নুসরাতের ঘটনা আ. লীগ-জামায়াতের সখ্যের প্রমাণ: মেসবাহ কামাল

নুসরাত জাহান রাফির মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজ-উদ-দৌলার সঙ্গে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের সম্পর্ক তৃণমূলে আওয়ামী লীগের সঙ্গে জামায়াত নেতাদের সখ্যের প্রমাণ দেয় বলে মনে করছেন অধ্যাপক মেসবাহ কামাল।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 19 April 2019, 06:18 PM
Updated : 19 April 2019, 06:57 PM

এই অবস্থা চলতে থাকলে ‘মুক্তিযুদ্ধের স্লোগান’ দিয়ে জনরোষ থেকে শেষ রক্ষা হবে না বলে সতর্ক করেছেন ঢাকা বিশ্বিবদ্যালয়ের ইতিহাসের এই অধ্যাপক।

নুসরাতের হত্যাকারীদের বিচার দাবিতে শুক্রবার শাহবাগে প্রতিবাদী কর্মসূচিতে অংশ নিয়ে একথা বলেন তিনি।

মেসবাহ কামাল বলেন, “ধর্মের নামে নারীকে নিগৃহীত করা তো পুরনো ব্যাপার। আজকে তার সাথে যখন রাজনৈতিক ক্ষমতার যোগ হয় তখন তা অদম্য হয়ে উঠছে। ফেনীর ঘটনায় আমরা দেখতে পাই, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সাথে অপরাধী প্রিন্সিপাল সিরাজের যে সখ্য তা প্রমাণ করে, আওয়ামী লীগের সাথে জামাতের তৃণমূলের একটা বড় অংশের সখ্য তৈরি হয়েছে।

“আমার মনে হচ্ছে জাহাঙ্গীরনগরে যেমন আওয়ামী লীগের নেতারা শত ধর্ষণ উপভোগ করেছে ঠিক তেমনি স্থানীয় নেতারাও এই সকল কাজে প্রশ্রয় দেওয়া শুরু করেছে।”

অধ্যাপক মেসবাহ কামাল

এসব ঠেকাতে এখনই মনোযোগী হওয়ার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, “মুক্তিযুদ্ধের শক্তির কাছ থেকে আমরা এই ভূমিকা প্রত্যাশা করি না। এই অবস্থা যদি চলতে থাকে তাহলে মুক্তিযুদ্ধের স্লোগান দিয়ে জনরোষকে দাবিয়ে রাখতে পারবেন না। জনগণ তার নিজের পথ খুঁজে নেবে।”

ফেনীর সোনাগাজী উপজেলার ইসলামিয়া ফাজিল ডিগ্রি মাদ্রাসার ছাত্রী ছিলেন নুসরাত। তাকে যৌন নিপীড়নের মামলায় গ্রেপ্তার হন ওই মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজ। মামলা তুলে না নেওয়ায় ৬ এপ্রিল মাদ্রাসায় আলিম পরীক্ষার হল থেকে ছাদে ডেকে নিয়ে নুসরাতের গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। পাঁচ দিন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মৃত্যুর সঙ্গে লড়ে হার মানেন নুসরাত।

এ হত্যাকাণ্ডে জড়িত অভিযোগে মাদ্রাসার কয়েকজন ছাত্র-ছাত্রীর সঙ্গে সোনাগাজী পৌর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মাকসুদ আলমকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। শুক্রবারই আটক করা হয়েছে সোনাগাজী উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি রুহুল আমিনকে।

এই ঘটনায় পুলিশের গাফিলতি তদন্তে গঠিত কমিটির প্রধান ডিআইজি এস এম রুহুল আমিন বলেছেন, নুসরাত হত্যাকাণ্ডে স্থানীয় রাজনীতিরও প্রভাব রয়েছে।

দুই দিন সোনাগাজী ঘুরে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে এই পুলিশ কর্মকর্তা বৃহস্পতিবার বিকালে ফেনীতে সাংবাদিকদের বলেন, “অধ্যক্ষের অনেক খারাপ হিস্ট্রি রয়েছে, যা গভর্নিং বডির সদস্যরাও জানত। যদি তার ব্যাপারে আগে ব্যবস্থ্যা নেওয়া হত, তাহলে আজকে এধরনের ঘটনা ঘটত না।”

নুসরাত জাহান রাফির হত্যাকারীদের শাস্তি দাবি শুক্রবার জাতীয় জাদুঘরের সামনে মানববন্ধন করে কয়েকটি সংগঠন।

গত বছরের ৩ অক্টোবর আরেক ছাত্রীকে যৌন নিপীড়নের অভিযোগ উঠেছিল অধ্যক্ষ সিরাজের বিরুদ্ধে, যা চাপা পড়ে গিয়েছিল। ১৯৯৬ সালে এক ছাত্রকে বলাৎকারের অভিযোগ ওঠার পর ফেনী সদরের দৌলতপুর সালামতিয়া দাখিল মাদ্রাসা থেকে বহিষ্কার করা হয়েছিল তাকে।

জামায়াতের রোকন হিসেবে নাশকতার তিনটি মামলায় ২০১৪ সালে কিছু দিন কারাগারেও ছিলেন সিরাজ। ২০১৬ সালে তাকে দল থেকে বহিষ্কার করে জামায়াত।

এরপর অধ্যক্ষ সিরাজ মাদ্রাসাকেন্দ্রিক তার অনিয়ম চালিয়ে যেতে আওয়ামী লীগের নেতাদের সঙ্গে সখ্য গড়ে তোলেন বলে স্থানীয়দের ভাষ্য। উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি রুহুল আমিনকে মাদ্রাসা কমিটিতেও ঢোকানো হয় এই প্রক্রিয়ায়।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মাদ্রাসার কয়েকজন শিক্ষক বলেন, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতাদের সঙ্গে নিয়ে থাকার কারণে অধ্যক্ষ সিরাজের বিরুদ্ধে কোনো কথা বলা যেত না।

নুসরাতকে যৌন নিপীড়নের মামলায় অধ্যক্ষ সিরাজের বিচার দাবিতে সোনাগাজীতে যে কর্মসূচি পালিত হয় তাতে পৌর কাউন্সিলর আওয়ামী লীগ নেতা মাকসুদ আলম মদদ জোগান বলে অভিযোগ উঠেছে।

অপরদিকে সিরাজের শাস্তি দাবিতে কর্মসূচিতে সমর্থন ছিল আরেক ওয়ার্ড কাউন্সিলর ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক শেখ আবদুল হালিম মামুনের।

এদিকে ইঙ্গিত করে ডিআইজি রুহুল বলেন, “নুসরাতের ঘটনার সাথে স্থানীয় রাজনীতির বিষয়ও জড়িত রয়েছে। একই দলের দুইজন কাউন্সিলর অধ্যক্ষের পক্ষে-বিপক্ষে মানববন্ধন করেছে।”

এই ঘটনায় সোনাগাজী পুলিশের ভূমিকারও কঠোর সমালোচনা করেন অধ্যাপক মেসবাহ কামাল।

তিনি বলেন, “আমাদের আইন পুরোপুরি ধর্ষকদের পক্ষে কাজ করছে। আইন প্রণয়নের দায়িত্বে এবং আইন বাস্তবায়নের দায়িত্বে যারা আছে তাদের অবস্থা দেখে মনে হয়, তাদের বাড়িতে কোনো নারী নাই, তাদের কোনো মা- বোন নাই। তারা কোনো মায়ের গর্ভে জন্মগ্রহণ করেনি, তাদের কোনো স্ত্রী নাই।

“তারা ভুলে যান, তাদের মা বোন স্ত্রীও একই রকম পরিস্থিতির শিকার হতে পারে।”

শাহবাগের জাতীয় জাদুঘরের সামনে এই কর্মসূচিতে বক্তব্যে সাংবাদিক আলিশা প্রধান বলেন, “বাংলাদেশে নুসরাতের মতো আরও যত নারী ধর্ষিত হচ্ছে, খুন ও নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন সে সবের কোনো বিচার হয়নি।

“ধর্ষক-নিপীড়কদের মুখোশ উন্মোচন করতে হবে। কারণ প্রতিবাদ করা ছাড়া বেঁচে থাকার আর কোনো উপায় নাই। তা যদি না পারি তবে নুসরাতের মতো ঘটনা আরও ঘটতে থাকবে। নারীর জীবন আজকে ভয়াবহ এক বিপদের মুখে এসে দাঁড়িয়েছে। সমাজের যে কোন স্তরের নারীর সত্যিকার অর্থে কোন নিরাপত্তা নাই।”

কর্মসূচির আয়োজক যৌন নিপীড়নবিরোধী শিক্ষার্থী জোটের আহ্বায়ক শিবলী হাসান বলেন, “ফেনী জেলা পুলিশ সুপার (এসপি) জাহাঙ্গীর আলম ওসি মোয়াজ্জেমকে রক্ষায় পুলিশ সদর দপ্তরে একটি চিঠি দিয়েছেন, যেখানে নুসরাতের পরিবারকে দোষারোপ করা হয়েছে। এসপি ওসিকে বাঁচানোর জন্য যে চিঠি দিয়েছেন, তা অত্যন্ত ন্যক্কারজনক।

“এটা স্পষ্ট যে, এ হত্যাকাণ্ডটি অনেক সুপরিকল্পিত এবং অনেক অপরাধীকে বাঁচানোর চেষ্টা এখনও চলছে। এখন পর্যন্ত উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি রুহুল আমিন, ওসি মোয়াজ্জেমসহ অনেক অপরাধীকে গ্রেপ্তর করা হয়নি।”

সব অপরাধীকে গ্রেপ্তারের দাবিতে ‘শিগগিরই’ যৌন নিপীড়নবিরোধী শিক্ষার্থী জোটের পক্ষ থেকে ঢাকা-সেনাগাজী রোড মার্চ কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে বলে জানান তিনি।

সমাবেশে অন্যদের মধ্যে পুর্নিমা ফাউন্ডেশনের সভাপতি পুর্নিমা রানী শীল, সংস্কৃতি কর্মী সানজিদা গাজী, নাশিদ কামাল, নারী উদ্যোগতা আইরিন রাব্বানী বক্তব্য রাখেন।