রনি সরকারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কারণ দেখছে না বিএনপি

“স্থানীয় সরকার তথা সিটি নির্বাচনে মেয়র পদে বিএনপি অংশ নেবে না এটাই দলীয় সিদ্ধান্ত। তবে দলে তো তার (রনি) কোনো পদ নেই। তার প্রার্থী হতে বারণ কোথায়?”, প্রশ্ন গাজীপুর জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদকের।

গাজীপুর প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 1 May 2023, 07:26 AM
Updated : 1 May 2023, 07:26 AM

বিএনপি কোনো কৌশলেই সিটি নির্বাচনে থাকবে না– দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এমন বক্তব্য রাখার দুদিন আগে গাজীপুরে মেয়র পদে সরকার শাহনুর ইসলাম রনির প্রার্থী হওয়াটা নতুন আলোচনার খোরাক জুগিয়েছে।

রনির বিএনপিতে কোনো পদ নেই, তবে তার গোটা পরিবার দলটির রাজনীতিতে জড়িত আর মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার সময় তিনি নিজে ‘বিএনপি পরিবারের’ সদস্য বলেই নিজের পরিচয় দিয়েছেন।

বিএনপির ঘোষণা হল, সিটি করপোরেশন নির্বাচনে তারা যাবে না, যদি কেউ অংশ নেয়, তাহলে তার বা তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কিন্তু রনির যেহেতু কোনো পদ নেই, তাই তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কোনো ‘দরকার নেই’ বলে মনে করছে দলটি।

গাজীপুর বিএনপির নেতৃত্বে থাকা একজন নেতা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেছেন, তাদের দলের যে সিদ্ধান্ত, তা রনির ভোটে দাঁড়াতে বাধা হওয়ার কথা নয়। এ ক্ষেত্রেও যুক্তি হিসেবে তিনি রনির পদ না থাকার বিষয়টি তুলে ধরেছেন।

রনির চাচা বিএনপির গতবারের প্রার্থী হাসানউদ্দিন সরকার তফসিল ঘোষণার পর আওয়ামী লীগের প্রার্থী আজমত উল্লা খানকে ‘কৌশলে’ মোকাবিলা করার কথা বলেছিলেন। রনিই সেই ‘কৌশল’ কি না, সে বিষয়টি তিনি স্পষ্ট করছেন না। আর রনির পক্ষে প্রকাশ্যে তার কোনো তৎপরতাও নেই।

রনি বলেছেন, তার চাচা দলীয় কারণে যদি মাঠে নামতে না পারেন, তাহলে তার মান অভিমানের কিছু নেই। তার চাচার দোয়া তার ওপর আছে, এটিই যথেষ্ট।

পদ নেই, তবে রনি ‘বিএনপিরই’

২০১৮ সালের নির্বাচনে গাজীপুর সিটিতে বিএনপির প্রার্থী হাসানউদ্দিন সরকার তার চাচা। রনির বাবা নুরুল ইসলাম সরকারও বহু বছর ধরেই বিএনপির রাজনীতিতে জড়িত। ২০০৫ সালে আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য আহসানউল্লাহ মাস্টারকে প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যার মামলায় তিনি মৃত্যুদণ্ডের রায় পেয়েছেন। দণ্ড এখনও কার্যকর হয়নি, তবে ১৮ বছর ধরে তিনি বন্দি।

Also Read: গাজীপুরে মেয়র পদে প্রার্থী ‘বিএনপি পরিবারের’ রনি সরকার

২০১৮ সালে রনি যখন তার চাচার হয়ে প্রচারে নামেন, তখন তিনি বিএনপির সহযোগী সংগঠন স্বেচ্ছাসেবক দল করতেন। তবে সেই সংগঠনেও তার কোনো পদ ছিল না।

সেই নির্বাচনের পর তিনি সুইডেন চলে যান। সিটি করপোরেশন নির্বাচনে অংশ নেওয়ার পরিকল্পনা নিয়ে স্ত্রী-সন্তানকে বিদেশে রেখে মাস ছয়েক আগে ফেরেন গাজীপুরের টঙ্গীতে। এরপর থেকে নানাভাবে নিজের আগ্রহের জানান দিচ্ছিলেন।

রনির এই সিদ্ধান্তে তার পরিবারের যে সমর্থন আছে, সেটি স্পষ্ট। বিএনপি ভোটে আসবে না- এমন ঘোষণার মধ্যে গত ১৭ এপ্রিল হাসান সরকার এক ইফতার মাহফিলে বলেন, “দল সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলে আমরা গাজীপুর সিটি নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে মোকাবিলা করব। দল সিদ্ধান্ত না নিলে আমরা কৌশল গ্রহণ করব। আওয়ামী লীগকে খালি মাঠে ছেড়ে দেওয়া হবে না।”

ভাতিজার হয়ে নির্বাচন করবেন? – বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের এই প্রশ্নে ২০১৮ সালে বিএনপির প্রার্থী বলেন, “এখন এ ব্যাপারে আমাদের কোনো কথা নাই। কথা হবে ৮ তারিখের পর।”

আগামী ২৫ মের ভোট থেকে বৈধ প্রার্থীরা ৮ মের মধ্যে মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করতে পারবেন। 

তরে রনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেছেন, “বিএনপি আন্দোলনে আছে, তাদের আন্দোলনকে আসি সমর্থন করি। সঙ্গে সঙ্গে বলতে পারি, এই সরকারের প্রতি মানুষের যে আস্থা নেই এটা প্রমাণ করার সুযোগ এসেছে। সেটা আমি সেটা করতে পারব আশাবাদী।”

বিএনপির তৃণমূল ‘রনির সঙ্গেই’

বিএনপি ভোটে না গেলেও কর্মী সমর্থকদের পাশে পেতে আত্মবিশ্বাসী রনি সরকার। তিনি বলেন, “বিএনপিতে আমার পদ নেই। কিন্তু আমি তো বিএনপিই করি। আর আমার পরিবারও এই দলের সঙ্গে জড়িত।

“বিএনপির তৃণমূল বলেন, সমর্থক বলেন, নেতা বলেন, সাধারণ মানুষ বলেন, সবার ভালোবাসা আমার প্রতি আছে। আমি সব সময় বলে আসছি সাধারণ মানুষের সমর্থনে আমি এগিয়ে এসেছি।”

আহসানউল্লাহ মাস্টার হত্যা মামলায় তার বাবা নুরুল ইসলাম সরকারকে যে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে, তা ষড়যন্ত্র বলে দাবি করেন রনি।

তিনি বলেন, “বিএনপি নেতা, কেবল এই কারণে আমার বাবা ১৮ বছর ধরে কারাগারে বন্দি। টঙ্গীর মানুষ, গাজীপুরের মানুষ জানেন একটা মিথ্যা, বানোয়াট মামলায় আমার বাবাকে ফাঁসানো হয়েছে।”

এ নির্বাচন নিয়ে বিএনপির নেতাদের সঙ্গে কোনো বৈঠক হয়েছে কি না, এই প্রশ্নে ‘না’ বলেন রনি।

বিএনপির সিদ্ধান্ত মানলে চাচা হাসান উদ্দিন সরকার তো প্রচারে অংশ নিতে পারবেন না, সে বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে রনি বলেন, “হাসান উদ্দিন সরকার আমাকে দোয়া করবেন, তিনি মাঠে না নামলেও তার সমর্থন তো আমার প্রতি থাকবে। তার দোয়াটাই আমার জন্য আলহামদুলিল্লাহ।”

রনির জন্য ‘নিষেধ’ দেখছে না গাজীপুর বিএনপি

নির্বাচন বর্জনে বিএনপির সিদ্ধান্ত গাজীপুরে রনির প্রার্থী হতে কোনো বাধা নয় বলে মনে করেন গাজীপুর জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক শাহ রিয়াজুল হান্নান।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “স্থানীয় সরকার তথা সিটি নির্বাচনে মেয়র পদে বিএনপি অংশ নেবে না এটাই দলীয় সিদ্ধান্ত। তবে দলে তো তার (রনি) কোনো পদ নেই। তার প্রার্থী হতে বারণ কোথায়?”

রনির মত বিএনপিপন্থিরা কাউন্সিলর পদেও ভোটে দাঁড়াতে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন। এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে রিয়াজুল হান্নান বলেন, “কাউন্সিলর পদেও নির্বাচনে অংশ নিলে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে কি-না সে ব্যাপারে সুষ্পষ্ট কোনো নির্দেশনা নেই।”

অন্য তিন সিটিতেও স্বতন্ত্র প্রার্থী?

আগামী ২১ জুন ভোট হতে যাওয়া সিলেট সিটি করপোরেশনে বিএনপির বর্তমান মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী প্রার্থী হবেন কি না, এ নিয়ে আছে জল্পনা কল্পনা।

দল অংশ না নিলে তিনিও স্বতন্ত্র পরিচয়ে প্রার্থী হতে পারেন, এমন আলোচনা আছে সিলেটে।

রোজায় লন্ডন সফরে গিয়ে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে একটি ইফতার মাহফিলে অংশ নেন আরিফুল। সেখানে তিনি নির্বাচনের বিষয়ে ‘সংকেত’ পাওয়ার কথা জানিয়েছেন।

ইফতারের আগে দেওয়া বক্তব্যে আরিফুল তখন বলেন, “এই সরকারের আমলে দুই দুইবার বিএনপির হয়ে মেয়র নির্বাচিত হয়েছি। কিন্তু এবার যেহেতু আমাদের দল এই স্বৈরাচারী সরকার, ফ্যাসিস্ট সরকারের অধীনে নির্বাচনে যাবে না। সেই ক্ষেত্রে আমরা অটল।…

“তবে, একটি কথা বলে রাখতে চাই। আজকে যুক্তরাজ্যে আসছি মাত্র চারদিন… হ্যাঁ, আমার সঙ্গে আমার নেতার (তারেক রহমান) মিটিং হয়েছে। তিনি আমাকে একটা সিগন্যালও দিয়েছেন। সেটা রেড কিংবা সবুজ- সেটা সময়ই বলে দেবে ইনশাল্লাহ। আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বিজয় অর্জন করব।”

দেশে ফিরে গত ২৮ এপ্রিল জুমার নামাজ শেষে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে তিন সপ্তাহ সময় চেয়ে তিনি বলেন, “আমার দল বিএনপি এই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করছে না। আর আমি ব্যক্তিগতভাবে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করব কি না, তা আগামী ১৯ বা ২০ মে নগরীর রেজিস্টারি মাঠে জনসভা আয়োজন করে জানিয়ে দেব।

“এখন আমি সচেতন ভোটার, শুভাকাঙ্ক্ষীসহ মুরব্বিদের মতামত নিচ্ছি। সবার সাথে আলোচনা করে এবং পরিবেশ পর্যবেক্ষণ শেষে আমি আমার সিদ্ধান্ত জানাব।”

বরিশালেও বিএনপির প্রয়াত মেয়র আহসান হাবিব কামালের ছেলে কামরুল আহসান রূপন স্বতন্ত্র প্রার্থী হতে প্রস্তুতি নিচ্ছেন বলে গণমাধ্যমে খবর প্রকাশ হয়েছে।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে রূপন বলেন, বাবা আহসান হাবীব কামালের সঙ্গে যারা রাজনীতি করেছেন, তাদের সহানুভূতি তিনি পাচ্ছেন। অনেকেই সঙ্গেই দেখা করেছেন, কুশল বিনিময় করেছেন।

“যারা মান-অভিমান নিয়ে এতদিন দূরে সরে ছিলেন, তারাও এখন আসছেন। সবার কাছ থেকে অকল্পনীয় সাড়া পাচ্ছি। খোলামেলা আলোচনা হচ্ছে। সামনে আরও অনেক বড় চমক আছে।”

খুলনায় আওয়ামী লীগের প্রার্থী তালুকদার আবদুল খালেককে ফের মোকাবিলায় মুখিয়ে আছেন ২০১৮ সালের প্রার্থী নজরুল ইসলাম মঞ্জু।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে সম্প্রতি তিনি বলেন, “গত সিটি নির্বাচনে রাষ্ট্রযন্ত্র ব্যবহার করে সরকার নির্বাচনব্যবস্থা ধ্বংস করেছে। তবে অনেকে মনে করেন নির্বাচনে যাতে আওয়ামী লীগ ফাঁকা মাঠে গোল দিতে না পারে, সে জন্য নির্বাচনে যাওয়া উচিত।”

তাহলে কি ভোটে যাচ্ছেন? মঞ্জু বললেন, “দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে আমি যাব না। আমরা অপেক্ষা করছি, নানা সীমাবদ্ধতার মধ্যেও বিএনপি হয়ত একটি চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে।”

খুলনায় চার দশক ধরে বিএনপির রাজনীতি করে আসা মঞ্জু অবশ্য দলে অবস্থান হারিয়েছেন। গত সিটি নির্বাচনের তিন বছর পর ২০২১ সালের ২৬ ডিসেম্বর দলের শৃঙ্খলা ভঙের অভিযোগে তাকে কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক (খুলনা বিভাগ) পদ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়।

এরপর থেকে দলে কোণঠাসা তিনি ও তার অনুসারীরা। গত বছর ১ মার্চ মহানগর বিএনপির ৭১ সদস্যের পূর্ণাঙ্গ আহ্বায়ক কমিটি গঠন করা হলে সেখানেও মঞ্জুর পাশাপাশি রাখা হয়নি খুলনা সিটির প্রথম দুই নির্বাচনে বিএনপির সমর্থন পাওয়া মনিরুজ্জামান মনিকেও।

এখন পর্যন্ত রাজশাহী সিটি করপোরেশনেই আওয়ামী লীগকে মোকাবিলায় বিএনপির কোনো পর্যায়ের কারও প্রার্থী হতে আগ্রহ প্রকাশ করতে দেখা যায়নি।

আওয়ামী লীগ থেকে বলা হচ্ছে, ভোটে না আসার কথা বলে বিএনপি ‘স্বতন্ত্র’ পরিচয়ে প্রার্থী দিচ্ছে। ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের দাবি, বিএনপি এভাবে ‘ঘোমটা পরে’ ভোটে অংশ নিচ্ছে।

বিএনপি ভোট বর্জনের ঘোষণা দেওয়ার পর নারায়ণগঞ্জে তৈমূর আলম খন্দকার এবং কুমিল্লায় মনিরুল হক সাক্কু স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে ভোটে লড়েন। দুই জনই পরাজিত হন এবং ভোটে দাঁড়ানোয় তাদেরকে বহিষ্কার করে বিএনপি।