“দুর্যোগে জলোচ্ছ্বাস বা অতিবৃষ্টির ফলে প্রথম ক্ষতিগ্রস্ত হয় সব স্বাদু পানির আধার। দেখা দেয় সুপেয় পানির সংকট। এবার রেমালের পরও একই সংকট দেখা দিয়েছে।”
Published : 22 Jun 2024, 01:36 AM
সাতক্ষীরার শ্যামনগরের গাবুরা ইউনিয়নের মানুষের খাবারের পানি সংগ্রহের একমাত্র সহজ উৎস ‘দৃষ্টিনন্দন’ নামের একটি পুকুর। কিন্তু ঘূর্ণিঝড় রেমালের প্রভাবে তাও লবণাক্ত হয়ে পড়ায় চরম সংকটে পড়েছেন কয়েক গ্রামের মানুষ।
এটা সেই অবস্থা, যেখানে চারদিকে চোখ মেললেই শুধু পানি আর পানি, কিন্তু পানের জন্য এক ফোঁটাও নেই।
মে মাসের শেষে ঘূর্ণিঝড় রেমাল সুন্দরবন ও সংলগ্ন এলাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় নানারকম ক্ষতি করে গেছে। তবে সাতক্ষীরার উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষের সবচেয়ে বড় ক্ষতি হয়েছে পুকুরগুলোর পানি লবণাক্ত হয়ে পড়ায়।
গাবুরা ইউনিয়নের ১৫টি গ্রামের মধ্যে ১১টিতেই খাওয়ার পানির তীব্র সংকট চলছে বলে জানালেন চেয়ারম্যান জি এম মাকসুদুল আলম।
তিনি বলেন, ইউনিয়নের ৪২ হাজার মানুষের মধ্যে অন্তত ৩৬ হাজার সুপেয় পানির সংকটে রয়েছে। চাঁদনিমুখা, ডুমুরিয়া, খলশিবুনিয়া, হেতালবুনিয়া, চকবারা, সোরা ও পার্শ্বেমারী গ্রামের নারীরা অনেক দূর থেকে হেঁটে খাওয়ার পানি সংগ্রহ করেন।
শ্যামনগর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান প্রভাষক সাইদ-উজ জামান বলেন, শ্যামনগরের দুর্গাবাটি, গোলাখালিসহ বহু এলাকায় পানির তীব্র সংকট চলছে। সুপেয় পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় এ অঞ্চলের নলকূপগুলো কাজে লাগে না। মানুষ প্রধানত উন্মুক্ত জলাশয় থেকে খাবার ও গৃহস্থালির পানি সংগ্রহ করেন। কিন্তু রেমালের প্রভাবে তাও খাবার অযোগ্য হয়ে পড়েছে।
বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থাগুলোর তথ্য অনুযায়ী, সাতক্ষীরার নদী উপকূলের প্রায় সাত লাখ মানুষ বর্তমানে সুপেয় পানির কষ্টে আছে।
এ অঞ্চলের সুপেয় পানির সঙ্কট নিয়ে ২০২১ সালে জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির (ইউএনডিপি) আওতায় একটি জরিপ পরিচালনা করা হয়। তাতে দেখা যায়, সাতক্ষীরার আশাশুনি ও শ্যামনগর উপজেলায় বসবাসকারী ৭৩ শতাংশ মানুষ অনিরাপদ লবণাক্ত পানি পান করছেন।
অন্যদিকে বাংলাদেশ মৃত্তিকা সম্পদ ইনস্টিটিউটের এক গবেষণা বলছে, দেশের উপকূলবর্তী প্রায় ৫৩ শতাংশ অঞ্চল সরাসরি লবণাক্ততায় আক্রান্ত।
সাতক্ষীরা, বাগেরহাট ও খুলনা- এই তিন জেলার উপকূলীয় মানুষের সুপেয় পানির সঙ্কট বহুদিনের। এসব অঞ্চলে জলাশয় এবং গভীর নলকূপের মত উৎস থাকলেও ভৌগোলিক কারণেই মাত্রাতিরিক্ত আর্সেনিক, লবণাক্ততা ও আয়রনের কারণে তা পানের উপযোগী নয়। সুপেয় পানির জন্য সবসময়ই ভোগান্তিতে পড়তে হয়।
সাতক্ষীরার আশাশুনি ও শ্যামনগর উপজেলার বাসিন্দারা জানান, তাপমাত্রা যখন বাড়ে, পানির উৎসগুলো শুকিয়ে যায়, তখনও তাদের সমস্যায় পড়তে হয়।
তখন তারা বৃষ্টির জন্য আকাশের দিকে চেয়ে থাকেন। ভালো বৃষ্টি হলে পানি ধরে রাখতে পারেন। সেই পানি দিয়ে বছরের একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত তারা কষ্ট করে হলেও চলতে পারেন।
আবার ভারি বৃষ্টি বা ঝড়-জলোচ্ছ্বাস হলেও বাঁধ ভেঙে বা বিভিন্ন চিংড়ি ঘেরের লবণাক্ত পানি উপচে স্বাদু পানির উৎস নষ্ট হয়। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এ দুটো সমস্যা দিন দিন প্রকট আকার ধারণ করছে।
এসব অঞ্চলে মিঠা বা স্বাদু পানির একটি বড় উৎস হল জমিয়ে রাখা বৃষ্টির পানি। কিন্তু এবার সেভাবে বৃষ্টির দেখা না মেলায় উন্মুক্ত জলাশয়ের ওপরই তাদের নির্ভর করতে হচ্ছি।
সেই পানি সংগ্রহ করাও যেন রীতিমতো এক সংগ্রাম। সবচেয়ে কাছের পুকুর থেকে পানি আনতেও বহু গ্রামের মানুষকে প্রতিদিন কলসি নিয়ে পাড়ি দিতে হয় মাইলের পর মাইল।
সেই কষ্টের মধ্যেই এসেছে রেমাল। জলোচ্ছ্বাসে পানি উন্নয়ন বোর্ডের আওতাধীন ৬৭৩ কিলোমিটার বেড়িবাঁধের মধ্যে প্রায় ২৩ কিলোমিটার মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সেই ভাঙা অংশ দিয়ে পানি ঢুকে প্লাবিত হয়েছে গ্রামের পর গ্রাম। সঙ্গে নষ্ট হয়ে গেছে সুপেয় পানির আধার।
হরিনগর গ্রামের রমেছা বেগম বলেন, সংকট যে শুধু খাবার পানিতে, তেমন নয়। থালা-বাসন মাজা, ধোয়া-মোছা, গোসল, শৌচকার্য সব পানিরই তীব্র অভাব।
“যারা এ সংকটের মুখোমুখি হয়নি, তারা বুঝতেও পারবে না কতটা কষ্টে আছে দক্ষিণ উপকূলের সাধারণ মানুষ।”
দাতিনাখালী গ্রামের শেফালী বেগম বলেন, রেমালের সময় ঝড়ের সঙ্গে অতিবৃষ্টিতে ঘেরগুলো প্লাবিত হয়। বহু জায়গায় ওই ঘেরের লবণাক্ত পানি ঢুকে পড়ে শুকিয়ে যাওয়া বিভিন্ন পুকুরে। সেসব পুকুরের লবণাক্ত ও অস্বাস্থ্যকর পানি নিয়ে রান্না ও গোসলের কাজে ব্যবহার করে অসুস্থ হচ্ছে মানুষ।
লবণাক্ততার স্বাস্থ্য ঝুঁকি
• বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা প্রতিদিন সর্বোচ্চ ৫ গ্রাম লবণ খাওয়ার পরামর্শ দেয়। সেটি আসে খাদ্য ও পানি থেকে। আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশ (আইসিডিডিআরবি), ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং লন্ডনের ইম্পেরিয়াল কলেজের এক যৌথ গবেষণায় দেখা গেছে, উপকূলের মানুষ কিছু ক্ষেত্রে ২০০ গুণ বেশি লবণ খায়।
• বেশি লবণ খাওয়ার সঙ্গে উচ্চ রক্তচাপের সম্পর্ক রয়েছে, যা হৃদ্রোগের ঝুঁকি বাড়ায়। নিয়মিত লবণাক্ত পানি পান ও ব্যবহারে চর্মরোগ ও পেটের পীড়ার মত সমস্যা দেখা দিতে পারে।
• ২০১৯ সালে বিশ্ব ব্যাংকের এক গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকার ২০ শতাংশ নারী লবণাক্ততার কারণে অকালগর্ভপাতের শিকার হন।
• আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণাকেন্দ্র বাংলাদেশের (আইসিডিডিআরবি) এক গবেষণায় দেখা গেছে, লবণাক্ততার কারণে উপকূলের নারীরা কেবলে অকালগর্ভপাতেরই শিকার হন না, ৩ শতাংশ শিশুও মারা যায়।
বাগেরহাটের উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষের সুপেয় পানির একটি অন্যতম প্রধান উৎস জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল বিভাগের সোলার পিএসএফ (পন্ড স্যান্ড ফিল্টার)। এটি পরিচালনার জন্য পুকুর লাগে। বাগেরহাটে পিএসএফ ভালো কাজ করছে।
কিন্তু সাতক্ষীরায় পিএসএফ কাজ করে না বলে জানালেন হরিনগর গ্রামের কয়েকজন বাসিন্দা। কারণ সেখানে পুকুরই লবণাক্ত হয়ে পড়েছে; ফলে পানি তোলার সুযোগ নেই।
বাগেরহাট ও খুলনা অঞ্চলে অনেক মানুষ বোতলে বিক্রি করা পানি পান করেন। কিন্তু সাতক্ষীরার উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষ অন্য দুই জেলার তুলনায় অনেক দরিদ্র। তাদের পক্ষে সারাবছর পানি কিনে খাওয়া সম্ভব হয় না।
হরিনগর গ্রামের অসিত মল্লিক বলেন, “একটু অবস্থাপন্ন মধ্যবিত্ত ও তার উপরের শ্রেণির যেসব মানুষ বিভিন্ন কোম্পানির বোতলজাত পানি কিনে খেতেন, তারাও সংকটে পড়েছেন। কারণ লোডশেডিংয়ের কারণে সেই পানি উৎপাদনও ব্যাহত হচ্ছে।”
পানি অধিকার আন্দোলনের নেতা ও সুশীলনের পরিচালক মোস্তফা আক্তারুজ্জামান বলেন, সাতক্ষীরার শ্যামনগর, আশাশুনি, কালিগঞ্জসহ দেশের দক্ষিণ উপকূলীয় লোনা অঞ্চলে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর অনেক নেমে গেছে। কোথাও যদিবা পানি ওঠে, সেটা পানের অযোগ্য। এর মধ্যে প্রতি বছর অন্তত দুই তিনবার দুর্যোগ হানা দেয়।
“দুর্যোগে জলোচ্ছ্বাস বা অতিবৃষ্টির ফলে প্রথম ক্ষতিগ্রস্ত হয় সব স্বাদু পানির আধার। দেখা দেয়, সুপেয় পানির সংকট। এবার রেমালের পরও একই সংকট দেখা দিয়েছে।”
সাতক্ষীরার পানি কমিটির সভাপতি অধ্যক্ষ আশেক-ই এলাহী বললেন, “পানির সংকট বর্তমানে মানুষের বাঁচা-মরার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ সংকট হয়তো সরাসরি সরকারের কাছে দৃশ্যমান হচ্ছে না। কিন্তু নিকট ভবিষ্যতে মানুষের এই সংকট স্থানীয়দের বৃহত্তম স্বাস্থ্যহানির কারণ হয়ে দেখা দেবে।”
এ অবস্থা একদিনে তৈরি হয়নি। উপকূলীয় অঞ্চলে লবণাক্ততা বন্ধে পাকিস্তান আমলে বেড়িবাঁধ করা হয়েছিল। কিন্তু ঘূর্ণিঝড় সিডর ও আইলার পর অনেক জায়গায় বাঁধ ভেঙে যায়।
এছাড়া চিংড়ি চাষের জন্য অনেকে বাঁধ কেটে ঘের এলাকায় লবণপানি প্রবেশ করান। তাতে গুটিকয়েক চিংড়িচাষি লাভবান হলেও এলাকার বেশির ভাগ বাসিন্দার জীবন-জীবিকা হুমকিতে পড়ে।
এ ছাড়া জলবায়ু পরিবর্তন, প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও অপরিকল্পিতভাবে ভূ-গর্ভস্থ পানি উত্তোলন করা হয়েছে। তার ওপর সরকারি বিভিন্ন উদ্যোগেরও তদারকির অভাব রয়েছে।
সবকিছু মিলিয়ে দিনকে দিন পরিস্থিতি আরও জটিল আকার ধারণ করছে বলে মনে করেন স্থানীয় পরিবেশ কর্মীরা।
জেলার ২৫-৩০ শতাংশ মানুষ সুপেয় পানির কষ্টে আছে জানিয়ে সাতক্ষীরা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. শহীদুল ইসলাম বলেন, সুপেয় পানি সংকট নিরসনে ৭৫ কোটি টাকা ব্যয়ে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ প্রকল্পের কাজ চলছে। ২০২৬ সালে কাজ শেষ হওয়ার কথা। এ প্রকল্পের ফলে জেলার অন্তত দুই লাখ মানুষ সুপেয় পানি সংগ্রহ করতে পারবে।
এদিকে সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ হুমায়ুন কবির বলছেন, “পানির যে সংকট সৃষ্টি হয়েছে এ মুহূর্তে তা পুরোপুরি দূর করা কঠিন। উপকূলবাসী বৃষ্টির পানির দিকে তাকিয়ে আছে।
“আসন্ন বৃষ্টি মৌসুমকে লক্ষ্য রেখে সবার মাঝে বড় ধরনের পানির জার সরবরাহ নিশ্চিত করতে সরকারের জনস্বাস্থ্য বিভাগকে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে। জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকেও মাঝে মাঝেই পানির সংকট দূর করতে পানির বড় জার প্রদান করা হয়ে থাকে।”