মুক্তিযুদ্ধে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ খেতাব বীর উত্তম। মাত্র ৬৮ জন বীর মুক্তিযোদ্ধা এ খেতাব পেয়েছেন। গেজেটে আব্দুস সাত্তারের নম্বর ৪৬।
Published : 10 Dec 2022, 08:33 AM
ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে সিলেটে সম্মুখ যুদ্ধে বুক, পেট ও পায়ে তিনটি গুলি লেগেছিল আব্দুস সাত্তারের। এরপর ভারতে চিকিৎসা নিয়ে দেশে ফেরেন মার্চে।
সেই থেকে এ বীর মুক্তিযোদ্ধার দিন কাটছে বরিশাল নগরীর গণপাড়ার বাড়িতে। বর্তমানে ৮২ বছর বয়সী এই মুক্তিযোদ্ধা গৃহস্থলি কাজে নিজেকে ব্যস্ত রাখেন।
সকালে ঘুম থেকে ওঠার পর থেকে ঘরের আশপাশে মাটিতে শাক-সবজি ফলানো ও পরিচর্যার কাজে নিজেকে ব্যস্ত রাখেন। প্রচারবিমুখ এ ব্যক্তি নিভৃতে থাকতে পছন্দ করেন বলে জানান।
মুক্তিযুদ্ধে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ খেতাব বীর উত্তম। মাত্র ৬৮ জন বীর মুক্তিযোদ্ধা এ খেতাব পেয়েছেন। গেজেটের তার নম্বর ৪৬।
সরকারের কাছে নানা সময় ‘আবেদন করে ভালো কিছু না পেয়ে’ তিনি নিভৃতে থাকতে চান। তারপরও সেনা প্রধানের আশ্বাসে শেষবারের মতো একটি ঘরের জন্য আবেদন করবেন – শেষ বয়সে একটু পাকা ঘরে থাকতে চান।
আব্দুস সাত্তার জানান, ১৯৬৬ সালের ১২ অগাস্ট ইপিআরে যোগ দেন তিনি। ঢাকার পিলখানায় প্রশিক্ষণ শেষে রাজশাহী উইংয়ে যোগদান করেন। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ বাঙালি সদস্যদের নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। ইপিআর বাহিনীর সাহসী যোদ্ধাদের নিয়ে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর তৃতীয় রেজিমেন্টে আব্দুস সাত্তারকে একীভূত করা হয়। জেড ফোর্সের সূচনালগ্নে যুক্ত হয়ে তেলঢালায় প্রশিক্ষণ নেন। সেখান থেকে মেজর শাফায়াত জামিলের নেতৃত্বে পুনরায় যুদ্ধে ফিরে আসেন।
তিনি ময়মনসিংহের ধানুয়া-কামালপুর, সিলেটের গোয়াইনঘাট, সুনামগঞ্জের ছাতক, টেংরা টিলা, গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জসহ বিভিন্ন স্থানে সম্মুখযুদ্ধে অংশ নেন।
যুদ্ধে স্মরণীয় ঘটনা সম্পর্কে বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুস সাত্তার বলেন, পাক বাহিনীর অস্ত্র বোঝাই তিনটি গানবোট কোদালকাঠি এলাকায় নোঙর করা ছিল। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ডিনামাইট দিয়ে ধ্বংস করেন; যা মুক্তিযুদ্ধের সময় একটি আলোচিত ঘটনা ছিল। এছাড়া এক পাঠান পাঞ্জাবী পাকসেনাকে নিজে ধরে মেজর শাফায়াত জামিলের কাছে হস্তান্তর করেন।
দেশকে মুক্ত করার উৎসবের দিনটিতে তিনি অংশ নিতে না পারায় হতাশা প্রকাশ করে বলেন, ৭ ডিসেম্বর সিলেটের গোয়াইনঘাটে পাক বাহিনীর সঙ্গে সম্মুখ যুদ্ধে তিনটি গুলিবিদ্ধ হন। সেখান থেকে তাকে ভারতের শিলংয়ে সামরিক হাসপাতালে নিয়ে চিকিৎসা দেওয়া হয়। মার্চ মাসে তাকে স্বাধীন দেশে নিয়ে আসা হয়। হেলিকপ্টারে করে পুরাতন বিমানবন্দরে অবতরণ করেন। সেখান থেকে ঢাকা সিএমএইচে নেওয়া হয়। সেখানে একমাস চিকিৎসার পর তৃতীয় ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টে ফেরত পাঠানো হয়।
আব্দুস সাত্তার বলেন, “যুদ্ধের ৯ মাস ও চিকিৎসার তিনমাস – এই এক বছর আমার কোনো হদিস জানত না পরিবার। সবাই ভেবেছে আমি মারা গেছি।”
তিনি বলেন, তার সহযোদ্ধা বরিশাল সদর উপজেলার শায়েস্তাবাদ ইউনিয়নের বাসিন্দা ক্যাপ্টেন নুরুল ইসলাম জানিয়েছিলেন যুদ্ধে তিনি [সাত্তার] গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। তারপর তাকে ভারতে নিয়ে গেছে। এরপর কী হয়েছে, বেঁচে আছেন না মরে গেছেন তা তিনি জানেন না।
“তাই সবাই ভেবেছিল আমি মারা গেছি।”
বীর এ মুক্তিযোদ্ধা বলেন, “বাড়িতে ফিরে আসার পর সবাই খুব খুশি হয়েছে। বাবা তিনশ টাকায় একটি গরু ছাইরা দিছে। জানের বদলে জান দিয়েছেন।”
তার স্ত্রী রেহেনা পারভীন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “উনি যখন নিখোঁজ ছিল তখন আমার বাবা-মায় বাড়িতে ফিরিয়ে নিয়ে যান। আমারে বিয়ে দেবে। কিন্তু আমি বিয়া বই নাই। এই বইলা আমি রইছি। আমার মনে কইছে হে আছে। না আল্লে পেন্দনের কাফুর, না আল্লে কিছু। হেইভাবে রইছি। হেরপর খবর পাইয়া এই বাড়ি আইছি।”
দেশ স্বাধীন করেছেন; পেনশন, রেশন ও মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে ভাতা পাচ্ছেন। তা নিয়ে তিনি খুশি। আর কারো কাছে কোনো কিছু চাওয়ার নেই।
চেয়েও পাননি অভিযোগ করে সাত্তার বলেন, টিনের ঘরে মাটির ফ্লোরে থাকছেন। তাই একটু পাকা ঘরে থাকার ইচ্ছে ছিল। এ জন্য প্রধানমন্ত্রীর কাছে ৫/৭ বার আবেদন করেছেন।
“এর মধ্যে একবার মাত্র ৬ লাখ টাকার একটু বেশি ব্যয়ে বাড়ি করে দেওয়ার জন্য এসেছিল। এ টাকায় কীভাবে পাকা ঘর হবে! তাই সরাসরি আমি বলে দিয়েছি আমার ঘর লাগবে না।”
সশ্বস্ত্র বাহিনী দিবসে বর্তমান সেনা প্রধান আবার আবেদন দিতে বলেছেন জানিয়ে বীর মুক্তিযোদ্ধা সাত্তার বলেন, “আমি বলেছি- স্যার আপনি এখন বলছেন আবেদন দিতে, এখান থেকে চলে যাওয়ার পর আমার আবেদন পড়েই থাকবে।”
ছোট সন্তানের পীড়াপীড়িতে একটি আবেদন করবেন জানিয়ে তিনি বলেন, “শেষ বয়সে একটু ইচ্ছে রয়েছে পাকা ঘরে থাকব।”