Published : 03 Jan 2024, 12:56 PM
আওয়ামী লীগের ‘ভোট ব্যাংক’ হিসেবে পরিচিত ব্রাহ্মণবাড়িয়া-১ আসনে বিএনপি থেকে বহিষ্কৃত সৈয়দ এ কে একরামুজ্জামানের সঙ্গে নৌকার প্রার্থী বি এম ফরহাদ হোসেন সংগ্রামের শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতার আভাস মিলছে।
বিএনপিবিহীন এ নির্বাচনে দলটির নাসিরনগর উপজেলার প্রধান নেতৃত্বের বাইরে তৃণমূলের সবটাই প্রায় একরামুজ্জামানের পক্ষে প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে মাঠে রয়েছে।
‘বিএনপির’ একরাম আওয়ামী লীগের ফরহাদ-বিরোধী অংশটিকেও এক করতে পেরেছেন বলে ভোটারদের ভাষ্য। তারা বলছেন, এ আসন থেকে ফরহাদ ছাড়াও আটজন নৌকার মাঝি হতে চেয়েছিলেন। এই আটজনের মধ্যে চার-পাঁচজন প্রকাশ্যেই একরামুজ্জামানকে শক্তি যোগাচ্ছেন। মাঠে এমন আওয়াজও আছে, তার জন্যই জাতীয় পার্টির প্রার্থী মুহাম্মদ শাহানুল করিম সরে গেছেন।
শিল্পপতি একরামুজ্জামানের এলাকায় শিল্প গড়ে তোলা এবং কর্মসংস্থানের বিষয়টিও তরুণদের আকৃষ্ট করছে বলে মনে করছেন অনেকে।
দুই মেয়াদে প্রায় ছয় বছর সংসদ সদস্য ছিলেন ফরহাদ হোসেন সংগ্রাম। এই সময়ে তৃণমূলের নেতাকর্মীদের সঙ্গে দূরত্ব তাকে এবারের ভোটে ভোগাবে বলে মনে করছেন আওয়ামী লীগের একটি অংশ।
২০১৭ সালের ১৬ ডিসেম্বর ছায়েদুল হক মারা গেলে পরের বছর ১৩ মার্চ উপ-নির্বাচনে ফরহাদ হোসেন সংগ্রাম আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে এই আসনে প্রথমবারের মত বিজয়ী হন। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও ফরহাদ হোসেন সংগ্রাম বিএনপির প্রার্থী, দলটির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা একরামুজ্জানকে হারিয়ে দ্বিতীয়বারের মত সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।
হাওর বেষ্টিত নাসিরনগরে এবারের নির্বাচনে মোট পাঁচজন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। অন্য তিনজন হলেন- জাতীয় পার্টির মুহাম্মদ শাহানুল করিম, বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্টের মো. ইসলাম উদ্দিন (মোমবাতি প্রতীক) ও ওয়ার্কার্স পার্টির মোহাম্মদ বকুল হোসেন (হাতুড়ি)।
শাহানুল করিম অবশ্য এরই মধ্যে একরামকে সমর্থন দিয়ে মাঠ ছেড়ে দিয়েছেন। অন্য দুজনও তেমন কোনো প্রচারে নেই বলেই এলাকাবাসী জানান।
রোববার নাসিরনগর উপজেলা সদরের কয়েকটি এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, একরামুজ্জামানের কলার ছড়ি আর নৌকার পোস্টারেই সয়লাব। ফরহাদ হোসেন সংগ্রাম আর একরামুজ্জামান দুজনই সকাল থেকে রাত পর্যন্ত উঠান বৈঠক, গণসংযোগ, মিছিল করছেন। দুপুরের পর থেকে চলছে মাইকিং।
১৩টি ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত এই আসনের ভোটার সংখ্যা ২ লাখ ৫২ হাজার ৫৪৭ জন। এর মধ্যে পুরুষ ভোটার ১ লাখ ৩৩ হাজার ১০৯ জন, মহিলা ভোটার ১ লাখ ১৯ হাজার ৪৩৬ জন এবং হিজড়া ২ জন। এর মধ্যে হিন্দু সম্প্রদায়ের ভোট আছে ৬০ হাজার।
নাসিরনগরে সবসময়ই আওয়ামী লীগের অবস্থান শক্ত। এখানে উল্লেখযোগ্য হিন্দু সম্প্রদায়ের ভোট রয়েছে। আওয়ামী লীগের সেই ভোট ব্যাংক ফরহাদের পক্ষে অটুট থাকবে এমনটা মনে করেন তার অনুসারীরা।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া-১ (নাসিরনগর) আসনটি ১৯৯৬ সালের পর থেকে আওয়ামী লীগের দখলে। ২০০১ সালের নির্বাচনে চট্টগ্রাম বিভাগে আওয়ামী লীগের বিপর্যয়ের সময়ও বর্ষীয়ান আওয়ামী লীগ নেতা ও সাবেক মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী অ্যাডভোকেট ছায়েদুল হক এই আসন থেকে বিজয়ী হয়েছিলেন। তিনি মোট পাঁচবার এই আসনের সংসদ সদস্য ছিলেন।
কিন্তু এবারের নির্বাচনি মাঠে আওয়ামী লীগের বিভেদ একরামুজ্জামানকে বিশেষ সুবিধা দেবে বলেই মনে করছেন অনেকে।
আওয়ামী লীগের মনোনয়ন বঞ্চিত তিন নেতা কৃষক লীগের অর্থ সম্পাদক নাজির মিয়া, তার স্ত্রী নাসিরনগর উপজেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি রোমা আক্তার এবং নাসিরনগর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান এ টি এম মনিরুজ্জামান সরকার প্রকাশ্যে স্বতন্ত্র প্রার্থী একরামুজ্জামানের কলার ছড়ির পক্ষে মাঠে কাজ করছেন।
এর মধ্যে আওয়ামী লীগের প্রার্থী ফরহাদ হোসেন সংগ্রাম স্থানীয় এক সাংবাদিক ও একজন ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানকে দেখে নেওয়ার হুমকি দেওয়ায় ব্যাপক সমালোচিত হয়েছেন। নির্বাচনি আচরণবিধি লঙ্ঘনের দায়ে ২৪ ডিসেম্বর ফরহাদকে নির্বাচনি অনুসন্ধান কমিটি শোকজ করে।
তবে দলীয় বিভেদকে খুব একটা পাত্তা দিচ্ছেন না আওয়ামী লীগ প্রার্থী ফরহাদ হোসেন সংগ্রাম।
প্রকৃত আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা তার সঙ্গে আছেন এবং তিনি জয়ের ব্যাপারে শতভাগ আশাবাদী উল্লেখ করে বলেন, “স্বতন্ত্র প্রার্থীর কি কোনো দল আছে? আমি মাঠে ঘুরছি, আপনারাও মাঠে খবর নিয়ে দেখতে পারেন যারা ভোটার তারা আমার সঙ্গে আছেন।
তিনি আরও বলেন, “এদেশে তো অনেক লোক আওয়ামী লীগ থেকে নেমে গেছে। এতে আওয়ামী লীগের কিছু হয়েছে?”
নাসিরনগর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক ও উপজেলা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি আদেশ চন্দ্র দেব বলেন, “নাসিরনগরের জনগণ পরিবর্তন চাচ্ছে। বর্তমান সংসদ সদস্য ফরহাদ হোসেনের দুর্নীতি দুঃশাসনের কারণে আওয়ামী লীগের প্রার্থীকে সমর্থন করতে পারিনি। এখানে ত্যাগী নেতাকর্মীদের কোনো মূল্যায়ন নেই।
“এই কারণে আমিসহ অনেক নেতাকর্মীই স্বতন্ত্র প্রার্থীর নির্বাচন করছি,” বলেন আদেশ দেব।
নাসিরনগর উপজেলা পরিষদের সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান ও উপজেলা যুবলীগের সভাপতি অঞ্জন কুমার দেব বলেন, “বর্তমান এমপি ত্যাগী নেতাকমীদের মূল্যায়ন না করায় স্বতন্ত্র প্রার্থীর পক্ষে গেছেন অনেকেই। যুবলীগ-ছাত্রলীগ-আওয়ামী লীগের ৯৯ ভাগ নেতাকর্মী তার সঙ্গে নেই।”
নাসিরনগর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি অসীম কুমার পাল আবার অঞ্জন কুমার দেবের কথার সঙ্গে একমত নন।
তিনি বলছিলেন, “আওয়ামী লীগের অনেকেই কলার ছড়িতে গেছে, তা তো লুকানোর কিছু নেই। এখন অনেক বলতে আঙ্গুলে ফেলে গুনলে আমরা তো দুই-চার-পাঁচজন ছাড়া কাউকে পাই না। আওয়ামী লীগ তো একটা বিশাল ফ্যাক্টর। কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ থেকেও অনেক বড় বড় নেতা দল থেকে বেরিয়ে গেছেন, তাতে কি দলের কোনো ক্ষতি হয়েছে?
“দলের মধ্যে মতানৈক্য থাকতেই পারে কিংবা দলের মধ্যে গ্রুপিং-লবিং থাকতেই পারে। কিন্তু আওয়ামী লীগের আদর্শে বিশ্বাসী কোনো নেতাকর্মী স্বতন্ত্র প্রার্থীর নির্বাচন করতে পারেন না। তারা আদর্শহীন। চার-পাঁচজন ছাড়া বাকি সবাই নৌকার নির্বাচন করছেন,” বলেন অসীম কুমার।
নাসিরনগর পূজা উদযাপন পরিষদের সভাপতি ও নাসিরনগর উপজেলা আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক অনাথ বন্ধু দাস বলেন, “আমি নৌকার নির্বাচন করছি। আমরা বঙ্গবন্ধুর আদর্শের সৈনিক হিসেবে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তির সঙ্গে আছি। যারা আওয়ামী লীগের প্রার্থীকে ছেড়ে স্বতন্ত্র প্রার্থীর সঙ্গে গেছেন এটা তাদের ব্যক্তিগত ব্যাপার।”
দীর্ঘদিন বিএনপির রাজনীতি করা একরামুজ্জামান দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্য করে নির্বাচনে অংশ নেওয়ায় দল থেকে বহিষ্কার হন গত নভেম্বরে। তিনি আরএকে সিরামিকসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক। রোববার তিনি তার নির্বাচনি ইশতেহার ঘোষণা করেছেন।
এ সময় সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে একরামুজ্জামান বলেন, “বিগত সময়ে আওয়ামী লীগ বিএনপির বিরুদ্ধে আবার বিএনপি আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে মামলা করেছে। যারা ক্ষমতায় আছে তারা এসব মামলা করেছে। এসব রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মামলা। এসব মামলা থেকে সাধারণ মানুষকে রেহাই দিতে চাই।”