“সরকারকে অনুরোধ করব, যারা সন্ত্রাসী, অস্ত্র লুট ও ডাকাতির সঙ্গে জড়িত তাদেরকে ধরেন। কিন্তু কোনো নিরীহ মানুষকে যেন হয়রানি করা না হয়।”
Published : 19 May 2024, 11:36 PM
স্বাভাবিক জীবন ও চলাফেরার দাবি জানিয়েছেন বান্দরবানের বম সম্প্রদায়ের মানুষেরা। একইসঙ্গে তারা বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের কারণে পাহাড়ের সশস্ত্র সংগঠন কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট-কেএনএফকে বর্জনের ঘোষণাও দিয়েছেন।
রোববার বিকালে জেলা শহরের উজানি পাড়ার ইভেনজেলিক্যাল খ্রিস্টিয়ান চার্চ-ইসিসি প্রাঙ্গণে ‘সাধারণ বম জনগোষ্ঠী’র ব্যানারে এই মানববন্ধনের আয়োজন করা হয়।
রুমা ও থানচিতে দুটি ব্যাংকে ডাকাতি ও অস্ত্র লুটের ঘটনার পর যৌথ বাহিনীর অভিযানের মধ্যে এই ঘোষণা দিলেন বমরা। এ সময় তারা ব্যাংক ডাকাতি ও অস্ত্র লুটের ঘটনার নিন্দা ও প্রতিবাদ জানান।
মানববন্ধনে সরকারের প্রতি বিভিন্ন দাবি সম্বলিত প্ল্যাকার্ড এবং কেএনএফকে বর্জনের ঘোষণা দিয়ে বম সম্প্রদায়ের অর্ধ শতাধিক নারী-পুরুষ ও শিশু অংশ নেন।
মানববন্ধনে লালঅয় পার বম নামে এক শিক্ষার্থী লিখিত বক্তব্যে বলেন, “বর্তমানে প্রাণের ভয়ে নারী-পুরুষ, বৃদ্ধ-শিশু জঙ্গলে অনাহারে অবর্ণনীয় কষ্টে দিনযাপন করছে। যা শিক্ষার্থীরা কখনও আশা করেনি। বম শিক্ষার্থীরাও স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে সুনাগরিক হিসেবে নিজেদের জীবন গড়ে তুলতে চাই।”
লালঅয় পার বম বলেন, “কেএনএফের এমন সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডকে ছাত্রসমাজ গ্রহণ করে না। তাদের এই কর্মকাণ্ডকে তীব্র ঘৃণা ও প্রতিবাদ জানাই। আমরা সন্ত্রাসী, রাষ্ট্রবিরোধী ও ডাকাত গোষ্ঠী হিসেবে পরিচিত হতে চাই না। গোটা বম ছাত্রসমাজ কেএনএফকে বর্জন করেছে।”
এ ছাড়া বম ছাত্রসমাজের পক্ষ থেকে সরকারে প্রতি চারটি দাবি তুলে ধরেন শিক্ষার্থী লালঅয় পার বম।
সেগুলো হল- তদন্তের মাধ্যমে প্রকৃত সন্ত্রাসীদের আইনের আওতায় আনা। নির্দোষ-নিরীহ আটককৃত শিক্ষার্থীদের মুক্তি দেওয়া; দোষীদের দায় বম ছাত্রসমাজ নেবে না। প্রকৃত অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া; নিরপেক্ষ ও সঠিক তদন্তের মাধ্যমে কেএনএফের উত্থান দেশবাসীর সামনে তুলে ধরা; বম সমাজকে স্বাভাবিক বেচে থাকার অধিকার দেওয়া।
লালপেক থার নামে বম সম্প্রদায়ের আরেক সদস্য লিখিত বক্তব্যে বলেন, “বম জনগোষ্ঠীর মানুষ স্থানীয়, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে সম্পৃক্ত না থাকায় রাজনীতির চাল-চলেন পরিচিত নয়। যার কারণে অপ্রীতিকর, অপ্রত্যাশিত ও রাষ্ট্রবিরোধী ঘটনা মোকাবিলা ও প্রতিরোধ করার মত উপায় আমাদের ছিল না। দেরীতে হলেও আজ আমরা সমবেত হয়েছি নিজেদের অবস্থান পরিষ্কার করার জন্য।
“আজ উপলব্ধি করলাম, আমাদের পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেছে। সন্ত্রাসী, রাষ্ট্রবিরোধী ও ডাকাত গোষ্ঠী পরিচয় নিয়ে বাঁচতে চাই না। আমাদের ভাল, সুশৃঙ্খল ও পরিচ্ছন্ন জাতি হিসেবে পরিচিত ছিল। অল্প কিছু সংখ্যক পথভ্রষ্ট ও বিপদগামী কেএনএফ সদস্যদের কারণে সেই সুশৃঙ্খল ও পরিচ্ছিন্ন জাতি হুমকির সম্মুখীন হয়েছি। আমরা বম সম্প্রদায় কেএনএফকে বর্জন করলাম।”
এ সময় কেএনএফ সদস্যদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরে এসে বম সম্প্রদায়কে নিরাপদে বসবাসের সুযোগ দেওয়ার আহ্বান জানান লালপেক থার।
শুধু বম হওয়ার কারণে শিক্ষার্থীরা নানাভাবে হয়রানির শিকার হচ্ছে বলে অভিযোগ করেন ঙুন চুয়াম বম নামে এক নারী।
তিনি বলেন, “এখন কোনো চেক পোস্টে পার করতে পারি না। অনেকের বম পরিচয় লুকিয়ে রাখতে হচ্ছে। ভয়ে এখন অনেকে বম পরিচয় লুকিয়ে রাখতে চায়। স্বাভাবিক চলাফেরার সুযোগ নাই। সরকারকে অনুরোধ করব, যারা সন্ত্রাসী, অস্ত্র লুট ও ডাকাতির সঙ্গে জড়িত তাদেরকে ধরেন। কিন্তু কোনো নিরীহ মানুষকে যেন হয়রানি করা না হয়।”
তুয়ারনেম নামে আরেক নারী বম ভাষায় তার বক্তব্যে বলেন, “কেএনএফ অস্ত্র লুট ও ব্যাংক ডাকাতির মাধ্যমে একটি জঘন্য ঘটনা ঘটিয়েছে। তারা শাস্তি পাক। কিন্তু আমরা নিরীহ বমরা শান্তিতে থাকতে চাই। এখন সবাই মনে করে, বম মানে কেএনএফ। আবার কেএনএফ মানে বম। অথচ তারা সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন। কেউ তাদের সমর্থন করে না।”
মানববন্ধনে সভাপতিত্ব করেন শহরের কালাঘাটা এলাকার প্রেস ব্যাটারিয়ান চার্চের ধর্মযাজক জর্জেও লনচেও।
২ এপ্রিল রুমা উপজেলার সোনালী ব্যাংকে ডাকাতি করে অর্থ লুট করে একদল সশস্ত্র লোকজন। পুলিশের ১০টি এবং আনসার সদস্যের ৪ টি অস্ত্রও লুট করে নিয়ে যায় তারা। অপহরন করা হয় ব্যাংকটির ম্যানেজার নেজাম উদ্দিনকে। দুদিন পর রুমার একটা পাহাড়ি এলাকা থেকে ছাড়া পান তিনি।
রুমা ঘটনার একদিন পর ৩ এপ্রিল থানচি উপজেলার সোনালী ও কৃষি ব্যাংকেও দিন-দুপুরে অর্থ লুটের ঘটনা ঘটে।
দুটি ঘটনায় পাহাড়ে সশস্ত্র সংগঠন কুকি চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট-কেএনএফ জড়িত বলে জানিয়েছেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এরপর থেকে লুট হওয়া অস্ত্র-অর্থ উদ্ধার, সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে রুমা ও থানচিতে অভিযান চালাচ্ছে যৌথ বাহিনী। অভিযানে অংশ নিচ্ছেন সেনাবাহিনী, বিজিবি, র্যাব ও পুলিশ সদস্যের যৌথ বাহিনী।
যৌথ বাহিনীর এই অভিযান সমন্বয় করছেন সেনাবাহিনী।
যৌথ বাহিনীর এই অভিযানে বিভিন্ন এলাকা থেকে এখন পর্যন্ত রুমা থানায় ৫টি ও থানচি থানায় ৪টি মামলায় ২৫ নারীসহ মোট ৮৬ জনকে গ্রেপ্তারের খবর জানিয়েছে পুলিশ।