১১৭ শতাংশ জমির উপর মোগলহাট স্থলবন্দর ও ইমিগ্রেশন চেকপোস্ট কার্যক্রম পরিচালনার জন্য নির্মিত স্থাপনা ভঙ্গুর অবস্থায় পড়ে আছে।
Published : 06 Nov 2023, 08:55 AM
আন্দোলন-আলোচনা-প্রতিশ্রুতি-চিঠি চালাচালির পরও ১৯৮৮ সালে বন্ধ হয়ে যাওয়া লালমনিরহাটের মোগলহাট স্থলবন্দরটি পুনরায় চালুর অগ্রগতি নেই।
একসময় মোগলহাটে ছিল স্থলবন্দর ও ইমিগ্রেশন চেকপোস্ট। ১৯৮৮ সালের প্রলয়ঙ্কারী বন্যায় ও ধরলা নদীর ভাঙনে একটি রেলওয়ে সেতু ক্ষতিগ্রস্ত এবং এক কিলোমিটার সংযোগ-সড়ক নদীগর্ভে বিলীন হলে বন্দরটি দিয়ে পণ্য আমদানি-রপ্তানি বন্ধ হয়ে যায়। তবে ইমিগ্রেশন চেকপোস্টের কার্যক্রম ছিল ২০০২ সাল পর্যন্ত।
এরপর জনপ্রতিনিধিদের প্রতিশ্রুতি, ভারত-বাংলাদেশের উচ্চ পর্যায়ে কয়েক দফায় বৈঠক করেও এখন পর্যন্ত বন্দরটির চালুর ব্যাপারে কোনো অগ্রগতি হয়নি।
যদিও ১১৭ শতাংশ জমির উপর মোগলহাট স্থলবন্দর ও ইমিগ্রেশন চেকপোস্ট কার্যক্রম পরিচালনার জন্য নির্মিত স্থাপনা ভঙ্গুর অবস্থায় পড়ে আছে।
বন্দরটি আবার চালু করা হলে ভারত-বাংলাদেশের ব্যবসা-বাণিজ্যে নতুন দ্বার উন্মোচিত হবে বলে সংশ্লিষ্টরা দাবি করছেন। সেইসঙ্গে খুলতে পারে চার দেশীয় ব্যবসা-বাণিজ্যের সম্ভাবনার নতুন দিগন্তও।
এতে বাণিজ্য বৃদ্ধির পাশাপাশি আমদানি-রপ্তানিতে কমবে খরচ। পরিবর্তন হবে লালমনিরহাট তথা উত্তর জনপদের অর্থনৈতিক চিত্রপট; সৃষ্টি হবে হাজারও মানুষের কর্মসংস্থান।
স্থানীয়রা জানান, লালমনিরহাট শহর থেকে মোগলহাটের দূরত্ব ১০ কিলোমিটার। আর মোগলহাট থেকে ভারতের কোচবিহার জেলার দিনহাটা থানাধীন গীতালদহের দূরত্ব প্রায় তিন কিলোমিটার। মোগলহাট-গীতালদহের মাঝ দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে ধরলা নদী। এই নদীর উপর রয়েছে প্রায় এক কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের একটি রেলসেতু।
১৯৮৮ সালের বন্যায় লালমনিরহাট সদর উপজেলার মোগলহাট রেলওয়ে স্টেশন ও ধরলা নদীর উপর ভারতীয় অংশে নির্মিত ধরলা রেল সেতুর সংযোগ অংশটি নদীগর্ভে বিলীন হলে দুদেশের যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়।
তার আগ পর্যন্ত মোগলহাট স্টেশন, লালমনিরহাট রেল স্টেশন ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গের কুচবিহার জেলার দিনহাটা গীতালদহ রেল স্টেশনের মধ্যে মালবাহী ট্রেন চলাচল অব্যাহত ছিল। যার প্রমাণ লালমনিরহাট বিভাগীয় রেলওয়ে ব্যবস্থাপকের (ডিআরএম) কার্যালয়ে সংরক্ষিত আছে।
মোগলহাট রেলওয়ে স্টেশন এলাকার আজিজুল ইসলাম (৬৫) নামে এক ব্যক্তি বলেন, “একসময় মোগলহাট দিয়ে ট্রেনে করে ভারতে যাওয়া যেত। কিন্তু ৮৮ সালের বন্যায় রাস্তা ভেঙে যাওয়ায় মোগলহাট বন্দরটি বন্ধ হয়ে যায়। দীর্ঘদিন ধরে এলাকার লোকজন জনপ্রতিনিধিদের কাছে দাবি তুললেও সেটি এখন পর্যন্ত বাস্তবায়ন হচ্ছে না।”
পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের লালমনিরহাট বিভাগীয় রেলওয়ে ব্যবস্থাপক (ডিআরএম) আব্দুস সালাম বলেন, মোগলহাট রেলওয়ে স্টেশনসহ সব কিছুই এখন পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে। স্থলবন্দরসহ রেল চালুর বিষয়ে দেওয়ার মত কোনো তথ্য নেই বলে জানান তিনি।
আলী হোসেন নামে মোগলহাট বাজারের এক ব্যবসায়ী বলেন, “যখন মোগলহাট বন্দরটি চালু ছিল তখন এখানে মানুষের আনাগোনায় প্রাণচাঞ্চল্য ছিল। এখন আর মোগলহাটের সেই আগের জৌলুস নেই।”
লালমনিরহাটের সামাজিক সংগঠন ‘অতিক্রম’ এর আহ্বায়ক হেলাল হোসেন কবির বলেন, “২০১৭ সাল থেকেই মোগলহাট স্থলবন্দর চালুর জন্য মানববন্ধন, গোলটেবিল বৈঠক, সাইকেল শোভাযাত্রাসহ বিভিন্নভাবে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করে আসছি।”
তিনি বলেন, “এটি চালু হলে এই এলাকার মানুষের যেমন কর্মসংস্থান তৈরি হবে পাশাপাশি বদলে যাবে অবহেলিত লালমনিরহাটের অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপট। তাই এটি দ্রুতই চালু হওয়া দরকার।”
লালমনিরহাট চেম্বারের সহসভাপতি মোড়ল হুমায়ুন কবির বলেন, “২০১৭ সালের ২৪ মে ঢাকার সোনারগাঁও হোটেলে বাংলাদেশ-আন্তর্জাতিক বিজনেস ফোরামের সভায় মোগলহাট স্থলবন্দর ও ইমিগ্রেশন চেকপোস্ট পুনরায় চালুর বিষয়ে আলোচনা হয়।”
ব্যবসায়ীদের আলোচনা ও দাবির পরিপ্রেক্ষিতে মোগলহাট স্থলবন্দর ও ইমিগ্রেশন চেকপোস্ট পুনরায় চালুর জন্য ২০১৭ সালের ৩ জুন বাংলাদেশে নিযুক্ত তৎকালীন ভারতীয় হাই কমিশনারকে একটি চিঠি দেন লালমনিরহাট-৩ আসনের সংসদ সদস্য ও জাতীয় পার্টি বর্তমান চেয়ারম্যান জিএম কাদের।
তার চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের কুচবিহার জেলার তৎকালীন তৃণমূল সংসদ সদস্য পার্থ প্রতিম রায় ভারতীয় লোকসভায় বিষয়টি উপস্থাপন করেন।
এর আগে ১৯৯৬ সালে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা লালমনিরহাটে এক নির্বাচনী জনসভায় মোগলহাট রেল স্টেশন, চেক পোস্ট ও ইমিগ্রেশন চালুসহ শুল্ক স্টেশন স্থাপনের বিষয়ে ঘোষণা দেন।
এরপর জাতীয় রাজস্ব বোর্ড ১৯৯৬ সালের ২৮ জুলাই ১৬৭৭/৩৪ নম্বর প্রজ্ঞাপনে মোগলহাটকে রেলরুট ঘোষণা করে সব ধরনের মালামাল স্থলশুল্ক স্টেশনের মাধ্যমে ভারত ও মায়ানমার সীমান্ত থেকে বাংলাদেশে আনার অনুমতি দেয়। এ ছাড়া মন্ত্রণালয়ের সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের পক্ষ থেকে ২০২২ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয় ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে মোগলহাট স্থলবন্দর চালুকরণের বিষয়ে সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের জন্য একটি চিঠিও দেওয়া হয়।
সবশেষ দিল্লিতে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির অনুষ্ঠিত দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে সম্পাদিত সমঝোতা স্মারকে মোগলহাট ও গীতালদহের মধ্যে পুনরায় রেল যোগাযোগ চালুর বিষয়টি উল্লেখ করা হয়েছে বলে লালমনিরহাট চেম্বারের মোড়ল হুমায়ুন কবির জানিয়েছেন।
জেলার চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের সভাপতি শেখ আব্দুল হামিদ বাবু বলেন, “ব্রিটিশ আমল থেকেই মোগলহাট স্থলবন্দরটি চলমান থাকায় ভারতের কোলকাতার সহজ যোগাযোগ মাধ্যম ছিল। এটি বন্ধ থাকায় এখানকার লোকজন প্রায় ৪০০ কিলোমিটার ঘুরে কোলকাতায় যাচ্ছেন। মোগলহাট-গীতালদহ রুটটি ভারতের কোচবিহার, আসাম, নেপাল ও ভুটানের সঙ্গে যোগাযোগেরও সহজ মাধ্যম।
“এই রুট পুনরায় চালু হলে খুব সহজে কম খরচে ভারত ও ভুটান থেকে পাথর, কয়লা, ডলোচুনসহ পণ্য আমদানি করা যাবে। এতে ব্যবসা-বাণিজ্যের ব্যাপক প্রসার ঘটবে। স্থলবন্দরটি চালু হলে ব্যবসায়ীরা যেমন লাভবান হবেন; তেমনি সরকারও রাজস্ব পাবে। পাশাপাশি ব্যবস্থা হবে কয়েক হাজার মানুষের কর্মসংস্থানের।”
লালমনিরহাট চেম্বারের সাবেক সভাপতি ও এফবিসিসিআইয়ের সাবেক পরিচালক মো. সিরাজুল হক বলেন, “স্থলবন্দরটি চালু হলে ব্যবসার ক্ষেত্রে এগিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি ইমিগ্রেশন চালু হলে ভারতে যাতায়াত ব্যবস্থাও সহজ হবে। লালমনিরহাটে মানুষ চায় দ্রুত স্থলবন্দরটি চালু হোক।”
লালমনিরহাট পৌরসভার মেয়র রেজাউল করিম স্বপন বলেন, “মোগলহাট স্থলবন্দরটি চালু হলে এই জেলার অর্থনৈতিক উন্নয়নসহ আমূল পরিবর্তন ঘটবে।”
একই অভিমত জানিয়েছেন লালমনিরহাট সদর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান কামরুজ্জামান সুজন।
মোগলহাট শুল্ক ও স্থলবন্দর চালুর ঘোষণার বাস্তবায়নের জন্য দীর্ঘদিন থেকে লালমনিরহাট ও কুচবিহার জেলার মানুষ, বিশেষ করে ব্যবসায়ীরা নিজ নিজ দেশে আন্দোলন করে আসছেন। তারা মোগলহাট ও গীতালদহের মধ্যে রেল যোগাযোগ পুনরায় চালুর দাবি করছেন।
লালমনিরহাট জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ উল্যাহ বলেন, এ বিষয়ে ২০২২ সালের ২৯ অগাস্ট লালমনিরহাটের তখনকার জেলা প্রশাসক মো. আবু জাফর স্বাক্ষরিত একটি চিঠি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব বরাবর পাঠানো হয়। ওই চিঠিতে মোগলহাট চেকপোস্টকে স্থলবন্দরে রূপান্তরকরণ বিষয়ে মতামত দেন জেলা প্রশাসক।
চিঠিতে আরও বলা হয়, দি ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রির-এফবিসিসিআই লালমনিরহাট শাখার উদ্যোগে চার দেশীয় বিজনেস ডেলিগেশন (বিবিআইএন) এর সভা ২০১৬ সালে ১৫-১৭ জুলাই ভারতের কোলকাতা ও শিলিগুড়িতে অনুষ্ঠিত হয়। ওই সভায় দ্বিপাক্ষিক ব্যবসা-বাণিজ্য বৃদ্ধির বিষয়টি আলোচনা হয়। সেখানে মোগলহাট স্থলবন্দরটি চালু হলে ভারতের সাতটি অঙ্গরাজ্যে, নেপাল ও ভুটানের সাথে বাংলাদেশের যোগাযোগ ও ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ঘটবে। এ বন্দর দিয়ে ভারতের পাথর, কয়লা ও ডলোমাইটসহ আমদানি রপ্তানি সহজ হবে।
ডিসি মোহাম্মদ উল্যাহ আরও বলেন, মোগলহাট স্থলবন্দর ও ইমিগ্রেশন চেকপোস্ট পুনরায় চালু করতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে যোগাযোগ অব্যাহত আছে। বন্দরটি চালু করতে জেলা প্রশাসন গুরুত্ব দিয়ে কাজ করছে।