডেকে নিয়ে তার গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ১০ এপ্রিল মারা যান নুসরাত।

মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজ-উদ-দৌলার বিরুদ্ধে নুসরাতের পরিবারের দায়ের করা মামলা তুলে না নেওয়ায় অধ্যক্ষর লোকজন তার গায় আগুন দেয় বলে গ্রেপ্তারদের জবানবন্দিতে উঠে এসেছে।

সোনাগাজী উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি রুহুল আমিন

এই হত্যাকাণ্ডে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে শুক্রবার সোনাগাজী উপজেলা
আটক করেছে পিবিআই। তবে তাকে গ্রেপ্তার দেখানো হবে কি না তা এখনও নিশ্চিত করেননি কর্মকর্তারা।

নুসরাতকে পুড়িয়ে হত্যার ঘটনায় স্থানীয় রাজনীতিরও প্রভাব রয়েছে বলে এই ঘটনায় পুলিশের গাফিলতি তদন্তে গঠিত কমিটির প্রধান ডিআইজি এস এম রুহুল আমিন অভিমত দেওয়ার পরদিন স্থানীয় আওয়ামী লীগের সভাপতিকে ধরা হল।

আওয়ামী লীগ নেতা রুহুল আমিন সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল মাদ্রাসার সদ্য সাবেক ব্যবস্থাপনা কমিটির সহ-সভাপতি। ওই মাদ্রাসার ব্যবস্থাপনা কমিটি বাতিল করে আহ্বায়ক কমিটি গঠনের নির্দেশ দিয়েছে ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয়।

কমিটির সদস্যরা নুসরাত হত্যায় জড়িত থাকার অভিযোগ ওঠায় এই নির্দেশ দেওয়া হয়েছে বলে ফেনীর জেলা প্রশাসক মো. ওয়াহিদুজজামান জানিয়েছেন।

নুসরাত হত্যায় জড়িতদের বিচার দাবিতে শুক্রবারও বিভিন্ন কর্মসূচি পালিত হয়েছে। বিকালে শাহবাগে জাতীয় জাদুঘরের সামনে এক প্রতিবাদী কর্মসূচিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের অধ্যাপক মেসবাহ কামাল এ ঘটনা থেকে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগকে সাবধান হতে বলেছেন।

নুসরাতের ঘটনা তৃণমূলে আওয়ামী লীগের সঙ্গে জামায়াত নেতাদের সখ্যের প্রমাণ দেয় মন্তব্য করে তিনি বলেছেন, এই অবস্থা চলতে থাকলে ‘মুক্তিযুদ্ধের স্লোগান’ দিয়ে জনরোষ থেকে শেষ রক্ষা হবে না।

অধ্যাপক মেসবাহ কামাল বলেন, “ফেনীর ঘটনায় আমরা দেখতে পাই, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সাথে অপরাধী প্রিন্সিপাল সিরাজের যে সখ্য তা প্রমাণ করে, আওয়ামী লীগের সাথে জামাতের তৃণমূলের একটা বড় অংশের সখ্য তৈরি হয়েছে। আমার মনে হচ্ছে জাহাঙ্গীরনগরে যেমন আওয়ামী লীগের নেতারা শত ধর্ষণ উপভোগ করেছে ঠিক তেমনি স্থানীয় নেতারাও এই সকল কাজে প্রশ্রয় দেওয়া শুরু করেছে।

“মুক্তিযুদ্ধের শক্তির কাছ থেকে আমরা এই ভূমিকা প্রত্যাশা করি না। এই অবস্থা যদি চলতে থাকে তাহলে মুক্তিযুদ্ধের স্লোগান দিয়ে জনরোষকে দাবিয়ে রাখতে পারবেন না। জনগণ তার নিজের পথ খুঁজে নেবে।”