“লাই-হরাউবা নৃত্যে পৃথিবীর সৃষ্টিতত্ত্ব থেকে শুরু করে গৃহায়ন, শস্যবপন, জন্ম-মৃত্যুসহ সবকিছুই নৃত্য ও সংগীতের সুর লহরিতে ঝংকৃত হয়।”
Published : 25 Apr 2025, 05:12 PM
মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলায় মণিপুরী মৈতৈ সম্প্রদায় মেতেছে প্রাচীন উৎসবে। সমবেত সাংস্কৃতিক পরিবেশনার মাধ্যমে স্রষ্টার উপাসনা করা এই উৎসব পরিচিত ‘লাই-হরাউবা’ নামে।
ধর্মীয় আচার ও লোকজ সাংস্কৃতিক পরিবেশনার মধ্য দিয়ে বুধবার বিকালে কমলগঞ্জের তেঁতইগাঁও গ্রামের মণিপুরী কালচারাল কমপ্লেক্স প্রাঙ্গণে শুরু হয় তিনদিনের এ উৎসব। চলবে ২৫ এপ্রিল রাত পর্যন্ত।
‘লাই হরাউবা স্টিয়ারিং’ কমিটির আয়োজনে এ উৎসবে মণিপুরী ধর্ম ও সংস্কৃতির গুরুত্বপূর্ণ সব উপাদান তুলে ধরা হচ্ছে। অংশ নিচ্ছেন ভারতের মণিপুর রাজ্য থেকে আসা পুরোহিত, নৃত্যশিল্পী, গবেষক, সাংস্কৃতিক কর্মী এবং বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর, ইউনেস্কো ও নানা সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিরা।
লাই হরাউবা উৎসব উদযাপন কমিটির আহ্বায়ক ইবুংহাল সিংহ বলেন, কর্মসূচিতে থাকছে ঐতিহ্যবাহী মাইবীদের ধর্মীয় বাণী, লোকগীতি, লোকনৃত্য এবং নানা আচার-অনুষ্ঠান। এই উৎসব মূলত সনামহী ধর্মের দেবতাদের সম্মান জানাতে উদযাপিত হয়, যা মৈতৈ সংস্কৃতির গভীর ঐতিহ্য বহন করে। এই অনুষ্ঠানে ভারতের মণিপুরের পুরোহিত, নৃত্যশিল্পী, সাংস্কৃতিক সংগঠক, গবেষক বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরের প্রতিনিধি ও ইউনেস্কোর প্রতিনিধি অংশ নিচ্ছেন।
সদস্য সচিব ওইনাম লানথই বলেন, “মণিপুরী সমাজে প্রচলিত অন্যতম প্রাচীন লোকনৃত্য অনুষ্ঠান 'লাই হরাউবা জাগোই' থেকেই এসেছে এই 'লাই-হরাউবা উৎসব'। লাই শব্দের অর্থ ইশ্বর, হরাউবা অর্থ আনন্দ এবং জাগোই অর্থ নৃত্য। অর্থাৎ নাচ-গানের মাধ্যমে ঈশ্বরকে আনন্দ দান করা। এই উৎসবে প্রদর্শিত নৃত্য মণিপুরী নৃত্যশৈলীর একটি সুপ্রাচীন নৃত্যধারা।”
তিনি বলেন, “লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, এই নৃত্যে প্রকৃতি পূজার পরিচয় মেলে। এর ইতিহাস এরকম-সৃষ্টিকর্তা যখন পৃথিবীতে জড় ও জীব সৃষ্টি করলেন এবং পরবর্তীকালে স্রষ্টার মূর্তির অনুকরণে মনুষ্য সৃষ্টিতে সফলতা পেলেন, তখন দেবদেবীগণ আনন্দে যে নৃত্য প্রকাশ করেছিলেন তারই নাম লাই-হরাউবা নৃত্য।
“তাই লাই-হরাউবা নৃত্যে পৃথিবীর সৃষ্টিতত্ত্ব থেকে শুরু করে গৃহায়ন, শস্যবপন, জন্ম-মৃত্যু সবকিছুই নৃত্য ও সঙ্গীতের সুর লহরিতে ঝংকৃত হয়। এ নৃত্যের আঙ্গিক অংশগুলো যেমন লৈশেম জাগোই (সৃষ্টিনৃত্য), লৈতা জাগোই (গৃহায়ন নৃত্য) লৈসা জাগোই (কুমারী নৃত্য) প্রভৃতি মণিপুরী সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে লোক সংস্কৃতি হিসেবে প্রদর্শিত হয়।”
‘লাই হরাউবা স্টিয়ারিং’ কমিটির সদস্য রবি সিংহ বলেন, “সৃষ্টিলগ্ন থেকে ছয় ধরনের লাই-হরাউবা উৎসব উদযাপন হয়ে থাকলেও বর্তমানে লাই-হরাউবা নৃত্য দুই ভাবধারায় পরিবেশিত হয়ে আসছে। এই ভাবধারা দুটি হলো মৈরাঙ লাই-হরাউবা ও উমঙ লাই-হরাউবা। এই দুটি ধারাতেই পরিবশিত হয় নানা ধরনের কাহিনী নির্ভর নৃত্যগীত।
“এই নাচে তাণ্ডব ও লাস্য উভয় ধারাই ব্যবহৃত হয়। এই নৃত্য শৈব নৃত্যধারার হলেও, এতে পরবর্তী সময়ে রাসনৃত্যের ভঙ্গীপারেঙ’র প্রভাব পড়ে ব্যাপকভাবে। এই নৃত্যধারার সঙ্গে জড়িত আছে, মণিপুরের সনাতন ধর্মে বর্ণিত সৃষ্টিতত্ত্ব।”
মণিপুরী মৈতৈ সম্প্রদায়ের প্রবীণ নেতা সনাতন হামোম বলছিলেন, “মণিপুরের লোক পুরাণ মতে- নয়জন লাইবুঙথ (দেবতা) এবং সাতজন লাইনুরা (দেবী) পৃথিবী সৃষ্টি করেছিলেন। আদিতে পৃথিবী জলমগ্ন ছিল, আর সেই জলের ওপর সাতজন লাইনুরা নৃত্য করছিলেন। এই দৃশ্য দেখে নয়জন লাইবুঙথ স্বর্গ থেকে লাইনুরাদের লক্ষ্য করে মাটি নিক্ষেপ করতে থাকেন। নৃত্যরত সাতজন লাইনুরা সেই ছুঁয়ে দেওয়া মাটির ওপর নেচে নেচে পৃথিবীর স্থলভাগ তৈরি করেন। এই ভাবনা থেকে লাই-হরাউবা নৃত্যের সূচনা হয়। এই নৃত্যে অংশগ্রহণ করেন মাইবা, মাইবীসহ তার অনুসারীরা।”
তিনি বলেন, ইউনেস্কো বাংলাদেশের অর্থায়নে এ আয়োজনে সহযোগিতা করছে বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর, আইজিসিসি, পোরৈ অপোকপা মরুপ ধর্মীয় সাংস্কৃতিক সংস্থা, কনসোর্টিয়াম অফ ইনট্যাঞ্জিবল কালচারাল হেরিটেজ অব বাংলাদেশ’ (সিআইবি) ও সাধনা - এ সেন্টার ফর অ্যাডভান্সমেন্ট অফ সাউথ এশিয়ান কালচার।