এ দুই উপজেলার অবস্থান একটু ভেতরে হওয়ায় এবং বন্যার ভয়াবহতার প্রচার না থাকায় কেউ তাদের উদ্ধার করতে আসছে না।
Published : 26 Aug 2024, 12:26 AM
বন্যা কবলিত কুমিল্লার অন্যান্য উপজেলায় ত্রাণ ও উদ্ধার তৎপরতা চললেও মনোহরগঞ্জ-নাঙ্গলকোটে পানিবন্দি মানুষ ত্রাণের জন্য হাহাকার করছেন।
তাদের অভিযোগ, এ দুই উপজেলার অবস্থান একটু ভেতরে হওয়ায় এবং বন্যার ভয়াবহতার প্রচার না থাকায় কেউ তাদের উদ্ধার করতে আসছে না; তারা ত্রাণও পাচ্ছেন না।
রোববার এ দুই উপজেলার বিভিন্ন বন্যা কবলিত এলাকা ঘুরে জানা গেছে, স্থানীয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে আশ্রয়কেন্দ্র থেকে শুরু করে কয়েকটি স্থানে ত্রাণ সহায়তা দেওয়া হলেও চাহিদার তুলনায় একেবারেই অপ্রতুল। সেখানকার বানভাসি প্রায় পাঁচ লাখ মানুষ মানবেতর জীবনযাপন করছেন।
মনোহরগঞ্জ উপজেলার গাজিয়াপাড়া গ্রামের বাসিন্দা ও স্থানীয় সংবাদকর্মী আবদুল বাকী মিলন বলেন, “বুড়িচংসহ অন্যান্য উপজেলার আগে মনোহরগঞ্জ উপজেলা পুরোপুরি প্লাবিত হয়। কিন্তু বিষয়টি সেভাবে আলোচনায় আসেনি। আমাদের গ্রামসহ আশপাশের গ্রামগুলোতে সরকারি বা স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের মাধ্যমে এখনো কোনো ত্রাণ সহায়তা পৌঁছায়নি। খাবারের কষ্টে মানুষ হাহাকার করছে।
“দোকানপাটেও তেমন খাদ্যসামগ্রী নেই, থাকলেও দাম অনেক বেশি নেওয়া হচ্ছে। ১৪০০-১৫০০ টাকার গ্যাস সিলিন্ডার বিক্রি হচ্ছে তিন থেকে চার হাজার টাকায়। সাধারণ মানুষ জিম্মি হয়ে পড়েছেন। এসব বিষয়ে তদারকিসহ এ উপজেলাকে দ্রুত দুর্গত এলাকা ঘোষণা করে পর্যাপ্ত ত্রাণ সহায়তা দেওয়া দরকার।”
‘আমাদের নৌকা ও স্পিডবোট দরকার’
কুমিল্লায় আকস্মিক বন্যার আঘাতে ডাকাতিয়া নদীর পানি বেড়ে সর্বপ্রথম প্লাবিত হয় চৌদ্দগ্রাম, নাঙ্গলকোট, মনোহরগঞ্জ ও লাকসাম উপজেলা। এরপর বৃহস্পতিবার রাতে গোমতী নদীর প্রতিরক্ষা বাঁধ ভেঙে প্লাবিত হয় বুড়িচং আশপাশের কয়েকটি উপজেলা।
জেলার ১৭টি উপজেলার মধ্যে ১৪টি উপজেলাই বানের পানিতে নিমজ্জিত। পানিবন্দি অন্তত ১৫ লাখ মানুষ। প্রতিদিনই নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে।
নাঙ্গলকোট ও মনোহরগঞ্জ উপজেলার পানিবন্দি মানুষদের অভিযোগ, দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আসা ত্রাণ ও উদ্ধারকর্মীরা বুড়িচং, চৌদ্দগ্রাম, দাউদকান্দি, লাকসাম এসব এলাকায় বেশি প্রবেশ করছেন। স্থানীয় সামান্য কিছু উদ্যোগ ছাড়া ত্রাণ পাচ্ছেন না নাঙ্গলকোট ও মনোহরগঞ্জ উপজেলার লাখ লাখ পানিবন্দি মানুষ।
রোববার সকালে এ দুই উপজেলার অন্তত ১০ জনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ত্রাণ ও উদ্ধার কাজ করা বাইরের স্বেচ্ছাসেবকরা একদম আসছেন না এ দুই উপজেলায়। মনোহরগঞ্জ ও নাঙ্গলকোট উপজেলা একেবারেই নোয়াখালীর পাশে। মহাসড়ক থেকে দূরের উপজেলা হওয়ায় সেখানে বানভাসিদের কাছে যাচ্ছেন না কেউই। যার কারণে এ দুই উপজেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলের পানিবন্দি মানুষের মধ্যে হাহাকার বেড়েই চলেছে।
নাঙ্গলকোটের বাসিন্দা আজিম উল্যাহ হানিফ বলেন, “উপজেলার সাতবাড়িয়া গত কয়েক দিন ধরে পানির নিচে। এলাকাটা অনেক ভেতরে হওয়ায় কেউই সেখানে যাচ্ছেন না। যার কারণে তাদের খাবার সংকট দেখা দিয়েছে। এমন অবস্থা পুরো উপজেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলের গ্রামগুলোতে। সংবাদমাধ্যম এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচার কম থাকায় ত্রাণ ও উদ্ধার কাজ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন এসব এলাকার বানভাসি মানুষজন।”
আবুল কালাম আজাদ নামে মনোহরগঞ্জ উপজেলার এক মাদ্রাসা শিক্ষক বলেন, “এ উপজেলা আগে থেকেই ‘জলাঞ্চল’ নামে পরিচিত। এ উপজেলা নিন্মাঞ্চল হওয়ায় পানিতে মানুষ খুবই কষ্ট পাচ্ছে। পানিবন্দি মানুষদের উদ্ধারে নৌকা ও স্পিডবোট দরকার। কিন্তু এখানে তেমন কোনো সহায়তা এখনো আসেনি। মানুষ কষ্টে আছে।
“পুরো উপজেলার প্রায় সব সড়ক পানির নিচে। পুকুর-দিঘি থেকে শুরু করে মাছের ঘের- সব কিছুই প্লাবিত হয়েছে। মানুষের দুর্ভোগ এখন অবর্ণনীয়।”
নাঙ্গলকোট উপজেলার বক্সগঞ্জের বাসিন্দা ফখরুল ইসলাম বলেন, “দুর্গম এলাকা হওয়ায় এখানে কোনো সাংবাদিকও আসেন না। আমরা যে পানিতে তলিয়ে আছি, আমাদের খবরগুলো প্রচার করেন না। আমাদের এদিকে শুকনো খাবার, বিশুদ্ধ পানির খুব প্রয়োজন। সরকারি সহায়তা আমাদের জন্য যথেষ্ট নয়। মানুষ খাবার না পেয়ে কষ্টে আছে।”
ঢালুয়া গ্রামের বাসিন্দা মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, “পুরো নাঙ্গলকোটে শুধু পানি আর পানি। অনেক অসুস্থ মানুষ, বৃদ্ধ মানুষ, গর্ভবতী নারীও আটকে আছে। তাদের উদ্ধার করা খুব দরকার, পাশাপাশি ত্রাণ সহায়তাও।”
অনেক জায়গায় পৌঁছানো যাচ্ছে না: ইউএনও
নাঙ্গলকোট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সুরাইয়া আক্তার লাকী ত্রাণ সংকটের কথা স্বীকার করেই বলেছেন, সব জায়গায় পৌঁছানো যাচ্ছে না।
তিনি বলেন, “নাঙ্গলকোটে ত্রাণ সরবরাহে কিছুটা সংকট আছে আমরা সেটা স্বীকার করছি। এ উপজেলার কিছু জায়গায় একেবারেই পৌঁছানো যাচ্ছে না। তবে আমরা চেষ্টা করছি, স্বেচ্ছাসেবকদের মাধ্যমে তাদের কাছে ত্রাণ সহায়তা দেওয়ার। আমরা চেষ্টা করছি, সব মানুষকে সহায়তা দেওয়ার।”
মনোহরগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) উজালা রানী চাকমা বলেন, “উপজেলার বন্যা পরিস্থিতি প্রতিনিয়ত অবনতির দিকে যাচ্ছে। আজও পানি কিছুটা বেড়েছে। মনোহরগঞ্জ উপজেলার অনেক দুর্গম এলাকা রয়েছে যেগুলোতে নৌকা ছাড়া যাওয়া একেবারেই অসম্ভব। আমাদের কাছে নৌকার প্রচুর সংকট রয়েছে।
“বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনকে পাঠিয়ে সেসব এলাকায় ত্রাণ সহায়তা পাঠানো হচ্ছে। আমরা চেষ্টা করছি যেন একটা মানুষও অভুক্ত না থাকে। তবে আমাদের আরও অনেক সহায়তা দরকার। আমি অনুরোধ করবো, বিত্তশালীরা বানভাসি মানুষের জন্য এগিয়ে আসুন।”
চৌদ্দগ্রামেও ত্রাণের সংকট
এদিকে, জেলার চৌদ্দগ্রামেও ত্রাণের সংকট দেখা দিয়েছে।
চৌদ্দগ্রাম উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মোহাম্মদ রহমত উল্লাহ রোববার বিকালে বলেন, “এ উপজেলার বন্যার পানি খুবই ধীরগতিতে নামার ফলে বন্যাকবলিত লোকজনের ত্রাণের চাহিদা বাড়ায় জরুরি ত্রাণ সহায়তা প্রয়োজন। সমাজের বিত্তশালী লোকজনসহ সকলকে অনুরোধ করছি এগিয়ে আসার জন্যে।”
যারা স্বেচ্ছায় ত্রাণ দিয়ে যাচ্ছেন তাদেরকে উপজেলা প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণ কক্ষে যোগাযোগ করার অনুরোধ জানিয়ে তিনি বলেন, “এতে ত্রাণ ব্যবস্থাপনা সুন্দর হবে। শুকনো খাবারের সঙ্গে মোমবাতি, দেয়াশলাই, শিশুখাদ্য, স্যানিটারি ন্যাপকিন এবং বাচ্চাদের ডায়াপারের অনেক চাহিদা রয়েছে। আকস্মিক এমন বড় বন্যায় এখানকার মানুষ দিশেহারা হয়ে পড়েছেন।”