বাড়িতে মানুষ দেখলেই মুক্ত হওয়ার জন্য শিকল ধরে টানাটানি করে জিহাদ।
Published : 25 Nov 2022, 10:01 AM
বয়সটা লেখাপড়া, খেলাধুলা আর ছোটাছুটিতে মেতে থাকার; কিন্তু গাজীপুরের কালিয়াকৈর ১২ বছর বয়সী জিহাদ মাহমুদের জীবন কাটছে শিকলে বন্দি হয়ে।
বাকপ্রতিবন্ধী ও মানসিক ভারসাম্যহীন জিহাদ প্রায়ই বাড়ি বেরিয়ে যেতো। টাকার অভাবে তার চিকিৎসাও করাতে পারছে না পরিবার। তাই ছেলেকে ‘হারিয়ে ফেলার ভয়ে’ সাত বছর ধরে শিকলে বন্দি করে রেখেছেন তার মা-বাবা।
জিহাদ কালিয়াকৈরের চাপাইর ইউনিয়নের বড়কাঞ্চনপুর টেকিবাড়ি এলাকার মুদি দোকানদার ফজলুর রহমান ও জিয়াসমিন বেগম দম্পতির ছেলে। তার যথাযথ চিকিৎসা ও স্বাভাবিকভাবে বেঁচে থাকার সুযোগ তৈরির জন্য সরকার ও বিত্তবানদের সহায়তা চেয়েছেন পরিবারের সদস্যরা।
কালিয়াকৈর উপজেলা সদর থেকে প্রায় ১০ কিলোমিটার দূরে কালিয়াকৈর-ফুলবাড়িয়া সড়কের পাশে বড়কাঞ্চানপুর টেকিবাড়ি বাজার। ওই বাজার থেকে পূর্ব দিকে জিহাদদের বাড়ি।
বৃহস্পতিবার ওই বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, এক ঘরের বারান্দায় খুঁটির সঙ্গে হাতে শিকল দিয়ে শিশু জিহাদকে বেঁধে রাখা হয়েছে। ওই অবস্থতেই পাশে বসে তাকে খাইয়ে দিচ্ছেন মা জিয়াসমিন বেগম। মানুষ দেখলেই মুক্ত হওয়ার জন্য জিহাদ শিকল ধরে টানাটানি করে।
জিহাদের পরিবার ও স্থানীয়ারা জানায়, জিহাদ জন্মের পর থেকেই কথা বলতে পারে না। ধীরে ধীরে বড় হতে থাকলে বোঝা যায়, সে মানসিক ভারসাম্যহীন। মাঝে মধ্যে উত্তেজিত হয়ে উঠতো। বাড়ি ঘরের এবং আশপাশের মানুষের বাড়িতে গিয়ে বিভিন্ন জিনিসপত্র ভাঙচুর করতো। হঠাৎ হঠাৎ তাকে খুঁজে পাওয়া যেতো না। সবসময় চোখে চোখে রাখাও কঠিন। তাই তার পায়ে শিকল বেঁধে ঘরের একটি খুঁটির সঙ্গে বেঁধে রাখা হয়।
জিহাদের মা জিয়াসমিন বেগম বলেন, “ছেলেটা আমারে মা আর বাবারে বাবা বলে ডাকতে পারে। আর কিছুই বলতে পারে না। একটা ছেলে যখন প্রতিবন্ধী হয়ে জন্ম নেয় তখন মা-বাবার মনটা কেমন হয় একবার ভেবে দেখেন। ছেলেটা হঠাৎ করেই কোনো একদিকে চলে যায়। প্রতিদিন সন্ধ্যায় তাকে খোঁজে ফিরিয়ে আনতে হতো।
“অথবা মানুষজন তাকে দেখে বাসায় দিয়ে যেতো। কিন্তু একেবারে যদি হারিয়ে যায় তখন কি হবে? ছেলে যেমনই থাকুক ওকে হারাতে চাইনা। তাই একটা শিকল দিয়ে ঘরের বারান্দার খুঁটির সঙ্গে আটকে রাখি। যাতে কোথাও চলে যেতে না পারে।”
বাবা ফজলুর রহমান বলেন, “রাতের বেলায় জিহাদ আমাদের সঙ্গেই ঘুমায়। তখন শিকল দিয়ে বাঁধা থাকে না। মাঝে মধ্যেই মধ্যরাতে ঘুম থেকে উঠে ঘরে ভাঙচুর করে সব লণ্ডভণ্ড করে রাখে। জিহাদকে অনেক ডাক্তার দেখিয়েছি। তারা বলেছে, দীর্ঘ মেয়াদী চিকিৎসা করালে জিহাদ ভালো হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
“কিন্তু এর জন্য অনেক টাকারও প্রয়োজন। সেই টাকা আমাদের নেই। কিন্তু ছেলেটারে দেখলে বুকটা ফাইটা যায়। যেভাবে পারি ওকে সুস্থ করতে চাই।“
স্থানীয় বাসিন্দা আনোয়ার হোসেন জানান, জিহাদের বাবা মুদি দোকান করে সংসার চালান। পরিবারে স্ত্রী, বড় ছেলে জিসান মাহমুদ ও জিহাদ মাহমুদ আর বৃদ্ধা মা ফিরোজা বেগম (৭০) রয়েছে। মায়ের পৈত্রিক সূত্রে পাওয়া অল্প একটু জমিতে বাড়ি নির্মাণ করে তারা পাঁচজন কোনো রকমে খেয়ে-পরে দিন কাটায়। অর্থ সঙ্কটে তারা ভারসাম্যহীন ও বাক প্রতিবন্ধী জিহাদের চিকিৎসাও করাতে পারছেন না। এ অবস্থায় পরিবারটি খুবই অসাহায় হয়ে পড়েছে।
কালিয়াকৈর উপজেলার চাপাইর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সাইফুজ্জামান সেতু বলেন, “মাঝে মধ্যেই আমি জিহাদের পরিবারের খোঁজ খবর নেই। তারা কিভাবে আরও ভালো করে চলতে পারে, তা দেখব।”