“ফয়সালের পরীক্ষায় পাসের খবরে কলিজা ফেটে যাচ্ছে। আমার বড় শ্যালকটা অনেক মেধাবী ছিলো।“
Published : 18 Oct 2024, 11:24 AM
“আমার পোলাডা ভালো ছাত্র আছিল। এইবারের ইন্টার পরীক্ষায় পাস কইরাও দেইখ্যা যাইতারলো না। এই দুঃখ কেমনে সামলাইতাম। আমার বুকটা ফাইট্টা যাইতাছে।”
বুকফাটা আর্তনাদ করে কথাগুলো বলছিলেন, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে নিহত কুমিল্লার দেবীদ্বারের ফয়সাল সরকারের মা হাজেরা বেগম।
ঢাকার দক্ষিণখান এলাকার এস এম মোজাম্মেল হক টেকনিক্যাল স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে এ বছর এইচএসসি পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিলেন ফয়সাল।
মঙ্গলবারের প্রকাশিত ফলাফলে তিনি জিপিএ ৪.৩৫ পেয়ে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলেও জীবন যুদ্ধে হেরে গেছেন আগেই। পরীক্ষার রেজাল্ট যখন প্রকাশ পায়, তখন ২০ বছরের এ তরুণ পৃথিবীর সমস্ত মায়া কাটিয়ে কবরে চিরঘুমে।
বেঁচে থাকলে ফয়সাল হয়তো তার এই পাসের আনন্দ ভাগ করে নিতো পরিবার আর বন্ধুদের সঙ্গে। মা হয়তো ছেলের ভালো ফলাফলের খবর শুনে আনন্দে তার মাথায় হাত বোলাতেন পরম যত্নে। কিন্তু ফরসালের মৃত্যুতে সেই দৃশ্যপট পাল্টেছে চিরদিনের মত। খুশির বদলে একরাশ বেদনা ঘিরে ধরেছে এ পরিবারটিকে।
হতভাগ্য ফয়সাল এইচএসসি পরীক্ষায় পাস করেছে, এ খবর জানার পর থেকেই বৃদ্ধা মা হাজেরা বেগমের কান্না থামছে না। চোখ মুছতে আঁচলও যেন কম পড়ছিল।
তিনি বলছিলেন, “এই দুঃখ কেমনে সামলাইতাম? আমার এতো আদরের পোলাডারে বেওয়ারিশ হিসাবে কবর দিলো। শেষবার পোলাডার মুখটাও দেখতে পারলাম না।”
কুমিল্লার দেবীদ্বার উপজেলার কাচিসাইর গ্রামের সফিউল ইসলাম ওরফে রেজা মিয়ার ছেলে ফয়সাল রাজধানীর আবদুল্লাহপুর এলাকায় একটি ভাড়া বাসায় থাকতেন। সংসারের হাল ধরতে পড়াশোনার পাশাপাশি ঢাকায় শ্যামলী পরিবহনের একটি বাসে সুপারভাইজার হিসেবে কাজ করতেন।
গত ১৯ জুলাই বিকালে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলন চলাকালে কর্মক্ষেত্রে যাওয়ার জন্য বাসা থেকে বের হয়ে প্রাণ হারান তিনি।
সেদিনের ঘটনার বর্ননায় ফয়সালের পরিবারের সদস্যরা জানান, ওইদিন আবদুল্লাহপুরের শ্যামলী পরিবহনের কাউন্টারে যাবে বলে বাসা থেকে বের হয় ফয়সাল। সন্ধ্যার পর তার মোবাইল ফোনে কল করলে সেটি বন্ধ পান তারা। এরপর বিভিন্ন জায়গায় খোঁজাখুঁজি করে না পেয়ে ২৮ জুলাই দক্ষিণখান থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করা হয়। এরপর ১২ দিন খোঁজাখুঁজির পর দিশেহারা স্বজনরা জানতে পারেন, ফয়সাল আর বেঁচে নেই।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে গুলিতে তার মাথার খুলি উড়ে নির্মম মৃত্যু হয়েছে। ফয়সালের মরদেহ বেওয়ারিশ হিসেবে দাফন করেছে আঞ্জুমান মফিদুল ইসলাম।
পরে ১ অগাস্ট বিকালে আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলামে খোঁজ নিলে সেখানে কর্মরতরা বেওয়ারিশ হিসেবে দাফন করা মরদেহগুলোর ছবি দেখান। সেখানে ফয়সালের মরদেহের ছবি দেখতে পান স্বজনরা।
ফয়সাল যে কলেজ থেকে এইচএসসি পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিল, সেখান থেকে এসএসসিও পাস করেছিল। ছয় বোনের পর দুই ভাই ফয়সাল আর ফাহাদ সরকারের জন্ম। তাই তারা পরিবারের সবার আদরের ছিলেন।
ভাইকে চিরদিনের মত হারিয়ে ফেলেছেন, তা এখনও বিশ্বাস করেন না একাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী ফাহাদ। সব সময় ভাইয়ের পাশঘেঁষা এ কিশোরের হারিয়েছে রাতের ঘুমও।
ফাহাদ বলছিল, “আমি ভাইয়ের সঙ্গে ঢাকায় থাকতাম। সেখানে পড়াশোনা করতাম। কিন্তু ভাই নিহত হওয়ার পর থেকে একদিনও ভালোভাবে ঘুমোতে পারিনি। এখন ঢাকা যেতে ভয় লাগে। তাই কুমিল্লা চলে এসেছি। দেবীদ্বারের বাগুর বাসস্ট্যান্ডে আমার ভগ্নিপতির দোকানে এখন কাজ করছি।”
ফয়সালের ভগ্নিপতি আবদুর রহিম সরকার বলেন, “ফয়সালের পরীক্ষায় পাসের খবরে কলিজা ফেটে যাচ্ছে। আমার বড় শ্যালকটা অনেক মেধাবী ছিল। চাকরির পাশাপাশি সামান্য পড়েই পরীক্ষায় ভালো ফলাফল করতো। তাদের বাড়িতে একটি টিনের ঘর ছাড়া কিছু নেই।
“ফয়সাল পড়াশোনার পাশাপাশি যা আয় করতো, তা দিয়ে পরিবারটি চলতো। আন্দোলনে ফয়সাল নিহত হওয়ায় পুরো পরিবারটি এখন অসহায়।”
ফয়সালের বোন রোজিনা আক্তার বলছিলেন, “আমাদের ছয় বোনের বিয়ে হয়ে গেছে। ফয়সাল ছিল সবচেয়ে বেশি আদরের। আমার সেই আদরের ভাইটাকে এভাবে প্রাণ দিতে হলো। পরবর্তীতে আমরা জানতে পেরেছি, পুলিশের গুলিতেই আমার ভাইয়ের মৃত্যু হয়েছে।
“আমার বাবা খুব অসুস্থ, কানে কম শোনে। ফয়সাল পাস করেছে শুনে চোখের পানি ফেলছেন আর কারও সাথে কথা বলছেন না।”