নাগরিকরা সুরমা নদী খননে বরাদ্দ ৫০ কোটি টাকা ব্যয়ের শ্বেতপত্র প্রকাশের কথাও বলেন।
Published : 06 Jun 2024, 12:29 AM
বিশ্ব পরিবেশ দিবসে আয়োজিত এক আলোচনায় সিলেট নগরীর উন্নয়ন পরিকল্পনা নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করা হয়েছে।
বুধবার ধরিত্রী রক্ষায় আমরা-ধরা ও সুরমা রিভার ওয়াটার কিপারের উদ্যোগে গোলটেবিল বৈঠকে এ ক্ষোভের প্রকাশ ঘটে।
নাগরিকেরা বলেন, নগরীর বন্যা ও জলাবদ্ধতা দূর করার নামে বহু আশার বাণী শোনানো হলেও সব অসার প্রমাণিত হয়েছে।
প্রাকৃতিক ছড়া ও খালকে ড্রেনে পরিণত করার খেসারত নাগরিকদের ভোগ করতে হচ্ছে। বক্স কালভার্ট নির্মাণে বিপদ তৈরি হচ্ছে।
নগরীর চারপাশের জলাভূমি ভরাট করে অপরিকল্পিতভাবে নগরায়ণ করা হচ্ছে।
বৈঠকে বন্যা ও জলাবদ্ধতায় নাকাল একাধিক নাগরিক ‘অপরিকল্পিত উন্নয়নে অর্থ বিনাশের’ অভিযোগ উত্থাপন করেন।
নাগরিকেরা সিলেট জেলার বন্যা ও মহানগরীর জলাবদ্ধতা নিরসনে বিজ্ঞানভিত্তিক উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণের দাবি জানান।
নাগরিকেরা সুরমা নদী খননের জন্য বরাদ্দ ৫০ কোটি টাকা ব্যয়ের শ্বেতপত্র প্রকাশের কথাও বলেন।
‘সিলেটের বন্যা: নাগরিক অভিজ্ঞতা ও করণীয়’ শীর্ষক এ গোলটেবিল বৈঠকের সভাপতিত্ব করেন ধরিত্রী রক্ষায় আমরার কেন্দ্রীয় আহ্বায়ক কমিটির সদস্যসচিব শরীফ জামিল।
বুধবার পরিবেশ দিবসে স্থানীয় একটি হোটেলের সম্মেলন কক্ষে গোলটেবিল বৈঠকের সূচনা বক্তব্য দেন পরিবেশ আন্দোলনের সংগঠক সুরমা রিভার ওয়াটারকিপার আব্দুল করিম কিম।
আলোচক হিসেবে অংশগ্রহণ করেন সিলেট সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী, আওয়ামী লীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক মিসবাহ উদ্দিন সিরাজ, প্রবীণ রাজনীতিবিদ মোহাম্মদ সফিক, পরিবেশ ও ঐতিহ্য সংরক্ষণ ট্রাস্ট্রের সভাপতি মোস্তফা শাহজামান চৌধুরী বাহার, সিলেট মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্সের সহ-সভাপতি মো আব্দুল জব্বার জলিল, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. জফির সেতু, ড. মোহাম্মদ ফারুক উদ্দিন ও ড. তাহমিনা ইসলাম, সিলেট প্রেস ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ সিরাজুল ইসলাম, সাংস্কৃতিক সংগঠক এনামুল মুনীর, নাগরিক মৈত্রী সিলেটের সভাপতি সমর বিজয় সী শেখর, বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন-বাপা সিলেটের যুগ্ম সম্পাদক আব্দুল হাই আল হাদী ও নির্বাহী সদস্য মাহমুদুর রহমান ওয়েছ, ইউকে বাংলা এডুকেশনাল ট্রাস্ট্রের (আকবেট) সিইও মোহাম্মদ আছাদুজ্জামান সায়েম, সমাজসেবী রোটারিয়ান জাকির আহমেদ চৌধুরী, সমাজকর্মী অরুপ শ্যাম বাপ্পী ও রেজাউল কিবরিয়া, বাংলাদেশ যুব ইউনিয়ন সিলেট জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক মতিউর রহমান, প্রকাশক রাজিব চৌধুরী, মেঠোসুর সম্পাদক বিমান তালুকদার, পরিবেশকর্মী রোমেনা বেগম রোজী ও আমীন তাহমীদ, কবি-লেখক ইছমত হানিফা, শিশু-কিশোর বিষয়ক সংগঠন উষার পরিচালক নিঘাত সাদিয়া।
সাবেক মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী বলেন, “প্রকল্প প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করেন আমলারা আর দোষ হয় রাজনীতিবিদদের।”
আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে সিলেটের উন্নয়ন পরিকল্পনা যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করা যাচ্ছে না বলে তিনি অভিমত ব্যক্ত করেন।
তিনি একাধিক ঘটনার বর্ণনা দিয়ে বলেন, “সিলেট এখন অভিভাবকশূন্য।”
আওয়ামী লীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক মিসবাহ উদ্দিন সিরাজ বলেন, “বড় প্রকল্প যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করতে সচেতন নাগরিকদের সম্পৃক্ত করতে হবে।”
তিনি সিলেটের ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আন্তরিকতার কথা উল্লেখ করেন।
সভাপতির বক্তব্যে শরীফ জামিল বলেন, “সিলেটে কখনও বন্যা হওয়ার কথা না। যা হচ্ছে কিংবা হবে, সব জলাবদ্ধতা।
অপরিকল্পিত নগরায়ণ গ্রাস করেছে পুকুর, খাল, নদী ও জলাশয়।”
তার সঙ্গে যোগ হয়েছে অনিয়ন্ত্রিত শিল্পায়ন ও হাওর ধ্বংসের অভিঘাত।
সিলেটে বসবাস করতে হলে এর নাগরিকদের ঐক্যবদ্ধ সামাজিক আন্দোলনের কোনো বিকল্প নেই বলে তার মত।
প্রবীণ রাজনীতিবিদ মোহাম্মদ সফিক বলেন, “দায়িত্বপালনকালে ভুল-ভ্রান্তি হয়। ৫০ বছর আগে সিলেট পৌরসভার ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালনের সুযোগ পেয়েছিলাম।
“সে সময় পরিবেশ বিষয়ে সচেতনতা না থাকায় কিছু ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। সেই সিদ্ধান্তের জন্য নাগরিকদের কাছে আজ দুঃখ প্রকাশ করছি।”
মোস্তফা শাহজামান চৌধুরী বাহার বলেন, “মেঘালয়ে নির্বিচারে পাথর ও খনিজ উত্তোলনের কারণে ঢলের সঙ্গে প্রচুর বালি আসছে। যা আমাদের নদীগুলোর তলদেশ ভরাট করছে।”
শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জফির সেতু বলেন, “জলবায়ু পরিবর্তনজনিত বন্যার মত প্রাকৃতিক বিপর্যয় যতটা না প্রাকৃতিক তার চেয়ে বেশি মানবসৃষ্ট এবং এটা যতটা না স্থানীয় সমস্যা ততটাই জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সমস্যা।”
সিলেট প্রেস ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ সিরাজুল ইসলাম জৈন্তা-গোয়াইনঘাটকে বন্যার হাত থেকে রক্ষায় পিয়াইন নদী খননের কথা বলেন।
অধ্যাপক মোহাম্মদ ফারুক উদ্দিন বলেন, “বন্যার ক্ষয়ক্ষতি থেকে রক্ষা পেতে স্বল্পমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা প্রয়োজন। সিলেটের বন্যা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ অধ্যয়ন সম্পর্কিত বিভাগসমূহের গ্রাজুয়েটদের সমন্বয়ে নাগরিক কমিটি গঠন করে টেকসই সমাধানের ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত।”
অধ্যাপক তাহমিনা ইসলাম বিগত ২০২২ এর বন্যার ভয়াবহ অভিজ্ঞতা তুলে ধরে বলেন, “এই বন্যার অন্যতম কারণ অপরিকল্পিত উন্নয়ন।”
প্রকল্পের নামে যা বরাদ্দ হয় তার বড় অংশ লুট হয়, তিনি বন্যাপরবর্তী পুনর্বাসন কাজে সঠিকভাবে সমন্বয়, এ ক্ষেত্রে বন্যার সময় বিশেষ সেল গঠনের কথা বলেন।
আকবেটের নির্বাহী পরিচালক মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান সায়েম বলেন, “সিলেটের পরিবেশ রক্ষার মত বিশাল একটি বিষয় নিয়ে কাজ করার জন্য শুধু আবেগ নিয়ে সেচ্ছাসেবী কাজ যথেষ্ট নয়। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের নিয়ে পরিবেশ নিয়ে কাজগুলোর একটা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে হবে যেটা সিভিল সোসাইটি ওয়াচডগ, প্রেসার গ্রুপ হিসাবে কাজ করবে এবং এই সংঘটনের জন্য যথেষ্ট তহবিল সংগ্রহ করতে হবে, জনবল নিয়োগ দিতে হবে।”
সিলেটের বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি সিলেটের সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির আরও উন্নতি হয়েছে।
বুধবার জেলার উপজেলা ও মহানগরের প্লাবিত এলাকাগুলোতে পানি আগের থেকে কমেছে।
গত মঙ্গলবার জেলা ও মহানগরে বন্যায় আক্রান্তের সংখ্যা ৭ লাখ ৩৯ হাজার ৩৬২ জন; আর বুধবার সেটি কমে দাঁড়িয়ে ৬ লাখ ৫৮ হাজার ৬৬২ জন পানিবন্দি। তবে এবারের বন্যার পানি ধীরে-ধীরে নামছে।
'অপরিকল্পিত' উন্নয়নেই বারবার ডুবছে সিলেট নগরী?
এর আগে ঘূর্ণিঝড় রেমালের প্রভাবে গত ২৭ মে সোমবার থেকে ভারি বৃষ্টিপাত হয়। একইসঙ্গে উজান থেকে নেমে আসে পাহাড়ি ঢল। ফলে সিলেট জেলার ১৩টির মধ্যে ১০টি উপজেলা বন্যাকবলিত হয়ে পড়ে। প্লাবিত হয় সুরমা নদী তীরবর্তী সিলেট নগরীর নিম্নাঞ্চলও।
সিলেট জেলা প্রশাসক শেখ রাসেল হাসান বলেন, “মঙ্গলবার দিবাগত রাতে সিলেটে ভারি বৃষ্টিপাতের কারণে গোলাপগঞ্জ, বিয়ানীবাজার ও বিশ্বনাথ উপজেলার বন্যা পরিস্থিতির কিছুটা বিস্তৃতি ঘটেছে। তবে সিলেট সিটি করপোরেশন এলাকাসহ জেলার অন্যান্য উপজেলায় বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে।”
নগরীর বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে জানিয়ে সিলেট সিটি করপোরেশনের জনসংযোগ কর্মকর্তা সাজলু লস্কর বলেন, “নগরীর প্লাবিত এলাকার কাউন্সিলরা জানিয়েছেন,বেশির ভাগ এলাকায় পানি কমতে শুরু করেছে। আশ্রয়কেন্দ্রে আসা মানুষজন নিজ বাসাবাড়িতে চলে যাচ্ছেন। সিসিকের পক্ষ থেকে প্রতিদিনের মত এখনো আশ্রয় কেন্দ্রগুলোতে রান্না করা খাবারসহ বিভিন্ন ওষুধ সামগ্রী বিতরণ করা হচ্ছে।”
তিনি আরও বলেন, “মঙ্গলবার রাতে টানা বর্ষণে সুরমা নদীর পানি কিছুটা বৃদ্ধি পেলে আজ দিনের বেলায় সে পানি নেমে যাওয়ায় বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়নি। নগরীর বন্যা কবলিত সড়কগুলো থেকে পানি নেমে গেছে। বন্যার্তদের মাঝে ত্রাণ সহায়তার জন্য ৩৩টি ওয়ার্ডে কাউন্সিলরদের মাধ্যমে ত্রাণ বরাদ্দ করা হয়েছে।”
পানি উন্নয়ন বোর্ড জানায়, বুধবার দুপুর ১২টায় সিলেটের কানাইঘাট উপজেলায় সুরমা নদীর পানি বিপৎসীমার ৫১ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
জকিগঞ্জ উপজেলায় কুশিয়ারা নদীর পানি বিপৎসীমার ১৮ সেন্টিমিটার ও ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলায় বিপৎসীমার ৪৩ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
সিলেট মহানগর এলাকায় সুরমা নদীর পানি বিপৎসীমার ৬ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
জেলার অন্য নদ-নদীর পানি বিপৎসীমার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
আগামী কয়েকদিন ভারি বর্ষণ না হলে সুরমা নদীর পানি আরও কমে যাবে।