“মিনিমাম ২৫ লাখ টাকার বিজনেস করার কথা ছিল। কিন্তু চার ভাগের এক ভাগও বিক্রি হয়নি।”
Published : 25 Mar 2025, 11:50 AM
মিহি জমিনে সূক্ষ্ম নকশায় তৈরি ঐতিহ্যবাহী জামদানি শাড়ির চাহিদা শুধু দেশে নয়, বিদেশেও। ঈদে চাহিদাকে মাথায় রেখে নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ উপজেলায় জামদানি পল্লীর তাঁত ঘরগুলোতে কারিগররা তৈরি করছেন রঙবেরঙের নজরকাড়া নানা নকশার শাড়ি।
ঢাকা থেকে মাত্র ৩০ কিলোমিটার দূরে শীতলক্ষ্যার তীর ঘেঁষে রূপগঞ্জ উপজেলার নোয়াপাড়া গ্রামে বিসিক জামদানি শিল্প নগরীর অবস্থান। স্থানীয়দের কাছে এটি জামদানি পল্লী বলে পরিচিত। ঈদকে সামনে রেখে পল্লীর তাঁত ঘরগুলোতে কারিগরদের ব্যস্ততা বাড়লেও সেখানে ‘আশানুরূপ’ বিক্রি নেই বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
বিক্রিবাট্টা না থাকার কারণে হিসেবে সেখানকার ব্যবসায়ীরা বলছেন, জামদানি শাড়ির একশ্রেণীর ক্রেতা রয়েছে; যারা সারাবছরই এ শাড়ি কেনেন। ফলে ঈদকে ঘিরে তাদের কাছে জামদানির শাড়ির আলাদা কোনো চাহিদা থাকে না। এ কারণে ঈদের বাজারের সঙ্গে জামদানি পল্লীর বিক্রির তুলনা করলে চলবে না।
এছাড়া দেশের বিদ্যমান রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণেও জামদানির ক্রেতারা এমুখো ‘কম’ হচ্ছেন বলেও মনে করেন ব্যবসায়ীরা।
জামদানি পল্লীর প্রবেশমুখেই ‘আয়েশা জামদানি হাউস’। দোকানের ভেতরে মেঝেতে বাহারি রঙের ও নানা নকশার শাড়ি ছড়িয়ে একাই বসে থাকতে দেখা গেল মালিক জাহিদ হাসান জুয়েলকে। জামদানি শিল্পের সঙ্গে তৃতীয় প্রজন্ম হিসেবে জড়িত আছেন তিনি। নিজের তাঁতে তৈরি শাড়ি ছাড়াও অন্য তাঁত থেকেও শাড়ি কিনে দোকানে তুলেছেন। তবে, আশানুরূপ বিক্রি নেই বলে মন ভার তার।
জুয়েল বলেন, “সামনে ঈদ, পহেলা বৈশাখ; কিন্তু বিক্রি একেবারেই কম। এবার রোজায় ৩০ লাখ টাকা বিক্রির টার্গেট রেখেছিলাম। এখন পর্যন্ত ৩ লাখের মতো বিক্রি করতে পেরেছি।”
জুয়েল ছাড়াও অন্তত নয়জন জামদানি শাড়ি বিক্রেতার সঙ্গে কথা বলেছে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম। বিক্রি কম হওয়ায় তাদের সবার কণ্ঠেই হতাশার সুর।
জামদানি বিসিক শিল্পনগরীর কর্মকর্তা মো. জহিরুল ইসলাম বলছিলেন, ঢাকাই মসলিনের হাত ধরে এ অঞ্চলে জামদানির আগমন। জামদানি শিল্পকে এগিয়ে নিতে বিংশ শতাব্দীর শুরুতে ২০ একর জমির ওপর এ শিল্পনগরের কার্যক্রম শুরু হয়। যদিও উদ্যোগ ছিল নব্বইয়ের দশকের শুরু থেকেই।
বিসিকের জামদানি শিল্পনগরীর কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পুরো শিল্পনগরীতে ৪০৭টি প্লট আছে। প্রতি প্লটে অন্তত চারটা করে তাঁত আছে। এখানে প্রায় ১ হাজার ৬০০ তাঁতি নিয়মিত জামদানি শাড়ি তৈরি করেন।
প্রতি শুক্রবার ভোর থেকে এ পল্লীতে জামদানির হাট বসে। দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে পাইকারি ক্রেতারা আসেন জামদানির শাড়ি কিনতে। ভিড় জমান খুচরা ক্রেতারাও।
উৎসবের মৌসুম ছাড়াও এ হাট বেশ ‘জমজমাট’ থাকে বলে জানান স্থানীয়রা। তবে গত শুক্রবার হাটের চিত্র ছিল ভিন্ন। ক্রেতা সমাগম কম থাকায় সকাল ৮টার আগেই হাট মিলিয়ে যায়। ৯টার দিকে হাটে মাত্র তিনজন বিক্রেতাকে জামদানি শাড়ি নিয়ে বসে থাকতে দেখা যায়। তারা বলছিলেন, এবার ঈদের আগে বাজার একেবারেই ‘মন্দা’।
হাট কমিটির সদস্য কামরুল হাসান বলেন, “ঈদের আগে হাটে এত কম ক্রেতা সমাগম আর কোনো বছর দেখি নাই।”
একটি দোকানে শাড়ির দরদাম করতে দেখা গেলো দুই নারীকে। রেহানা পারভীন নামে তাদের একজন বলেন, এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে তার ননদের বিয়ে। তাকে উপহার হিসেবে জামদানি শাড়ি দেবেন বলে পল্লীতে এসেছেন।
তবে ঈদের বাজার মন্দা হওয়ার কারন হিসেবে ‘নকশী জামদানি উইভিং ফ্যাক্টরির’ মালিক সহিম হাসান বলছিলেন, “জামদানি শাড়ির ক্রেতারা কিন্তু উচ্চ মধ্যবিত্ত থেকে উচ্চবিত্ত পরিবারের লোকজন। তারা কিন্তু ঈদে জামদানি কেনেন, ব্যাপারটা এমন না। বরং ঈদের সময় জামদানি নিয়ে তাদের চাহিদা কম থাকে। সে কারণে ঈদের বাজারের সঙ্গে জামদানি পল্লির বিক্রির তুলনা করলে চলবে না।”
“তাছাড়া, দেশের বিদ্যমান রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে জামদানির ক্রেতারা এমুখো কম হচ্ছেন”, বলেও মনে করেন এ জামদানি ব্যবসায়ী।
নোয়াপাড়ার বাসিন্দা সহিমের দাদা নোয়াব আলীও ছিলেন জামদানির কারিগর। তার হাত ধরেই এ ব্যবসায় পদার্পণ তাদের।
সহিম বলেন, তার নিজের ৩০টি তাঁতে ৬০ জন কারিগর কাজ করেন। তার কাছে অধিকাংশ শাড়িই ৮০ থেকে ১০০ কাউন্টের বোনা। যেগুলোর দাম শুরুই হয় ৫০ হাজার টাকা থেকে।
তবে, তারও যে লক্ষ্য অনুযায়ী বিক্রি কম, কথাটি জানাতেও ভোলেননি। তিনি বলেন, “মিনিমাম ২৫ লাখ টাকার বিজনেস করার কথা ছিল। কিন্তু তার চার ভাগের এক ভাগও বিক্রি হয়নি।”
বিক্রিবাট্টা কম থাকলেও তাঁতঘরে কারিগরদের ব্যস্ততা কমেনি। দম ফেলার ফুরসত নেই তাদের। ব্যস্ততার মাঝেও কয়েকজন জামদানি কারিগরের সঙ্গে কথা বলেছে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম।
তাঁত পল্লীর ভেতরে লাল রঙের সুতোয় তৈরি শাড়ির ওপর সোনালি নকশা ফুটিয়ে তুলছিলেন ২৫ বছর বয়সী মো. হাসান। চাঁদপুরের এ বাসিন্দা ১২ বছর বয়স থেকে জামদানি শাড়ি বুনতে পারেন। তিনি যে শাড়িটি বুনছিলেন সেটি ৮০ কাউন্টের (সুতার পুরত্ব বা কোয়ালিটিকে বুঝায়) বলে জানালেন।
হাসান বলেন, “আমাদের আসলে ঈদ বা উৎসব বলতে কিছু নাই। মহাজনের কাছে বছর ভইরা অর্ডার আসতেই থাকে। তাছাড়া একটা শাড়ি বুনতে অনেক সময়, এক মাসেরও বেশি লাগে। দোকানের বিক্রির সঙ্গে আমাগো কাজের ব্যস্ততার কোনো সম্পর্ক নাই। আমাগো বছর ভইরাই কাজ থাকে।”
পল্লীর ২ নম্বর গলিতে একটি তাঁতে কাজ করছিলেন ৫০ বছর বয়সী মোবারক হোসেন। ২০ বছর ধরে জামদানি শাড়ি বুননের কাজে জড়িত এ কারিগর বলেন, “কাজের চাপ অনেক। বেচাকেনার কথা তো কইতে পারে মহাজন।”
তাঁতী ও ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, সুতার কাউন্ট অনুযায়ী জামদানির মান ও দাম নির্ধারিত হয়। কাউন্ট যত বেশি সুতা তত চিকন এবং সেই সুতার তৈরি শাড়ির দামও তত বেশি। শাড়ির উপর নকশাও দামের তারতম্য নির্ধারণ করে। এই পল্লীতে ৩০ থেকে ১০০ কাউন্টের জামদানি তৈরি হয়। জামদানি শাড়ি ছাড়াও থ্রি-পিস এবং পুরুষদের পাঞ্জাবিও বিক্রি হয় এখানে।
পল্লীতে থাকা নিজের দোকানের পাশাপাশি অনলাইনেও জামদানি বিক্রি করেন ব্যবসায়ী আনোয়ার হোসেন। ‘অফলাইন ও অনলাইন’ দুই জায়গাই বিক্রি কম বলে জানান তিনি।
জামদানি বিক্রি কম থাকায় সুতার বিক্রিও কম বলে জানালেন রাজু শেখ নামে এক সুতা সরবরাহকারী।
কারিগরদের সঙ্গে কথা বলার ফাঁকে পল্লীতে মো. সাকিব নামের একজনকে পাইকারি দরে জামদানি কিনতে দেখা গেল। ঢাকার গুলশানে তার জামদানি শাড়ির দোকান রয়েছে বলে জানালেন।
তিনি বলছিলেন, “ঈদে অন্যান্য পোশাকের চাহিদা বেশি থাকলেও জামদানির চাহিদা থাকে কম। কেননা, জামদানির দাম বেশি। মূলত এটি একটি শৌখিন পোশাক। আর তাছাড়া, দেশের পরিস্থিতির কারণেও হয়তো এবার চাহিদা আরও কম।”