ভাষা শহীদ আবদুস সালাম গ্রন্থাগারে হাজারো বই থাকলেও পাঠক নেই।
Published : 21 Feb 2023, 09:46 AM
ফেনীর দাগনভূঞা উপজেলার সালামনগর গ্রামে ভাষা আন্দোলনে শহীদ আবদুস সালামের স্মৃতি রক্ষার্থে নির্মিত ‘ভাষা শহীদ আবদুস সালাম গ্রন্থাগার ও স্মৃতি জাদুঘরটি’ গুরুত্ব বাড়ে কেবল ফেব্রুয়ারি মাস এলে।
শহীদ আবদুস সালামের গ্রামটির সাবেক নাম লক্ষ্মণপুর; এখন পরিচিত ‘ভাষাশহীদ সালাম নগর’ নামে। গ্রামটি ফেনী-নোয়াখালী জাতীয় মহাসড়কের পাশে দাগনভূঞা উপজেলা সদর থেকে ২ কিলোমিটার ও ফেনী শহর থেকে ১৩ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত।
২০০৮ সালে ভাষা শহীদ আবদুস সালামের বাড়ির অদূরে ‘আবদুস সালাম গ্রন্থাগার ও স্মৃতি জাদুঘরটি’ প্রতিষ্ঠা করা হয়। ঝকঝকে একতলা ভবনের ওই পাঠাগারের ভেতরে ঢুকতেই বড় একটি হলরুম; দেয়ালে টানানো ভাষা শহীদের ছবি। ১১টি আলমারিতে হাজার তিনেক বই আর ছয়টি টেবিল; সঙ্গে কিছু চেয়ার। আলমারিতে বই ঠাসা থাকলেও পাঠক নেই। গ্রন্থাগারটি নিয়মিত খোলাও হয় না। জাদুঘরে শহীদ সালামের একটি ছবি ছাড়া আর কোনো স্মৃতিচিহ্ন নেই।
লোকজনও খুব একটা আসে না। গ্রন্থাগার ও স্মৃতি জাদুঘরে একজন গ্রন্থাগারিক ও একজন তত্ত্বাবধায়ক আছেন। ভবনের সামনে মাঠের এক পাশে ভাষাশহীদ আবদুস সালাম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। পাশেই গড়ে উঠেছে বেশ বিছু দোকানপাট। অপর পাশে শহীদ মিনার আর উন্মুক্ত মাঠ। পাশ দিয়ে বয়ে গেছে সিলোনিয়া নদী।
সালামনগর গ্রামের বাসিন্দারা জানান, ভাষা শহীদ আবদুস সালাম গ্রন্থাগারে হাজারো বই থাকলেও পাঠক নেই। বছরজুড়ে সুনশান নিরবতা থাকলেও ফেব্রুয়ারি মাসে থেকে শুরু হয় গণমাধ্যমকর্মী ও প্রশাসনের কর্মকর্তা কর্মচারীসহ বিভিন্ন স্তরের শ্রেণি-পেশার মানুষের আনাগোনা। ঘটা করে একুশে ফেব্রুয়ারির নানা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।
প্রতিষ্ঠালগ্নে যে কয়েক হাজার বই গ্রন্থাগারে দেওয়া হয়েছিল-সেগুলো এখনও আলমারিতে সাজানো রয়েছে। তার মধ্যে কিছু বই নষ্ট হলেও নতুন কোনো বই আর যোগ হয়নি। লাইব্রেরিতে কোনো পত্র-পত্রিকাও নেই। ফলে কেউ যায় না। জেলা পরিষদ থেকে একজন লাইব্রেরিয়ান ও একজন কেয়ারটেকার নিয়োগ দেওয়া হয়েছে; তারাও অলস সময় কাটান।
পরিবার ও স্বজনদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ভাষা আন্দোলনের ৬৫ বছর পর ২০১৭ সালে রাজধানীর আজিমপুর কবরস্থানে আবদুস সালামের কবর শনাক্ত করা হয়। তাকে স্মরণীয় করে রাখতে তার গ্রামের নাম পরিবর্তন করে সেটিকে ভাষা শহীদ আবদুস সালাম নগর গ্রাম করা হয়েছে।
ফেনী শহরের ভাষা শহীদ সালাম স্টেডিয়ামের নামে একটি স্টেডিয়াম ও একটি কমিউনিটি সেন্টারেরও নামকরণ করা হয়। দাগনভূঞা উপজেলা অডিটরিয়ামের নামও ভাষা শহীদ সালাম মিলনায়তন করা হয়। নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে হলের নাম করা হয় ভাষা শহীদ আবদুস সালাম।
ভাষা শহীদ সালাম নগর গ্রামে বেসরকারিভাবে প্রতিষ্ঠা করেন ভাষা শহীদ সালাম মেমোরিয়াল কলেজ। বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে ২০০০ সালে ভাষা শহীদ সালামকে মরণোত্তর একুশে পদক প্রদান করা হয়।
ভাষা শহীদ সালাম স্মৃতি গ্রন্থাগারের লাইব্রেরিয়ান মো. লুৎফর রহমান বাবলু বলেন, গ্রন্থাগারে সাড়ে তিন হাজার বই রয়েছে; প্রায় সবগুলোই পুরাতন। বছরজুড়ে গ্রন্থাগারটি পাঠকের জন্য খোলা রাখা হলেও পাঠকের আনাগোনা তেমন থাকে না। দৈনিক পত্রিকা না থাকায় সাধারণ পাঠকও নেই।
শহীদ সালামের বোনের ছেলে মো. হানিফ বলেন, “মামার নামে এ গ্রামের নাম ভাষা শহীদ আবদুস সালাম নগর করা হয়েছে। কিন্তু সারা বছর এখানে কেউ আসে না। শুধুমাত্র ফেব্রুয়ারি মাস এলেই সবাই আমাদের খোঁজেন। কর্মসূচি পালন করেন। এখানে একটি বিনোদন পার্ক ও একটি উচ্চ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা প্রয়োজন। গ্রন্থাগারে পাঠকের শূন্যতাও পূরণ হবে। মানুষ ভাষা আন্দোলন ও শহীদ সালামকে জানার সুযোগ পাবে।”
ভাষা শহীদ আব্দুস সালামের নামের সঙ্গে নামের মিল থাকা এক তরুণ লেখক ও সাহিত্যিক আব্দুস সালাম ফরায়েজ বলেন, “দাগনভূঞা উপজেলার বিভিন্ন সরকারি বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে শিক্ষার্থীদেরকে নিয়ে সপ্তাহে একদিন গ্রন্থাগার ও জাদুঘরটি পরিদর্শন করালে ভাষা শহীদ আব্দুস সালামকে আরও বেশি জানতে পারবে শিক্ষার্থীরা। গ্রন্থাগারটিও পাঠক সমৃদ্ধ হবে।”
পাঠাগারে পাঠক সংখ্যা বাড়াতে কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে কিনা- জানতে চাইলে ফেনী জেলা পরিষদের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (অতিরিক্ত সচিব) আবু দাউদ মো. গোলাম মোস্তফা বলেন, জেলা পরিষদের দায়িত্ব স্থাপনাটি রক্ষনাবেক্ষণ করা। গ্রন্থাগারে পর্যাপ্ত বই আছে। লাগলে আরও বই জেলা পরিষদ থেকে দেওয়া হবে। গ্রন্থাগার যে দুজন স্টাফ আছেন কেয়ারটেকার ও লাইব্রেরিয়ান, তাদের স্থায়ীভাবে তো নিয়োগও নেই। এটি জেলা শহর থেকে অনেক দূরে হওয়ায় প্রতিমাসে ১৫/২০ জনের বেশি দর্শনে যায় না সেখানে।
তিনি আরও বলেন, “গ্রন্থাগারে প্রতিদিন দুটি দৈনিক পত্রিকা রাখা হয়। পাঠক না গেলে তো আমাদের কিছু করার নেই। আমাদের কাজ তো পাঠক সংগ্রহ করা না। অবকাঠামগত সব রকমের সহযোগিতা জেলা পরিষদ করবে। তবে এটি পাঠক এবং দর্শকের উপযোগী করতে দাগনভূঞা উপজেলা প্রশাসনকে উদ্যোগ নিতে হবে।”
ফেনী জেলা প্রশাসক আবু সেলিম মাহমুদ-উল হাসান বলেন, “ভাষা শহীদ সালামের গ্রামের সঙ্গে আমাদের আগামী প্রজন্মকে কীভাবে আরও বেশি সম্পৃক্ত করা যায়, সে বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের উদ্যোগ নেওয়া হবে। অভ্যন্তরীণ যদি কোনো সমস্যা থেকে থাকে তার সমাধানেরও উদ্যোগ নেওয়া হবে।”