“ডাক দিলেই সে আমাকে চেনে। তার নাম জাম্বু। কুকুরের ছানার মতো ছিল; এখন তো অনেক বড় হয়েছে।”
Published : 04 Feb 2025, 12:13 AM
আরও কয়েকটি ছানার সঙ্গে ২০০৮ সালে রাঙামাটি জেলা পরিষদের মিনি চিড়িয়াখানায় আনা হয়েছিল ‘জাম্বু’কেও। সঙ্গীরা একে একে মারা যাওয়ায় তীব্র একাকীত্বেই দিন-রাত পেরিয়েছে তার। অবশেষে বন বিভাগের উদ্যোগে সেই নিঃসঙ্গতার অবসান হয়েছে।
সোমবার দুপুরে ‘জাম্বু’ নামের এ ভালুকের সঙ্গে হরিণ, বানরসহ ১৯ প্রাণীকেও উদ্ধার করে কক্সবাজারের চকরিয়ার ডুলাহাজারা সাফারি পার্কে নিয়ে গেছে বনবিভাগ।
বন অধিদপ্তরের বন্যপ্রাণী অপরাধ দমন ইউনিটের বন্যপ্রাণী ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ কর্মকর্তা দ্বীপান্বিতা ভট্টাচার্য্য বলেন, “এখানকার প্রাণীর ওপর যথেষ্ট অবহেলা ও পরিচর্যার অভাব রয়েছে, তাই বন্যপ্রাণী অপরাধ দমন ইউনিটই প্রথমে বন্যপ্রাণীগুলো উদ্ধারের পদক্ষেপ নেয়। জেলা পরিষদ বন্যপ্রাণীগুলো হস্তান্তরের জন্য সম্মত হওয়ায় আমরা সেগুলো উদ্ধার করেছি।”
তিনি আরও বলেন, “বন্যপ্রাণীগুলো প্রথমে ডুলাহাজারা সাফারি পার্কে নিয়ে পর্যাপ্ত কোয়ারেন্টাইনে রাখা হবে। এরপর যেগুলো প্রকৃতিতে অবমুক্ত উপযোগী সেগুলোকে অবমুক্ত করা হবে। যেগুলোকে বেষ্টনীতে রাখতে হবে, সেগুলোকে বেষ্টনীতে রাখা হবে।”
২০০২ সালে শহরের সুখী নীলগঞ্জ এলাকায় এ মিনি-চিড়িয়াখানাটি চালু করে রাঙামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদ।
পরে ২০০৮ সালের ৪ অগাস্ট চিড়িয়াখানাটি সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন পেলেও আয়বর্ধক প্রকল্প না হওয়ায় জেলা পরিষদ এটির প্রতি মনোযোগী ছিল না বলে অভিযোগ আছে।
যদিও অনুমোদন পাওয়ার আগে থেকেই সেখানে বিভিন্ন বন্যপ্রাণী আনতে থাকে প্রতিষ্ঠানটি। ২০০৮ সালে আনা হয় কয়েকটি ভাল্লুক ছানা। এর পরে হরিণ, খরগোশ, বন বিড়াল, গুঁইসাপ, বানরসহ বেশকিছু প্রজাতির প্রাণী আনা হয়েছিল।
কিন্তু অব্যবস্থাপনার কারণে রোগাক্রান্ত হয়ে, খাবার সংকট ও যথাযথ পরিচর্যার অভাবে দিন দিন প্রাণীর সংখ্যা কমতে থাকে। হরিণের সংখ্যা ছিল তিনটি, কিন্তু এখন আছে একটি। অজগরও ছিল একসময়, সেটির মৃত্যুর পর খাঁচা শূন্য পড়ে আছে।
এছাড়া একটি মাত্র ভাল্লুক, চারটি বানর, দুটি শজারু, পাঁচটি বন মোরগ ও ছয়টি কচ্ছপসহ মোট ১৯টি প্রাণী দিয়ে পরিচালিত হচ্ছিল চিড়িয়াখানাটি। টিকে থাকা এ প্রাণীগুলোরও খাবার না পেয়ে মরার দশা।
বন্যপ্রাণী ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ কর্মকর্তা দ্বীপান্বিতা ভট্টাচার্য্য বলেন, “জেলা পরিষদ কর্তৃক প্রধান বন সংরক্ষকের মাধ্যমে এটি অনুমোদন নেয়া হয়েছিল ২০০৮ সালে। তখন উনারা বলেছেন কিছু প্রাণী রাখতে চান, পরে নিঝুম দ্বীপ থেকে কিছু হরিণ আনার বিষয়ে অনুমতি নেয়া হয়েছিল।”
“পর্যায়ক্রমে বন অধিদপ্তরের সঙ্গে যোগাযোগ করে কিছু প্রাণী এনেছিলেন। পরবর্তীতে অন্যান্য যে প্রাণীগুলো এসেছে, সেগুলো কীভাবে এসেছে সেটি বন অধিদপ্তর জানে না। ”
মিনি-চিড়িয়াখানার বন্যপ্রাণী পালনকারী সোনাবী চাকমা বলেন, “এখানে বন বিড়াল, খরখোশ ভাল্লুক, হরিণ, গুঁইসাপ ছিল। কিছু কিছু প্রাণী মারা গেছে। আমি মনপ্রাণ দিয়ে চেষ্টা করেছি প্রাণীগুলো যেন সুন্দরভাবে সারাজীবন থাকতে পারে।
“ভাল্লুকটাকে নিয়ে যাচ্ছে, এটা আমার কাছে খুব খারাপ লাগছে। ছোট থেকে আমি পালন করছি। ডাক দিলেই সে আমাকে চেনে। তার নাম জাম্বু। কুকুরের ছানার মতো ছিল; এখন তো অনেক বড় হয়েছে।”
ন্যাচার অ্যান্ড বায়োডাইভার্সিটি অব সিএইচটির মুখপাত্র প্রান্ত রনি বলেন, “মিনি-চিড়িয়াখানার নামে প্রায় বিগত দুই দশক ধরেই বন্যপ্রাণীগুলো আটকে রাখে রাঙামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদ।
“এটি নিয়ে কয়েকবছর ধরে বিভিন্ন সভা-সেমিনারে প্রসঙ্গ উঠলেও যথাযথ ব্যবস্থা নেয়নি জেলা পরিষদ। মিনি-চিড়িয়াখানাটিতে শিশু-পার্ক তৈরিসহ নানান আলাপ উঠলেও কোনোটিতে নজর দেয়নি বিগত পর্ষদ। অবশেষে অন্তর্বর্তীকালীন পরিষদ গঠনের পর তারা বন্যপ্রাণীগুলো বন বিভাগকে হস্তান্তরের উদ্যোগ নেয়।”
গত ৭ জানুয়ারি বন অধিদপ্তরের বন্যপ্রাণী অপরাধ দমন ইউনিটের পরিচালক বরাবর চিঠি লিখে মিনি-চিড়িয়াখানার বন্যপ্রাণীগুলো বন বিভাগকে হস্তান্তরের কথা জানায় রাঙামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান কৃষিবিদ কাজল তালুকদার।
চিঠিতে চিড়িয়াখানার প্রাণীগুলো বর্তমানে অভিজ্ঞ জনবলের অভাবের কারণে প্রতিপালন ও সংরক্ষণে সমস্যা হচ্ছে বিধায়, বন বিভাগের নিকট হস্তান্তর করতে ইচ্ছুক বলে উল্লেখ করা হয়।
এবিষয়ে কাজল তালুকদার বলেন, “কোন প্রাণীকে এভাবে আটকে রাখা উচিত নয়। তাই প্রাণীগুলোর প্রতি মানবিক দিক বিবেচনা করে বন বিভাগকে প্রাণীগুলো হস্তান্তর করা হয়েছে।”
বন অধিদপ্তরের ভেটেরিনারি সার্জন ডা. হাতেম সাজ্জাদ মো. জুলকারনাইন বলেন, বন্যপ্রাণীগুলোর মধ্যে ভাল্লুকের শারীরিক অবস্থা ভালো। হরিণের অবস্থা মোটামুটি, চামড়ায় কিছুটা সমস্যা আছে। বানরের চামড়ায় সমস্যা আছে। অন্যান্য প্রাণীগুলো মোটামুটি আছে। এগুলোকে আমরা সাফারি পার্কে নিয়ে যাব।”
ভাল্লুকটির প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি আরও বলেন, “নিঃসঙ্গ থাকলে অবশ্যই ভাল্লুকটির মধ্যে মানসিক প্রভাব পড়বে। যদি ছোট অবস্থা থেকেই এখানে থাকে মানুষের সংস্পর্শে, তাহলে তার মনের মধ্যে প্রেসার কম পড়বে।
“পরিবেশ-প্রকৃতি বোঝার পর যদি প্রা কে আলাদা করা হয় তাহলে সে প্রাণীর মনের মধ্যে চাপটা বেশি পড়ে। তবে ভাল্লুকটি যেহেতু ছোট অবস্থা থেকেই মানুষের সঙ্গে মানিয়ে নিয়েছে, তার এত সমস্যা হবে না। তবে ভাল্লুকটির আচরণগত কিছু পরিবর্তন হবে।”
আরেক বন্যপ্রাণী ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ কর্মকর্তা রথীন্দ্র কুমার বিশ্বাস বলেন, “বর্তমানে মিনি চিড়িয়াখানা ২০১২ সালের বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা আইন পরিপন্থী। এই আইনের অধীনে কোনো ধরনের দেশীয় প্রজাতির বন্যপ্রাণী ক্রয়-বিক্রয়, বন্দি রাখা, লালন-পালন করা আইন পরিপন্থী।”