দেবিদ্বারে এমপি-চেয়ারম্যানের ‘মারামারি’: ভোট আসছে, দ্বন্দ্বও বাড়ছে

দুই নেতার পুরানো দ্বন্দ্ব নতুন করে সামনে আসায় দলেরই ক্ষতি হচ্ছে বলে মনে করছেন তৃণমূলের কর্মীরা।

আবদুর রহমানকুমিল্লা প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 23 July 2022, 12:10 PM
Updated : 23 July 2022, 12:32 PM

কুমিল্লা-৪ আসনের সংসদ সদস্য রাজী মোহাম্মদ ফখরুল এবং দেবিদ্বার উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আবুল কালাম আজাদের ‘মারামারি’র ঘটনায় স্থানীয় আওয়ামী লীগে উত্তেজনা বিরাজ করছে। ‘আধিপত্য বিস্তারের জেরে’ দুই নেতার পুরানো দ্বন্দ্ব নতুন করে সামনে আসায় দলেরই ক্ষতি হচ্ছে বলে মনে করছেন তৃণমূলের কর্মীরা।

কুমিল্লা-৪ আসনটি দেবিদ্বার উপজেলা নিয়ে গঠিত। এখানে সংসদ সদস্য রাজী মোহাম্মদ ফখরুল এবং দেবিদ্বার উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আবুল কালাম আজাদের নিজস্ব সমর্থক গোষ্ঠী রয়েছে। এর বাইরেও কুমিল্লা উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক রওশন আলী মাস্টারের সমর্থকরাও সক্রিয় রয়েছে বলে তৃণমূলের নেতাকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে।

এসব দ্বন্দ্বের জেরে আড়াই দশকেও দেবিদ্বার উপজেলা আওয়ামী লীগের সম্মেলন হয়নি। এর মধ্যে সম্মেলনের উদ্যোগ নেওয়া হলে ১৬ জুলাই জাতীয় সংসদের মেম্বারস ক্লাবে সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটির সভায় দুই নেতার ‘মারামারি’ হয় বলে সভায় উপস্থিত আওয়ামী লীগ নেতারা জানান। তারপরই একে অপরের বিরুদ্ধে ঝাড়ু মিছিল, বিক্ষোভ সমাবেশ, সড়ক অবরোধের মধ্য দিয়ে দেবিদ্বারে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে নতুন করে উত্তেজনার সৃষ্টি হয়।

বিষয়টি সমাধান করতে রোববার ঢাকায় বৈঠক ডেকেছে আওয়ামী লীগ। দলের চট্টগ্রাম বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত সাংগঠনিক সম্পাদক আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন বলেন, “এমপি রাজী, উপজেলা চেয়ারম্যান আজাদ ছাড়াও কুমিল্লা উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক, উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক এবং দেবিদ্বারের যারা কুমিল্লা উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের কমিটিতে আছেন তাদেরকে ওই বৈঠকে উপস্থিত থাকতে বলা হয়েছে।

“রোববার তাদেরকে ঢাকায় আসতে বলা হয়েছে। আশা করছি, সেখানে সবাই উপস্থিত থাকবেন। বৈঠকে চলমান সমস্যার সমাধান হবে বলে আশা করছি।”

দেবিদ্বার উপজেলা আওয়ামী লীগের কর্মী আবদুল হান্নান, হুমায়ুন কবির, আবুল বাশার, সামছুল ইসলাম, আবদুল মমিনসহ অন্তত ১০ তৃণমূল কর্মীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বর্তমান সংসদ সদস্য রাজী মোহাম্মদ ফখরুল এবং উপজেলা চেয়ারম্যান আবুল কালাম আজাদ দুজনই দলের মনোনয়ন চাইবেন। নির্বাচন যত এগিয়ে আসছে, দুই নেতার দ্বন্দ্বও তত প্রকাশ্যে আসছে। আগামী দিনে এটা বাড়বে বলেই ধারণা তৃণমূলের কর্মীদের।

দেবিদ্বার উপজেলায় এক সময় সাবেক মন্ত্রী ও কুমিল্লা উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের বর্তমান জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি এ বি এম গোলাম মোস্তফা সঙ্গে তার ভাগ্নে আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য এ এফ এম ফখরুল মুন্সীর দ্বন্দ্ব আলোচনায় ছিল। মামা গোলাম মোস্তফা রাজনীতিতে সক্রিয় থাকলেও ভাগ্নে ফখরুল মুন্সী রাজনীতির মাঠ থেকে নিজেকে অনেকটাই গুটিয়ে নিয়েছেন। এখনও এই দুই নেতার অনুসারীরা দলের মধ্যে রয়েছেন। এই দুই নেতাই জাতীয় সংসদের সদস্য ছিলেন; এবং জাতীয় পার্টি থেকে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে আসেন তারা।

স্থানীয় নেতারা জানান, ২০০৯ সালের দেবিদ্বার উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে তৎকালীন উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও দলের প্রবীণ নেতা জয়নাল আবেদীনকে চেয়ারম্যান পদে সমর্থন দেয় আওয়ামী লীগ। গোলাম মোস্তফা ছিলেন আওয়ামী লীগের প্রার্থীর পক্ষে। সে সময় ফখরুল মুন্সী তার ছেলে রাজী মোহাম্মদ ফখরুলকে ‘বিদ্রোহী প্রার্থী’ হিসেবে দাঁড় করিয়ে জয়ী করেন। এরপর থেকে মামা-ভাগ্নের দূরত্ব বাড়তে থাকে।

জোট রাজনীতির সুবাদে ২০১৪ সালের নির্বাচনে দেবিদ্বার আসনটি জাতীয় পার্টিকে ছেড়ে দেয় আওয়ামী লীগ। ওই সময় দলের সিদ্ধান্ত না মেনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে হাতি মার্কা নিয়ে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন রাজী মোহাম্মদ ফখরুল। এরপর ২০১৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়নে দ্বিতীয়বার এমপি নির্বাচিত হন তিনি।

অপরদিকে ২০২১ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারির উপনির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন পান কুমিল্লা উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আবুল কালাম আজাদ। ওই নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী হন কুমিল্লা উত্তর জেলা বিএনপির সদস্য সচিব এ এফ এম তারেক মুন্সী; যিনি এমপি রাজী মোহাম্মদ ফখরুলের আপন চাচা। নির্বাচনে জয়লাভ করেন আবুল কালাম আজাদ। উপজেলা আওয়ামী লীগের প্রবীণ নেতা জয়নাল আবেদীনের মৃত্যুতে এই উপনির্বাচন হয়। তিনি বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় চেয়ারম্যান হয়েছিলেন।

তারেক মুন্সীকে সংসদ সদস্য রাজী নিজেই প্রার্থী করেছিলেন- এমন অভিযোগ করেছেন আবুল কালাম আজাদ।

উপজেলা চেয়ারম্যান বলেন, “এমপি আমার নির্বাচনে এবং আমার বাবার নির্বাচনে বিরোধিতা করেছেন। সারাদেশে বিএনপি ও ধানের শীষের কোনো ভোট নেই, খবর নেই। কিন্তু দেবিদ্বার উপজেলা পরিষদে চেয়ারম্যান পদে আমাকে পরাজিত করার জন্য তিনি তার আপন চাচার পক্ষে আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীদের লেলিয়ে দিয়েছেন। তখন প্রশাসন, গোয়েন্দা সংস্থা ও ভোটকেন্দ্রে রাজীর লোকজনের প্রভাবই সেটা বলে দেয়।“

“এমপি রাজীর নিজের ভোটকেন্দ্রে নৌকা ১৬ ভোট পায় উপজেলা নির্বাচনে। আর বিএনপির প্রার্থী পায় প্রায় এক হাজার ভোট। আমি দলের কাছে তার বিচার চাই।”

২০১৬ ও ২০২১ সালে দেবিদ্বার উপজেলার বরকামতা ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে আজাদের বাবা মো. নুরুল ইসলাম চেয়ারম্যান পদে প্রার্থী হন। দুবারই এমপি রাজি তার বিরোধিতা করেন বলে অভিযোগ করেন ছেলে উপজেলা চেয়ারম্যান আজাদ।

২ জুলাই বরকামতা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সম্মেলন হয় স্থানীয় নবীয়াবাদ এলাকার কুমিল্লা মডেল কলেজে। সম্মেলনে কোনো কমিটি ঘোষণা না করে সংসদ সদস্য পরে কমিটির নাম ঘোষণা করা হবে বলে জানান। এরপর আবুল কালাম আজাদের অনুসারী আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা কমিটি ঘোষণার দাবিতে রাত সাড়ে ৮টা থেকে রাত সাড়ে ১০টা পর্যন্ত সংসদ সদস্য রাজীর গাড়ি অবরুদ্ধ করে বিক্ষাভ করেন।

পরে কুমিল্লা উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক রোশন আলী মাস্টার বরকামতা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের নাম ঘোষণা করেন। এরপর সংসদ সদস্য রাজীর গাড়ি ছেড়ে দেওয়া হয়।

উপজেলা চেয়ারম্যান আবুল কালাম আজাদ বলেন, “তিনি (এমপি) দলের ১২টা বাজিয়ে চলেছেন। তিনি সব সময় বিএনপি-জামায়াতের পক্ষ নিয়ে থাকেন। ২০০১ সালে যারা আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের হাত-পায়ের রগ কেটেছে, তারাই এখন এমপির কাছের লোক এবং ঠিকাদারি করে।

“সম্প্রতি উপজেলার ১৫টি ইউনিয়নের মধ্যে ১১টি ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের কমিটি ঘোষণা করা হয়েছে। এমপির প্রভাবে অনেক স্থানে বিএনপি-জামায়াতের লোকজন আওয়ামী লীগের সভাপতি-সম্পাদক হয়েছে।”

এসব দ্বন্দ্বের মধ্যেই ১৬ জুলাই বিকালে ঢাকায় জাতীয় সংসদ এলাকার পার্লামেন্ট মেম্বারস ক্লাবে উপজেলা আওয়ামী লীগের সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটির বৈঠক বসে। দেবিদ্বার উপজেলা আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি আব্দুল মতিন সরকার সভার এক পর্যায়ে এলাহাবাদ ইউনিয়ন কমিটি ঘোষণার দাবি তোলেন। এ সময় উপস্থিত সদস্যরা তাতে সমর্থন দেন।

এরপর কুমিল্লা উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক রোশন আলী মাস্টার ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি হিসেবে সাবেক সভাপতি সিরাজুল ইসলাম সরকার এবং সাধারণ সম্পাদক হিসেবে আক্তারুজ্জামান স্বপনের নাম ঘোষণা করেন।

এমপি রাজী মোহাম্মদ ফখরুল বিষয়টি নিয়ে আপত্তি তোলেন। অন্যদিকে দেবিদ্বার উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আবুল কালাম আজাদ নতুন কমিটিকে সমর্থন দেন। তখন তার ওপর ‘চড়াও হন এমপি। পরে দুজনের মধ্যে ‘হাতাহাতি’ শুরু হয়।

২১ জুলাই সেই সম্মেলন হওয়ার কথা ছিল। সেই সম্মেলনে প্রধান অতিথি ছিলেন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ। সংসদ সদস্য ও উপজেলা চেয়ারম্যানের মারামারির কারণে তা স্থগিত করা হয়।

উপজেলা চেয়ারম্যানের সঙ্গে দ্বন্দ্ব, ঢাকায় ‘মারামারি’র বিষয়ে জানতে সংসদ সদস্য রাজী মোহাম্মদ ফখরুলের মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল করা হলেও তিনি সাড়া দেননি। এরপর প্রতিবেদনের বিষয়ে কথা বলার অনুরোধ জানিয়ে তার মোবাইলে এসএমএস পাঠানো হলেও তিনি কথা বলেননি।

তবে ফিরতি এসএমএসে এমপি রাজী বলেন, “জাতীয় সংসদ ভবনের এলডি হলে কী ঘটেছে সেটা আমাদের মাননীয় জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সবচেয়ে ভালো ব্যাখ্যা করতে পারবেন। একটা নরমাল লোক কীভাবে একজন সিনিয়রের ওপর আক্রমণ করতে পারে। তারপর ভুয়া তথ্যকে সত্য দাবি করে পার পেয়ে যেতে পারে, এটা বিস্ময়কর।”

চেয়ারম্যান আজাদকে ইঙ্গিত করে তিনি আরও বলেন, “একজন লোক ঢাকা মেডিকেলে ভর্তি হয়েছে, অথচ সে আহত নয়, এতেই তার অপপ্রচারের পেছনে অসৎ উদ্দেশ্য প্রমাণিত হয়। আল্লাহ পাক সবাইকে সত্য অনুধাবনের তৌফিক দান করুক।”

আর পড়ুন: