তাপ বাড়াতে বেশি লাকড়ি ব্যবহার করলে উৎপাদন খরচ বেড়ে যায়। সে ক্ষেত্রে দাম বেশি হলে ক্রেতাদের কাছেও চাহিদা হারায় মৃৎপণ্য।
Published : 13 Apr 2025, 01:22 PM
দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে বিদেশেও চাহিদা আছে কুমিল্লার বিজয়পুর মৃৎশিল্প কেন্দ্রের পণ্যের। সম্প্রতি এখানকার মাটির পাত্র সরাসরি রপ্তানি হয়েছে সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়ায়। তবে আরও রপ্তানির সুযোগ থাকলেও তা থমকে গেছে গ্যাসের সংকটে। অভিজ্ঞ ও দক্ষ জনবল থাকা সত্ত্বেও ধুঁকছে এ শিল্প প্রতিষ্ঠানটি।
রুদ্রপাল সমবায় সমিতির মাধ্যমে পরিচালিত প্রতিষ্ঠানটির সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, শিল্পের গ্যাস অনিয়ম করে দেওয়া হয়েছে আবাসিকে। যে কারণে পর্যাপ্ত চাপ না থাকায় প্রয়োজনীয় উত্তাপে পোড়ানো যায় না রপ্তানিযোগ্য মাটির পণ্য।
অন্যদিকে অভিযোগ সঠিক নয় জানিয়ে বাখরাবাদ গ্যাস সিস্টেমস লিমিটেড বলছে, পর্যাপ্ত গ্যাস পেতে তাদের ভিন্ন সংযোগের আবেদন করা উচিত।
আদিকাল থেকেই কুমিল্লা সদর দক্ষিণ উপজেলার বিজয়পুর গ্রামে পাল সম্প্রদায় মাটির তৈরি বিভিন্ন তৈজসপত্র তৈরির কাজ করতেন। গ্রামের প্রতিটি ঘরেই তৈরি হতো মাটির পণ্য। কালের বিবর্তনে সেটি কমে আসে।
শিল্প রক্ষাটি গ্রামেই যারা মাটির পণ্য তৈরি করা কুমোর যুবকদের প্রগতিসংঘ নামে একটি সংগঠন ছিল। যারা গ্রামে উৎপাদিত মাটির পণ্য একত্রিত করে বিক্রয় করতেন।
পরবর্তীতে ১৯৬১ সালে বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন একাডেমি বোর্ডের প্রতিষ্ঠাতা ড. আখতার হামিদ খানের সহযোগিতায় প্রগতি সংঘ রূপ পায় ‘রুদ্রপাল মৃৎশিল্প সমবায় সমিতি’তে।
এই সমিতির ২৪৫ জন সদস্যের পণ্য তৈরিতে সহযোগিতা করতেই গড়ে ওঠে বিজয়পুর মৃৎশিল্প কেন্দ্র।
বিজয়পুর মৃৎশিল্প কেন্দ্রে গিয়ে জানা গেছে, আগেও বিচ্ছিন্নভাবে বিজয়পুর থেকে মাটির তৈরি ফুলের টব, মটকা, তৈজসপত্র, টেরাকোটা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের হয়ে বিদেশে রপ্তানি হলেও সাম্প্রতিক সময়ে সরাসরি মাটির পাত্র রপ্তানি হয়েছে সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়ায়।
ধাপে ধাপে আধুনিকায়নের ছোঁয়ায় ২০০৯ সালের দিকে মৃৎশিল্প কেন্দ্রে বসানো হয় ফার্নেস চুল্লি। যেখান থেকে অধিক তাপে মাটির পণ্য পুড়িয়ে রপ্তানিযোগ্য করে তৈরি করা হত। কিন্তু বর্তমানে গ্যাস সংকটার কারণে বন্ধ রয়েছে সে চুল্লি।
বিজয়পুর মৃৎশিল্প কেন্দ্রে পরিচালনার দায়িত্বে থাকা রুদ্রপাল মৃৎশিল্প সমিতির সভাপতি দ্বীপক চন্দ্র পাল বলেন, এই শিল্পকেন্দ্র থেকে মাসে গড়ে ৮ লাখ টাকার মৃৎপণ্য দেশীয় বাজারে বিক্রি হয়। যদি রপ্তানির চাহিদা থাকে তাহলে তা আরও বেড়ে যায়।
সর্বশেষ দইয়ের পাতিল ও মটকার যে দুটি চালান সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়ায় গিয়েছে তার পরিমাণ ছিল দশ লক্ষ টাকার।
তিনি জানান, বর্তমানে লাকড়ি ব্যবহার করে দুইটি চুলায় পণ্য পোড়ানোর কাজ চলছে। কিন্তু লাকড়ির চুলায় মাটির পণ্য পোড়াতে সময় লাগে বেশি, এছাড়া পর্যাপ্ত তাপ না থাকলে পণ্যের গুণগতমান বাড়ে না। তাপ বাড়াতে বেশি লাকড়ি ব্যবহার করলে উৎপাদন খরচ বেড়ে যায়। সে ক্ষেত্রে দাম বেশি হলে ক্রেতাদের কাছেও চাহিদা হারায় মৃৎপণ্য।
অধিকাংশ কর্মী নারী
সম্প্রতি বিজয়পুর মৃৎশিল্প কেন্দ্র ঘুরে দেখা, মাটির তৈরি বিভিন্ন পণ্য তৈরি করতে স্তূপ থেকে মাটি কেটে কেটে দিচ্ছেন পুরুষ কর্মীরা। এরপরই তা আকৃতি দেয়ার জন্য যে গলা তৈরি করতে হয় তা করছেন নারীরাই।
এরপর ছাঁচে বসিয়ে পাত্র তৈরি, সেটি করতেও মেশিনে কাজ করছেন অন্তত দশজন নারী। এছাড়া ফুলের টব, তেজপত্র এবং ট্যারাকোটায় যে শিল্পকর্ম করতে হয় তাতেও হাত লাগাচ্ছেন তারা।
কাঁচা মাটির পণ্য তৈরি শেষ হলে তারপর দিতে হয় রোদে, সে কাজেও নারীদের দৌড় ঝাপ দেখা গেছে সবচেয়ে বেশি। শুকনো মাটির পণ্য লাকড়ির যে চুল্লি সেখানে নিয়ে আসা এবং আগুন দেয়ার কাজেও তাদের সমান অংশগ্রহণ।
পোড়ামাটির তৈরি পণ্য প্যাকেজিংয়ের জন্য কাজ করছে নারী কর্মী, বিক্রয় কেন্দ্রের দায়িত্বে আছেন দুইজন নারী।
সবমিলিয়ে পুরো মিৎশিল্প কেন্দ্রের ৬০ শতাংশ কাজই হয়ে থাকে নারীদের হাতে। তাদের বেশিরভাগেরই বাড়ি স্থানীয় বিজয়পুর গ্রামে।
শিল্পপল্লীর কর্মী পার্বতী রানী পাল বলেন, ৯ বছর আগে ৩ হাজার টাকা বেতনে কাজ শুরু করি। এখন বেড়ে ৯ হাজার ৩শ টাকা বেতন। ৮ ঘণ্টার কাজ। খাবার নিজের খরচে। এখানে সর্বোচ্চ বেতন ১৫ হাজার টাকা।
পার্বতী পাল আরও বলেন, বিজয়পুর মৃৎশিল্প কেন্দ্রে এখন যে ৫০ জন কর্মী কাজ করে তার মধ্যে ৩০ জনই নারী। এখানে ৮০ শতাংশ কাজ নারীরাই করে। টেরাকোটা থেকে শুরু করে দইয়ের পাতিল সবই বানানো হয় এখানে। আমাদের হাতে বানানো জিনিস এখন বিদেশে রপ্তানি হয় এটা ভাবতেই ভালো লাগে।
বংশপরম্পরায় কাজ করছেন দক্ষ কর্মীরা
প্রতিষ্ঠানটির সবচেয়ে প্রবীণ কর্মী হরে কৃষ্ণ পাল বলেন, “যারাই এখন কাজ করছেন অনেকেই বংশ-পরম্পরার মায়ায় কাজ করছেন। এখানে আমি আছি ৪০ বছর। পারিবারিকভাবে শিখে মাটির পণ্যে বিভিন্ন আকৃতি দেয়া এবং প্রতিকৃতি তৈরি করাই আমার কাজ।”
“কেউ আবার শুধুমাত্র পেটের দায়ে কাজ করছে। কিন্তু এখানে পাল সম্প্রদায়ের সবচেয়ে দক্ষ কর্মীরা রয়েছে তাদেরকে কাজে লাগিয়ে উন্নতমানের মৃৎ শিল্প কেন্দ্র তৈরি করা সম্ভব।”
মৃৎশিল্প পল্লীর কর্মী রাখী পাল বলেন, “শ্বশুর বাড়ি এসে বংশপরম্পরায় এ কাজে এসেছি। ৮ বছর ধরে চাকা ঘুরিয়ে মাটির দলা থেকে ফুলের টব, পাতিল, থালা বাসন বানিয়ে আসছি। পুতুলসহ নানান খেলনাও বানাতে পারি।”
তিনি বলেন, “আগে বাড়িতে কাজ হত, এখন আর হয় না। তাই কারখানায় এসেছি। বাবার বাড়ি থেকে কিছুই শেখা হয়নি, দেখে দেখে সব শেখা।”
বিক্রয়কর্মী লতা মজুমদার বলেন, “এখন সবচেয়ে বেশি বিক্রি হয় দইয়ের পাতিল ও খাবারের পাত্র। এছাড়া শৌখিন তৈজসপত্র, ফুলের টব, টেরাকোটা, খেলনা সামগ্রীও বিক্রি হয়।
“মানুষ খুবই কম দামে ৩০ টাকা থেকে শুরু করে আড়াই থেকে তিন হাজার টাকা দামের বিভিন্ন পণ্য এখান থেকে সংগ্রহ করতে পারে, যা বাইরে থেকে কিনতে গেলে কয়েকগুণ বেশি দামে কেনা লাগে।”
আক্ষেপ করে লতা মজুমদার বলেন, “আমাদের কর্মীদের যা প্রাপ্য বেতন আমরা আসলে তা পাই না। উৎপাদন না হলে আয় বাড়বে না বেতনও হবে না এটাই স্বাভাবিক বলে মেনে নিয়েছি।”
মৃৎশিল্প কেন্দ্রের কর্মীরা জানালেন, পর্যাপ্ত জ্বালানি গ্যাস না থাকার কারণে বছরের পর বছর উৎপাদনের হার কমে আসছে। সবার দাবি, এই মৃৎশিল্প কেন্দ্রটি গ্যাস সঞ্চালন লাইন সচল করে দেয়া হোক খুব শিগগিরই। এতে যেমন বিদেশে রপ্তানিযোগ্য পণ্য তৈরি সম্ভব হবে তেমনি প্রাণ চাঞ্চল্য বাড়বে কর্মীদের মাঝেও।
তিনটি গ্যাসের চুল্লীই বন্ধ
রুদ্রপাল মৃৎশিল্প সমিতির হিসাবরক্ষক রাজেশ চক্রবর্তী বলেন, “আমাদের পণ্য দেশের বাইরে বিদেশে ভালো চাহিদা আছে। তবে গ্যাস সংকটের কারণে উন্নত মানের পণ্য তৈরি না করতে না পারায় আমরা চাহিদামত জিনিসপত্র দিতে পারছি না। সাম্প্রতিক সময়েও আমরা মালয়েশিয়া এবং সিঙ্গাপুরে দইয়ের পাত্র রপ্তানি করেছি।”
“আমরা ২০১৯ সাল থেকেই গ্যাস পাই না। তাই তিনটি গ্যাসের চুল্লীই বন্ধ রয়েছে। এখন লাকড়ি দিয়ে পোড়ানো হয় মাটির পণ্য। এতে পণ্য উৎপাদনের খরচ বাড়ে।”
রুদ্রপাল মৃৎশিল্প সমিতির সভাপতি দ্বীপক চন্দ্র পাল বলেন, “১৯৬১ সালের প্রতিষ্ঠানটির শুরু। চাহিদার সাথে যোগানের ভরসাম্য রাখতে ১৯৯১ সালে গ্যাস সংযোগ দেয়া হয়। সেসময় উৎপাদনও ভালো ছিলো।
“তবে বিগত দুই দশক ধরে বাখরাবাদ গ্যাস সিস্টেমস্ লিমিটেড এই শিল্প প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব সংযোগ থেকে অনিয়ম করে দুই হাজারের বেশি আবাসিক সংযোগ দেয়। আর এতেই শুরু হয় বিপত্তি “
তিনি বলেন, “গ্যাস কম আসায় বন্ধ হয়ে গেছে তিনটি চুল্লী। লাকড়ি দিয়ে মাটির পণ্য পোড়াতে সময় লাগে বেশি, উৎপাদনও হয় কম। শিল্পকেন্দ্রের উৎপাদন কমলে আয় কমে যায়, আর যে আয় হয় তা দিয়ে কর্মীদের পর্যাপ্ত বেতন দেয়া সম্ভব হয় না।”
তবে বিজয়পুর মৃৎশিল্প কর্তৃপক্ষ যে অভিযোগ করেছেন তা ঠিক নয় বলে দাবি বাখরাবাদ গ্যাস সিস্টেমস্ লিমিটেডের উপ মহাব্যবস্থাপক (বিক্রয় ডিপার্টমেন্ট) প্রকৌশলী মো. আবদুর রাজ্জাকের।
তিনি বলেন, “কেউ যদি আগে সংযোগ নেয় সেটি ‘ডেডিকেটেড বা নিজস্ব’ হয় না। যেহেতু চাহিদা আছে সেক্ষেত্রে ওই সংযোগ থেকে আরও সংযোগ গিয়েছে। এছাড়া তাদের কাছে আমাদের অনেক বিল পাওনা রয়েছে। স্বাভাবিকভাবে আমাদের যে গ্যাস সংকট তৈরি হয়েছে সে কারণে তারা গ্যাস পাননি।”
তবে এই সমস্যার সমাধান হিসেবে প্রকৌশলী রাজ্জাক বলেন, “আমরা মৃৎশিল্প কেন্দ্রকে বলেছি কুমিল্লা-নোয়াখালী মহাসড়ক থেকে সড়ক বিভাগ ও রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে নতুন একটি সংযোগের আবেদন করতে পারে। ওই দিকের সংযোগে গ্যাসের ভালো চাপ আছে, সেখান থেকে তারা উপকৃত হতে পারেন।”