কুমিল্লায় সওজের জায়গায় বহিষ্কৃত ছাত্রলীগ নেতার স্থাপনা

দখলের কথা স্বীকার করে ওই ছাত্রলীগ নেতা বলেন, “সরকারি খাল ভরাট করে দোকান নির্মাণ করেছি; প্রয়োজন হলে সরকার ভেঙে নিয়ে যাবে।”

আবদুর রহমানকুমিল্লা প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 6 Oct 2023, 04:08 AM
Updated : 6 Oct 2023, 04:08 AM

কুমিল্লার মনোহরগঞ্জ উপজেলায় সড়ক ও জনপথ বিভাগের জায়গা দখল করে স্থাপনা নির্মাণ করার অভিযোগ উঠেছে বহিষ্কৃত এক ছাত্রলীগ নেতার বিরুদ্ধে।

এতে চলাচলের রাস্তা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসীর জায়গায় বাড়ি নির্মাণ বাধার মুখে পড়েছে। পথ ছাড়ার বিনিময়ে পাঁচ লাখ টাকা চাঁদা দাবির অভিযোগ উঠেছে ওই ছাত্রলীগ নেতার বিরুদ্ধে।

বহিষ্কৃত ওই ছাত্রলীগ নেতা জিয়াউর রহমান ওরফে জিয়া উপজেলার উত্তর হাওলা ইউনিয়নের হাতিমারা গ্রামের বাসিন্দা। তিনি নাথেরপেটুয়া ডিগ্রি কলেজ শাখা ছাত্রলীগের আহ্বায়ক ছিলেন। সংগঠনবিরোধী কর্মকাণ্ডে যুক্ত থাকায় ২০২১ সালের ৫ জুন তাকে বহিষ্কার করা হয় বলে উপজেলা ছাত্রলীগের একাধিক নেতা জানান।

কুমিল্লা-নোয়াখালী আঞ্চলিক মহাসড়কে উপজেলার নাথেরপেটুয়া বাজারের ভূঁইয়া মেডিকেল নামে একটি ক্লিনিকের উত্তর পাশে সওজের জায়গায় গত কয়েক বছরে তিনটি পাকা দোকান ঘর নির্মাণ করে সেগুলো মাসিক ভাড়ায় দিয়েছেন জিয়া।

দখলকৃত ওই জায়গার পেছনে যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী উপজেলার হাতিমারা গ্রামের বাসিন্দা মো. মিজানুর রহমানের ১৯ শতক সম্পত্তি রয়েছে। ওই সম্পত্তিতে বর্তমানে বাড়ি নির্মাণ করতে চাইছেন তিনি। কিন্তু এরই মধ্যে ছাত্রলীগ নেতা জিয়া ওই প্রবাসীর চলাচলের পথ বন্ধ করে দিয়েছেন।

সওজের জায়গা দখলের কথা স্বীকার করে বহিষ্কৃত ছাত্রলীগ নেতা জিয়া বলেন, “সরকারি খাল ভরাট করে দোকান নির্মাণ করেছি; প্রয়োজন হলে সরকার ভেঙে নিয়ে যাবে।”

প্রবাসীর পরিবারের সদস্যদের অভিযোগ, সওজের জায়গা হয়ে মহাসড়কে চলাচলের পথ দিতে ওই যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসীর কাছে পাঁচ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করেছেন জিয়া। চাঁদা দিতে রাজি না হওয়ায় প্রবাসীর ছেলের ওপর হামলা চালানোর অভিযোগও উঠেছে।

এ ঘটনায় ২৬ সেপ্টেম্বর কুমিল্লার একটি আদালতে জিয়াকে প্রধান আসামি করে মামলা দায়ের করেছেন প্রবাসীর ছেলে জোনায়েদুর রহমান ওরফে জুলহাস।

সরজমিনে স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রবাসী মিজানুর রহমানের পরিবারের সদস্যরা জিয়ার নির্মাণ করা স্থাপনার উত্তর পাশের একটু খালি জায়গা দিয়ে চলাচল করত। সওজের মালিকানাধীন ওই খালি জায়গাতেও বর্তমানে আরেকটি দোকান নির্মাণের চেষ্টা করছেন ছাত্রলীগ নেতা জিয়া। এজন্য ওই প্রবাসীর জায়গার টিনের বেড়া ভেঙে দিয়েছেন তিনি। 

প্রবাসী মিজানের ছেলে জুলহাস বলেন, “সওজের সম্পত্তিতে ভবিষ্যতে সড়ক আরও বড় হবে। আমাদের সম্পত্তি থেকে বের হয়ে সড়কে ওঠে চলাচল করব- এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু জিয়া আমাদের এখানে বাড়ি করতেই দিচ্ছে না। গত ২৫ সেপ্টেম্বর আমার ওপর হামলা চালিয়ে আমাদের চলাচলের পথ বন্ধ করে দিয়েছে। এখন বলেছে, আমরা তাকে পাঁচ লাখ টাকা চাঁদা দিলে একমাত্র চলাচলের রাস্তাটি পাব। না হলে এখানে বাড়ি নির্মাণ করতে পারব না।

“তিনি হামলা চালিয়ে আমাদের দেওয়া টিনের বেড়া ও ঘর ভাঙচুর করেছেন; আমাকে পিটিয়েছেন। এ ঘটনায় কুমিল্লার জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম আদালতে মামলা করেছি।”

জুলহাস আরও বলেন, “আমার বাবা যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী আর আমি এলাকার বাইরে পড়াশোনা করি। এজন্য জিয়া সওজের পাশাপাশি আমাদের সম্পত্তিও দখল করতে চাইছে। মাদক কারবার ও সেবনের জন্য তাকে দল থেকে বহিষ্কার করা হলেও এখনও তার দাপট কমেনি। তার ভয়ে এলাকার মানুষ তটস্থ। তিনি এলাকায় একজন সন্ত্রাসী হিসেবে পরিচিত। এজন্য তিনি চেয়ারম্যান-মেম্বার কাউকে পাত্তা দেন না।”

মামলার বিষয়টি নিশ্চিত করে আইনজীবী শেখ মাসুদ ইকবাল বলেন, “মামলায় জিয়াকে প্রধান করে আরও চারজনকে আসামি করা হয়েছে। আদালত মামলাটি পিবিআইকে তদন্তের জন্য বলেছে।”

জুয়েল মিয়া নামে স্থানীয় এক বাসিন্দা বলেন, “জিয়ার বিরুদ্ধে সরকারি ও ব্যক্তিগত জায়গা দখলের অনেক অভিযোগ আছে। এসব ঘটনায় আদালতে বেশ কয়েকটি মামলা চলছে।”

হাতিমারা গ্রামের এক ব্যক্তি তার বিরুদ্ধে এমন একটি ঘটনায় চলতি বছর আদালতে মামলা করেছেন বলে দাবি জুয়েল মিয়ার। 

স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ সদস্য নুরুন্নবী বলেন, “আমরা অনেকবার সালিশ বৈঠক করে জিয়াউর রহমানকে নিষেধ করেছি, প্রবাসীর সঙ্গে ঝামেলা না করার জন্য। কিন্তু তিনি কারও কথাই শুনেন না। ”

এসব অভিযোগ প্রসঙ্গে জিয়াউর রহমান ওরফে জিয়া বলেন, “যেখানে দোকান নির্মাণ করেছি- সেই সম্পত্তি গত ৪০ বছর ধরে আমার পরিবারের দখলে। তবে এই সম্পত্তির মালিক সরকার। আমি দখলসূত্রে মালিক।”

তার ভাষ্য, “সরকারের যখন দরকার হবে- তখন স্থাপনা ভেঙে দেবে বা আমরা সরিয়ে নেব। বর্তমানে যেখানে দোকান নির্মাণ করেছি, এখানে আগে খাল ছিল। কুমিল্লা-নোয়াখালী আঞ্চলিক মহাসড়ক চারলেন হওয়ার সময় সওজ খালের কিছু অংশ ভরাট করেছে; বাকিটা আমি নিজের টাকায় ভরাট করেছি। শুধু আমি নই- নাথেরপেটুয়া বাজারে আরও অনেকেই এভাবে দখল করেছে।” 

প্রবাসী মিজানের কাছে চাঁদা দাবি করার কথা অস্বীকার করে জিয়া বলেন, “আগে তাদের চলাচলের পথ ছিল অন্য পাশ দিয়ে। কিন্তু এখন তাদের সম্পত্তি ভাগ-ভাটোয়ারা হয়ে যাওয়ায় মিজানের চলাচলের অন্য কোনো পথ নেই। আমি মাটি ভরাট করে যে রাস্তা তৈরি করেছি- সেজন্য তাদের টাকা দিতে বলেছি মাত্র।”

জুলহাসের ওপর হামলা ও ভাঙচুরের অভিযোগ অস্বীকার করেন জিয়াউর।

এসব অভিযোগকে ‘মিথ্যা ও বানোয়াট’ আখ্যা দিয়ে তিনি বলেন, “মূলত ওই প্রবাসীর টাকা আছে- এজন্য সবাই তার পক্ষে কথা বলছে।”

জানতে চাইলে সড়ক ও জনপথ (সওজ) বিভাগ, কুমিল্লার নির্বাহী প্রকৌশলী সুনীতি চাকমা বলেন, “নাথেরপেটুয়া বাজারে আগেও আমরা উচ্ছেদ অভিযান চালিয়ে অনেক অবৈধ স্থাপনা ভেঙে দিয়েছি। শিগগিরই আমরা আবারও অভিযান চালাব। তখন এসব অবৈধ স্থাপনা ভেঙে দেওয়া হবে। কোনো দখলকারীদের ছাড় দেওয়া হবে না।”