কয়েকদিন ধরে পানি কমায় বানভাসি মানুষ বাড়ি ফিরলেই দেখতে পাচ্ছেন, বানের স্রোতে ভেসে গেছে তাদের ঘর।
Published : 06 Sep 2024, 12:51 AM
ভয়াবহ বন্যার কবলে পড়া কুমিল্লার লোকালয় থেকে গত কয়েকদিন ধরেই নামতে শুরু করেছে পানি।
এরই মধ্যে জেলার বিভিন্ন উপজেলার উঁচু এলাকাগুলো থেকে পানি নেমে যাওয়ায় বানভাসি মানুষ আশ্রয়কেন্দ্র ছেড়ে বাড়ি-ঘরে ফিরতে শুরু করেছেন।
ফলে খালি হতে শুরু করেছে আশ্রয়কেন্দ্রগুলো। শুরুতে ৯২ হাজারের বেশি মানুষ আশ্রয়কেন্দ্রে থাকলেও বর্তমানে এই সংখ্যাটা ৩৯ হাজারের মত।
জেলার ১৭টি উপজেলার মধ্যে ১৪টি উপজেলার মানুষ এবার বন্যার ভয়াবহ রূপ দেখেছেন।
বর্তমানে বানের পানি কিছুটা কমতে শুরু করায় ভেসে উঠতে শুরু করেছে ক্ষতচিহ্নগুলো। ভয়াবহ এই বন্যা কেড়ে নিয়েছে মানুষের সাজানো-গোছানো বাড়িঘর।
কয়েকদিন ধরে পানি কমায় বানভাসি মানুষ বাড়ি ফিরলেই দেখতে পাচ্ছেন- বানের স্রোতে ভেসে গেছে তাদের স্বপ্ন। বাড়ি ফিরে বন্যার ক্ষতচিহ্ন দেখে মানুষের কান্না যেন বেড়েই চলেছে।
বিশেষ করে গোমতী নদীর ভাঙনকবলিত এলাকাগুলোতে ভয়াবহ ক্ষতিগুলো দেখে কান্নায় ভেঙে পড়ছেন সেখানকার মানুষ। সব হারিয়ে নিঃস্ব মানুষগুলোর সামনে এখন অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ।
জেলার বুড়িচং উপজেলার বুড়বুড়িয়া এলাকায় গোমতী নদীর বাঁধ ভাঙনের ফলে ওই উপজেলার বেড়িবাঁধ সংলগ্ন অন্তত দশটি গ্রামের মানুষের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। অনেকের বাড়ি-ঘর ভেঙে পড়েছে।
বিশেষ করে মাটি ও টিনের তৈরি ঘরগুলোর অবস্থা বেশি খারাপ। এ ছাড়া দীর্ঘদিন পানির নিচে থাকায় ঘরের মালামাল নষ্ট হয়ে গেছে।
এ পরিস্থিতিতে তাদের দাবি, সবার আগে প্রয়োজন ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসন।
কুমিল্লার ডিসি খন্দকার মু. মুশফিকুর রহমান বলেন, “আমরা প্রশাসনের পক্ষ থেকে বন্যার্তদের সব ধরনের সহযোগিতা করছি। বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসনের প্রক্রিয়া চলমান থাকবে।”
এদিকে, বুধবার বুড়িচংয়ের গোমতীর ভাঙনকবলিত বুড়বুড়িয়া, বেড়াজাল, মহিষমারা, ইন্দ্রাবতি, খাড়াতাইয়া, নানুয়ার বাজারসহ আশপাশের গ্রামগুলো ঘুরে দেখা গেছে, বন্যায় ভয়ানক ক্ষতির চিত্র।
এসব এলাকার বেশির ভাগ সড়কই ভেঙে চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। অনেকের বাড়িঘর ভেঙে গেছে।
রাস্তার পাশে বড় বড় গাছ শিকড় উপড়ে পড়ে আছে। যেসব মানুষের ঘরগুলো টিকে আছে, সেগুলোও যায় যায় অবস্থা। বেশির ভাগ ঘরই কাত হয়ে আছে।
ঘরের ভেতর থাকা সব আসবাবপত্র নষ্ট গেছে। ঘরে স্রোতের সঙ্গে আসা পলিমাটির স্তূপ পড়ে আছে।
গোমতীর ভাঙা বাঁধ সংলগ্ন বুড়িচংয়ের ইন্দ্রাবতি গ্রামের ধীরেন্দ্র চন্দ্র দাস বলেন, “হঠাৎ বাঁধ ভেঙে লোকালয়ে পানি ঢুকতে শুরু করে। জীবনেও এতো পানি দেখিনি।”
“প্রাণ বাঁচাতে কোনো রকমে পরনের কাপড় নিয়েই ঘর ছাড়ি। পানি কমার পর বাড়ি এসে দেখি আমার কিছুই নেই। সব পানি নিয়ে গেছে। কেবল আমরাই বেঁচে আসছি। আমি তো একেবারে নিঃস্ব হইয়া গেছি।”
ধীরেন্দ্র চন্দ্র দাসের ভাষ্য, “ঘর, জিনিসপত্র সব ভাসিয়ে নিয়ে গেছে পানি। ঘরে যা ছিল তা ১১ দিনের পানির নিচে থেকে সব পচে গেছে। পানি তো কমে গেছে, আমার যে ক্ষতি, তা তো কোনোভাবে পূরণ হওয়ার নয়। এখন আমি কোথায় যাব? সরকারের কাছে আহ্বান আমাদের পুনর্বাসনে উদ্যোগ নিন।”
ধীরেন্দ্রর বাড়ি গিয়ে দেখা যায়, ভয়াবহ এই বন্যায় তার মাটির ঘর পুরোপুরি ভেঙে পড়েছে। বানের স্রোতে মাটির ঘর মিশে গেছে মাটিতেই। এখন শেষ সম্বল শুধু খালি ভিটেটাই আছে।
পরিবারের সদস্যদের নিয়ে ভিটার ওপর দাঁড়িয়ে নতুন ঘর করার দুশ্চিন্তায় রয়েছেন তিনি।
বুধবার উপজেলার বেড়াজাল গ্রামের বিলকিস বেগমের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, বানের তোড়ে তার ঘরটিও ভেঙে পড়েছে। ঘরের ভেতরের সব আসবাবপত্র নষ্ট হয়ে গেছে। বন্যার এই ক্ষতচিহ্ন দেখে কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি।
কান্নাজড়িত কণ্ঠে বিলকিস বেগম বলতে থাকেন, “এই বন্যায় আমার সব শেষ হইয়া গেল। এই পানি আমার সব কাইড়া নিসে। এখন আমি ঘর পামু কই, থাকমু কই। হায় আল্লাহ, কী সর্বনাশ হইল আমার।”
শুধু বিলকিস বেগম কিংবা ধীরেন্দ্র চন্দ্র দাসই নয়, গোমতীর ভাঙনের ফলে জেলার বুড়িচং ও ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলার অসংখ্য মানুষ এখন ঘরহারা হয়ে হাহাকার করছেন। আর যাদের ঘর টিকে আছে, তাদের সব মালামাল নষ্ট হয়ে গেছে।
ঘরবাড়ি হারানো মানুষজন এখন শেষ সম্বল খালি ভিটার উপর হাতড়ে বেড়াচ্ছেন ঘরের শেষ স্মৃতিচিহ্ন।
জেলার দক্ষিণাঞ্চলের চৌদ্দগ্রাম, মনোহরগঞ্জ, লাকসাম ও নাঙ্গলকোটেও অসংখ্য বানভাসি মানুষের এমন অবস্থা।
চৌদ্দগ্রাম উপজেলার কনকাপৈত ইউনিয়নের দুর্গাপুর গ্রামের বাসিন্দা রহিমা রহিমা আক্তার বলেন, “ডাকাতিয়া নদীর পানি নামতে শুরু করায় আমাদের বাড়ির পানিও নামতে শুরু করছে। তাই আশ্রয়কেন্দ্র থেকে সোমবার (২ সেপ্টেম্বর) বাড়ি ফিরেছি। এসেই দেখি, আমাদের সব শেষ। কোনোকিছুই অবশিষ্ট নেই। ক্ষতিগ্রস্ত ঘর দেখে আমি আঁতকে উঠেছি। বন্যার পানিতে ভেসে গেছে বাড়ির সামনের পুকুরের মাছ। রান্না করার চুলাও ভাসিয়ে নিয়ে গেছে পানি। এতদিন তো মানুষের ত্রাণে চলেছি। এখন কীভাবে চলব? জীবনের শেষ সম্বলটুকু হারিয়ে রাস্তায় বসা ছাড়া আর কোনো উপায় দেখতেছি না। সরকার যদি আমাদের পাশে না দাঁড়ায়, তাহলে আমরা একেবারেই শেষ হয়ে যাব।”
বুড়িচং উপজেলার ইউএনও সাহিদা আক্তার বলেন, “গোমতী নদীর ভাঙনের সম্মুখে থাকা বুড়িচংয়ের কয়েকটি গ্রাম অনেক বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এসব গ্রামগুলোর দিকে বিশেষ নজর দিতে হবে।
“পুনর্বাসন করতে হবে দ্রুত। পুনর্বাসনের ক্ষেত্রে তাদেরকে গুরুত্ব দেওয়া হবে।”
এ ছাড়া অন্য এলাকায় ক্ষতিগ্রস্তদের বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হবে জানিয়ে তিনি বলেন, “বিষয়টি সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোকে জানানো হয়েছে। বন্যা পরবর্তী পুনর্বাসনের বিষয়ে প্রশাসনের পক্ষ থেকে জরুরি পদক্ষেপ নেওয়া হবে।”
এদিকে, জেলায় এখনো প্রায় পাঁচ লাখ মানুষ পানিবন্দি অবস্থায় রয়েছেন বলে জানিয়েছেন জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা মো. আবেদ আলী।
বুধবার দুপুরে তিনি বলেন, “জেলায় বর্তমানে এক লাখ ১৩ হাজার ৬১৫টি পরিবারের প্রায় পাঁচ লাখ মানুষ পানিবন্দি অবস্থায় রয়েছেন। তবে জেলার ১৪টি উপজেলাতেই বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে। এরই মধ্যে মানুষ আশ্রয়কেন্দ্র ছাড়তে শুরু করেছেন।”
বর্তমানে ৩৬১টি আশ্রয়কেন্দ্রে ৩৯ হাজার ৮১০ জন বানভাসি মানুষ রয়েছেন। আর বন্যার শুরুতে পানি বেড়ে যাওয়ায় ৭২৪টি আশ্রয়কেন্দ্রে ছিলেন ৯২ হাজার ৩৪৫ জন।