শুক্রবার সকালে কুড়িগ্রামে সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ১১ দশমিক ৮ ডিগ্রী সেলসিয়াস রেকর্ড করা হয়েছে।
Published : 13 Dec 2024, 04:31 PM
অগ্রহায়ণের শেষেই উত্তরের সীমান্তবর্তী জেলা কুড়িগ্রামে জেঁকে বসেছে শীত। কনকনে হিমেল হাওয়ায় বিপযর্স্ত হয়ে পড়েছে এ জেলার নদী-তীরবর্তী চরাঞ্চলের মানুষজন।
সকাল থেকে সূর্যের দেখা না পাওয়া আর বৃষ্টির মতো করে কুয়াশা পড়ায় সড়কে হেড লাইট জ্বালিয়ে চলছে যানবাহন।
শুক্রবার সকালে কুড়িগ্রামে সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ১১ দশমিক ৮ ডিগ্রী সেলসিয়াস রেকর্ড করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন কুড়িগ্রাম আবহাওয়া অফিসের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সুবল চন্দ্র সরকার।
কুয়াশার কারণে চিলমারী নৌ-বন্দর ও যাত্রাপুর নৌঘাটের সকাল ৮টার নৌকাগুলোও বেলা ১২টার আগে ছাড়েনি বলে জানান নৌ-মালিকরা।
এর মধ্যে কনেকনে ঠাণ্ডায় জেলার দরিদ্র মানুষের মাঝে তীব্র শীতবস্ত্র সংকট দেখা দিয়েছে। সরকারি পর্যায়ে শীতবস্ত্র বিতরণ অপ্রতুল। এতে সব থেকে বেশি কষ্টে পড়েছেন ছিন্নমূল মানুষরা।
চিলমারী উপজেলার অষ্টমির চর ইউনিয়নের বড় চরের মাটি কাটা শ্রমিক সাজেদা বেগম বলেন, ’অঘ্রায়ন মাস গেইল পৌষ আসবের নাকচে, হামরা চরত থাকি, হামার খবর. কাই রাখে, ঠান্ডাতে জীবন বাঁচে না কম্বল হামাক কাই দেয়?”
চিলমারী ইউনিয়নের দিনমজুর কহিনুর বেগম বলেন, “শীতের ঠান্ডাত কাম কাজ কইরবের পাইনে বাহে, বৃষ্টির মতন টপ টপ করি শীত পড়ে। এলাও কাইয়্যো কম্বল দেইল না। মেম্বারক কই ওমরা কয় এল্যাউ কম্বল আসে নাই।”
সদর উপজেলার যাত্রাপুর ইউনিয়নের চর ইয়ুথনেটের দোকানদার জহুরুল ইসলাম বলেন, “হামরা চরত মাঝত থাকি, সকাল-বিকাল কুয়াশা ঘিরি ধরে। ছোট বাচ্চাদের নিয়ে কষ্টে পার করছি। সরকার থাকি এখনো কোন শীতের কাপড় পাই নাই।”
সদরের ভোগডাঙ্গা ইউনিয়নের দিনমজুর হুজুর আলী বলেন, “মুই গরিব মানুষ বাপ, মোর গরম কাপড় কট্টি থাকি পাইম। কাল রাইত থাকি ঝড়ির নাকান শীত পড়ে। গাত (শরীর) লুঙ্গি পেচে কাজত যাবাইছি “
পাঁচগাছি ইউনিয়নের প্রতিবন্ধী ভিক্ষুক ভানু বেগম বলেন, “মোর বাড়িত ঘর নাই বাবা। ঠান্ডাত খুব কষ্টে রাইত কাটাং, হাত-পাও শীগ নাগে। মোক একটা কম্বল দিলে আল্লাহ তোমার ভাল করবে। গাওত দেবার মতো গরম কাপড় নাই মোর।”
প্রতিবছর এ জেলায় শীতের মৌসুমে সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে শীত নিবারণের গরম কাপড় ও কম্বল বিতরণ করা হলেও এখনো এ ধরণের কোনো উদ্যোগ দেখা যায়নি। শীত নিবারণের জন্য এখন পর্যন্ত সরকারিভাবে বিতরণ করা হয়নি কম্বল বা শীতবস্ত্র।
গরম পোশাক কেনা ও কম্বল বিতরণের বিষয়ে জেলা ত্রাণ ও পুর্নবাসন শাখার দায়িত্বপ্রাপ্ত একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে অনেকেই এড়িয়ে যান। কেউ কেউ বরাদ্দকৃত কম্বল বিতরণের কথা বললেও মাঠ পর্যায়ে বিষয়টি একেবারে উল্টো।
তবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সরকারি বরাদ্দ কম থাকা, বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থাগুলো বরাদ্দ না দেয়া ও প্রশাসনিক কাজের ধীরগতির কারণে এখনো কম্বল বিতরণের কার্যক্রম শুরুই করতে পারেনি স্থানীয় প্রশাসন।
রৌমারী উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা শামসুদ্দিন বলেন, “এ উপজেলায় ২০০ কম্বল বরাদ্দ হয়েছে। নদী পথ তবে এক সপ্তাহ পরে আনা হবে।’
রাজীবপুর উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা লুৎফর রহমান বলেন, “২০০ কম্বল বরাদ্দ পেয়েছেন। তবে এখনও উপজেলায় আনা হয়নি।”
উলিপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আতাউর রহমান বলেন, “এখনো সরকারি বরাদ্দ পাওয়া যায়নি। তবে পাওয়া যাবে। পাওয়া মাত্র বিতরণ করা হবে।”
ভূরুঙ্গামারী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা গোলাম ফেরদৌস বলেন, “আমার উপজেলার জন্য ২০০টা কম্বল পেয়েছি । এগুলো বিতরণের জন্য বরাদ্দ দেয়া হয়েছে।”
জেলার ত্রাণ ও পুর্নবাসন কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, চলতি বছরে এখন পর্যন্ত ৯ উপজেলার ২৩ লাখ ২৯ হাজার ১৬১ জন মানুষের বিপরীতে ১ হাজার ৮০০ টি কম্বল বরাদ্দ রয়েছে। যা প্রতি উপজেলায় ২০০টি করে বিতরণ করা হবে।
আর প্রতি উপজেলায় চাহিদা অনুযায়ী গরম কাপড় কেনার জন্য ৩ লাখ করে অর্থ বরাদ্দ দেয়া রয়েছে।
এদিকে কুড়িগ্রামে শীত জেঁকে বসলেও সরকারিভাবে কম্বল বিতরণ না করা আর বরাদ্দ কম থাকায় স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও সাধারণ মানুষের মধ্যে চরম ক্ষোভ লক্ষ্য করা যায়।
গরম কাপড়ের অভাবে খেটে-খাওয়া দিনমজুর ও নিম্ন আয়ের এই মানুষগুলো একাধিক পুরনো কাপড় ভারী করে গায়ে জড়িয়ে কাজে বের হচ্ছেন। কেউ কেউ খড়-কুটো জ্বালিয়ে শীত নিবারনের চেষ্টা করছেন। কিন্তু সেটি সাময়িক স্বস্তি দিলেও কষ্ট থেকে রেহাই দিচ্ছে না।
চলতি বছরের শেষ দিকে সরকারিভাবে নতুন করে শীতের কাপড় কেনার জন্য অর্থ ও যথেষ্ট পরিমানে কম্বল বরাদ্দ না থাকায় বিপাকে জনপ্রতিনিধিরা।
জেলা ত্রাণ ও পুর্নবাসন কর্মকর্তা আব্দুল হাই সরকার বলেন, “শীতের জন্য নতুন করে ১ লাখ ১৫ হাজার কম্বলের চাহিদা পাঠানো হয়েছে। সাধারণত ৬৫ থেকে ৭০ হাজার বরাদ্দ থাকে প্রতি বছর। চলতি শীত মৌসুমে এ পর্যন্ত ৯ উপজেলার জন্য ১৮০০ কম্বল ও গরম পোষাক কেনার জন্য ২৭ লাখ টাকা বন্টন করা হয়েছে।”
তবে শীতের এ দাপট থেকে জেলার বাসিন্দাদের মুক্তি সহসাই মিলছে না বলে জানিয়েছেন কুড়িগ্রাম কৃষি আবহাওয়া পর্যবেক্ষণাগারের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সুবল চন্দ্র।
হিমালয়ের হিম বাতাস বইতে থাকায় ঠান্ডা বেশি অনুভূত হচ্ছে। তাপমাত্রা আরও নিম্নগামী হয়ে চলতি মাসেই দুটি মাঝারী শৈত্য প্রবাহের পূর্বাভাসের কথা জানিয়েছেন এ আবহাওয়াবিদ।
পুরানো খবর