“প্রকাশ্যে আসিবুর আর শফিকের লড়াই হচ্ছে। কিন্তু আসলে লড়াইটা শাজাহান খান আর আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিমের অনুসারীদের মধ্যে।”
Published : 07 May 2024, 09:31 AM
মাদারীপুর সদর উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতা শাজাহান খানের ছেলে ও চাচাত ভাইয়ের মধ্যে লড়াই জমে উঠেছে। দুপক্ষের সমর্থক নেতাকর্মীরা ভোটারদের দ্বারে দ্বারে গিয়ে ভোট প্রার্থনা করছেন; দিচ্ছেন উন্নয়নের নানা প্রতিশ্রুতি।
একই পরিবারের সদস্য হলেও রাজনৈতিকভাবে দুজনের অবস্থান ভিন্ন মেরুতে। এর প্রভাব পড়েছে ভোটের মাঠেও। দুজন একে অপরের বিরুদ্ধে এরই মধ্যে ৩২টি অভিযোগ দিয়েছেন নির্বাচন কমিশনে।
সবশেষ রোববার দুপুরে শাজাহান খানের ছেলে যুবলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য মো. আসিবুর রহমান খান মাদারীপুর শহরের বাসায় সংবাদ সম্মেলন করে তার চাচা দুইবারের সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান পাভেলুর রহমান শফিক খানের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ করেন।
প্রথম ধাপে ৮ মে অনুষ্ঠেয় এ ভোটে দুপক্ষই জয়ের ব্যাপারে শতভাগ আশাবাদী হলেও ভোটাররা এখনও নিশ্চিত না বিজয়ের মুকুট কার মাথায় উঠবে।
মাদারীপুর-২ (রাজৈর ও সদর) আসনের সংসদ সদস্য ও আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য শাজাহান খানের বড় ছেলে আসিবুর রহমান খান আনারস প্রতীকে এবং দুইবারের সাবেক চেয়ারম্যান ও জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক পাভেলুর রহমান শফিক খান মোটরসাইকেল প্রতীকে ভোট করছেন।
জেলা আওয়ামী লীগের একজন নেতা বলেন, “এখানে প্রকাশ্যে আসিবুর খান আর শফিক খানের লড়াই হচ্ছে। কিন্তু আসলে লড়াইটা শাজাহান খান আর আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিমের অনুসারীদের মধ্যে।
“এখানে যদি সুষ্ঠু ভোট হয়, তাহলে কে পাস করবে বলা মুশকিল। কারণ, দুপক্ষই সমান শক্তিশালী। এটা এখন মর্যাদার লড়াই হয়ে উঠেছে।”
দ্বন্দ্বের শুরু
জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক পাভেলুর রহমান শফিক খান সাবেক নৌ পরিবহন মন্ত্রী শাজাহান খানের আপন চাচাত ভাই। শাজাহান খানের সমর্থন নিয়েই ২০০৯ এবং ২০১৪ সালে পর পর দুইবার উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন তিনি। দুজন তখন একই বলয়ে রাজনীতি করতেন।
কিন্তু ২০১৯ সালের পঞ্চম উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের সময় থেকে প্রেক্ষাপট পাল্টে যায়। সেবার সদর উপজেলায় আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পান জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক কাজল কৃষ্ণ দে। তখন শাজাহান খানের আপন ভাই ওবায়দুর রহমান খান নৌকার বিপরীতে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে দাঁড়ান এবং জয়লাভ করেন।
সেই নির্বাচনে পাভেলুর রহমান শফিক খান নিজে প্রতিদ্বন্দ্বিতা না করে নৌকা প্রতীকের প্রার্থী কাজল কৃষ্ণের পক্ষে প্রচার চালান এবং ভোটে সক্রিয় ছিলেন।
এরপরই মূলত পাভেলুর রহমান শফিক খান ভাই শাজাহান খানের বলয় ছেড়ে বাহাউদ্দিন নাছিমের সমর্থকদের সঙ্গে রাজনীতিতে সক্রিয় হতে থাকেন। সেই ধারাবাহিকতায় এবারের নির্বাচনে কাজল কৃষ্ণ দে মোটরসাইকেল প্রতীকের প্রার্থী পাভেলুর রহমান শফিক খানের পক্ষে প্রচারে সক্রিয় ভূমিকা রাখছেন।
ওবায়দুর রহমান খান এবার নির্বাচন না করলেও তিনি আপন ভাতিজা আসিবুর রহমান খানের পক্ষে প্রচার করছেন।
শাজাহান খানের ক্ষমতা ও প্রভাবের কারণে দলে বিভেদের আশঙ্কা করে জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক কাজল কৃষ্ণ দে বলেন, “শাজাহান খানের কর্মকাণ্ডে শুধু জেলা আওয়ামী লীগ নয়, কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগও বিব্রত। তিনি কোনো কিছুই মেনে চলেন না। তিনি দলের মধ্যে বিভেদ ও সংঘাত সৃষ্টি করছেন।”
তবে এ ধরনের অভিযোগ অস্বীকার করে শাজাহান খানের অনুসারী হিসেবে পরিচিত সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সৈয়দ সাখাওয়াত হোসেন বলেন, “আমরা সংঘাতের পক্ষে নই। যারা পরাজিত হওয়ার আশঙ্কা করছেন তারাই সংঘাত করে নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে চান।”
শাজাহান খান ও বাহাউদ্দিন নাছিমের দ্বন্দ্ব দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে। বাহাউদ্দিন নাছিম আগে মাদারীপুর-৩ (কালকিনি, ডাসার ও সদরের একাংশ) আসনের সংসদ সদস্য ছিলেন। এখন তিনি ঢাকা-৮ (রমনা) আসনের সংসদ সদস্য। মাদারীপুর জেলা আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে নাছিমের ব্যাপক প্রভাব রয়েছে।
জেলা আওয়ামী লীগ ও অঙ্গ সংগঠনের বড় অংশের নেতাকর্মীরা পাভেলুর রহমান শফিক খানের পক্ষে সক্রিয় রয়েছেন বলে তার সমর্থকরা দাবি করেছেন।
অন্যদিকে সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের একাংশ আসিবুর রহমান খানকে সমর্থন দিয়ে প্রচার চালাচ্ছেন।
এই নির্বাচনকে কেন্দ্র করে জেলা আওয়ামী লীগের পুরনো বিভেদ আবারও নতুন মাত্রা পেয়েছে বলে মনে করছেন তৃণমূলের নেতাকর্মীরা।
দিনে তিনটা করে অভিযোগ
প্রথম ধাপের উপজেলা নির্বাচনের মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের শেষ তারিখ ছিল ২২ এপ্রিল। ২৩ এপ্রিল প্রার্থীদের প্রতীক বরাদ্দ দেওয়া হয়। এরপর থেকে তারা ভোটের মাঠে প্রচারে রয়েছেন। সোমবার মধ্যরাত পর্যন্ত প্রার্থীরা প্রচার চালাতে পারবেন।
এক হিসাবে দেখা গেছে, প্রচারের ১০ দিনে পাভেলুর রহমান শফিক খান আচরণবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগ এনে শাজাহান খান ও তার ছেলে আসিবুরের বিরুদ্ধে মোট ২২টি অভিযোগ দিয়েছেন।
অপরদিকে আসিবুর রহমান খান তার প্রতিদ্বন্দ্বী পাভেলুর রহমান শফিক খানের বিরুদ্ধে ১০টি অভিযোগ দিয়েছেন। অর্থাৎ দুপক্ষ এখন পর্যন্ত মোট ৩২টি অভিযোগ দিয়েছেন।
সবশেষ রোববার সংবাদ সম্মেলনে আনারস প্রতীকের প্রার্থী আসিবুর রহমান খান বলেন, “পাভেলুর রহমান শফিক খান নির্বাচনে প্রভাব খাটাতে সরকারি কর্মকর্তাদের কাজে লাগাচ্ছেন। এজন্য ভোটারদের ভয়ভীতি দেখানো থেকে শুরু করে বিভিন্ন স্থানে ভোট কিনতে টাকা বিলাচ্ছেন। পাশাপাশি বিভিন্ন স্থানে বেশকিছু সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারী শফিক খানের নির্বাচনি প্রচারে অংশ নিচ্ছেন।
সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে আসিবুর বলেন, “আমার বাবা আটবারের সংসদ সদস্য। তার জনপ্রিয়তা আমার নির্বাচনকে বেগবান করেছে। তবে তিনি আমার নির্বাচনি কাজে অংশগ্রহণ করেননি। আমার বাবাকে নিয়ে কমিশনে পাঠানো অভিযোগ ভিত্তিহীন।”
“তারা যে অভিযোগ দিচ্ছে, তারাই সেই অপরাধ করছেন। আমরাও তাদের বিরুদ্ধে আচরণবিধি লঙ্ঘনের ১০-১২টি অভিযোগ দিয়েছি। তাদের সব অভিযোগ ভিত্তিহীন। আমরা বিধি অনুযায়ী প্রচার চালাচ্ছি।”
অপরদিকে পাভেলুর রহমান শফিক খান বলছেন, “স্থানীয় কর্মসূচির নামে টানা ১০দিন এলাকায় থাকবেন শাজাহান খান। নির্বাচন শেষ হলে ঢাকায় যাবেন। তিনি ছেলের পক্ষে সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে কাজ করছেন। আচরণবিধি মানছেন না। তার বিরুদ্ধে কমিশনে অভিযোগ দিয়েও সুরাহা হচ্ছে না।
“আমরা এখন অনেকটা নিরুপায়। তিনি এখন আচরণবিধির তোয়াক্কা না করে এলাকায় মাস্তানি করে বেড়াচ্ছেন। নির্বাচনে তার টাকার প্রভাবও দেখাচ্ছেন।”
এসব ব্যাপারে জানতে চাইলে মাদারীপুর সদর উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের রিটার্নিং কর্মকর্তা আহমেদ আলী বলেন, “সংসদ সদস্য এলাকায় অবস্থান করলে কোনো সমস্যা নেই। তবে তিনি নির্বাচনি প্রচারে থাকতে পারবেন না। তার বিরুদ্ধে পাভেলুর রহমান শফিক খান অভিযোগ দিয়েছেন। আমরা অভিযোগটি আমলে নিয়ে অনুসন্ধান করছি।
“শাজাহান খান আচরণবিধি লঙ্ঘন করলে কমিশনকে জানানো হবে। এ ছাড়া অন্য অভিযোগের ব্যাপারে প্রার্থীর কাছে জবাব চাওয়া হয়েছে।”
শাজাহান খানের ১০ দিনের কর্মসূচি
দলীয় বিভেদ এড়াতে আওয়ামী লীগ স্থানীয় সরকার নির্বাচনে কোনো প্রার্থী মনোনয়ন বা সমর্থন দিচ্ছে না। পাশাপাশি এমপি-মন্ত্রীদের সন্তান ও স্বজনরা যে নির্বাচনে অংশ না নেন সেজন্যও দলীয়ভাবে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
এই নির্দেশের পর অনেক জায়গায় এমপি-মন্ত্রীর সন্তান ও স্বজনরা নির্বাচনের মাঠ থেকে সরে গেলেও শাজাহান খানের ছেলে ভোটের লড়াইয়ে রয়েছেন।
ছেলেকে প্রার্থী করে শাজাহান খান দলীয় নির্দেশ অমান্য করেছেন- এমন অভিযোগও করেছেন দলের প্রতিপক্ষের অনেকেই। তারা আচরণবিধি ভঙ্গ করে ‘গোপনে ও কৌশলে’ ছেলের পক্ষে প্রচার চালানোর অভিযোগও এনেছেন সাবেক মন্ত্রীর বিরুদ্ধে।
এর মধ্যেই টানা ১০ দিন (২ মে থেকে) শাজাহান খান সংসদীয় আসনে অবস্থান করে পূর্ব নির্ধারিত কর্মসূচি পালন করবেন বলে জানানো হয়েছে। যদিও নির্বাচন আইন অনুযায়ী, সংসদ সদস্যের নিজের নির্বাচনি এলাকায় থাকতে কোনো বাধা নেই। তবে তিনি কোনো প্রচার চালাতে কিংবা কোনো প্রার্থীর পক্ষে প্রভাব বিস্তার করতে পারবেন না।
তবে প্রতিপক্ষ শাজাহান খানের বিরুদ্ধে সেই অভিযোগই তুলেছেন।
শাজাহান খানের সমালোচনা করে জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি শাহাবুদ্দিন আহমেদ মোল্লা বলেন, “শাজাহান খান ছেলেকে জেতাতে ভোটারদের দ্বারে দ্বারে গিয়ে ভোট চাইছেন। বিভিন্ন এলাকায় গোপনে সভা করছেন। তার পক্ষে গ্রামের মুরুব্বিদের ম্যানেজ করে আনতে যা যা করা লাগছে, সবই করছেন।
“তিনি দলীয় সিদ্ধান্ত মানছেন না। আচারণবিধিরও তোয়াক্কা করছেন না। তার এমন কর্মকাণ্ডে আমরা যারা আওয়ামী লীগের কর্মী আছি, সবাই বিব্রত হচ্ছি।”
তবে অভিযোগ অস্বীকার করে সংসদ সদস্য শাজাহান খান বলেন, “আমি বাড়িতে থাকি। বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজে সময় দেই। বাড়িতে বিভিন্ন কাজে লোকজন আসে, তাদের সময় দেই, কথা বলি।
“নির্বাচন নিয়ে কোনো কাজ আমি করি না। যিনি আমাদের বিরুদ্ধে নির্বাচনে প্রভাব বিস্তারের কথা বলেছেন, তিনি মিথ্যা অভিযোগ দিয়েছেন। আমি কি আমার বাড়িতে থাকতে পারব না?”
১ মে রাতে সদর উপজেলার বাহাদুরপুর ইউনিয়নের মিঠাপুর এলাকায় এক অসুস্থ ব্যক্তিকে দেখতে যান শাজাহান খান। সেখানে বাহাদুরপুর ইউপির চেয়ারম্যান ও সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সৈয়দ সাখাওয়াত হোসেনসহ স্থানীয় নেতা-কর্মীদের দেখা যায়।
বিরোধীদের অভিযোগ শাজাহান খান সেখানে ছেলের হয়ে প্রচারে গিয়েছিলেন।
তবে এ ধরনের অভিযোগ অস্বীকার করেছেন ঘটনাস্থলে থাকা সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সৈয়দ সাখাওয়াত হোসেন।
তিনি বলেন, “ঢাকা থেকে বাড়িতে ফেরার পথে ধুরাইলে রাত ১১টায় একটি জানাজায় অংশ নেন শাজাহান খান। পরে আমার এলাকায় দুজন প্রবীণ ব্যক্তিকে দেখতে যান। তিনি কোনো প্রচার চালাননি। নিজের নির্বাচনি এলাকায় সাধারণ মানুষের খোঁজ-খবর নেওয়া তো অপরাধ নয়। এটি নির্বাচনের অংশ না।”
# ১৫টি ইউনিয়ন ও একটি পৌরসভা নিয়ে গঠিত ২৮৩ দশমিক ১৪ কিলোমিটার আয়তনের সদর উপজেলায় মোট ভোটার ৩ লাখ ২২ হাজার ৪২৬ জন। এর মধ্যে পুরুষ ভোটার ১ লাখ ৬৬ হাজার ও নারী ভোটারের সংখ্যা ১ লাখ ৫৬ হাজার ৪২১ জন। আর ৫ জন রয়েছে হিজড়া ভোটার।
# এখানে ১১৭টি কেন্দ্রে ৭৯৪টি বুথে ভোট দেবেন ভোটাররা।
# প্রথম উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ছিলেন জাতীয় পার্টির সিরাজুল ইসলাম বাচ্চু ভুঁইয়া, দ্বিতীয়বার চেয়ারম্যান হন বিএনপির আবু মুন্সী। তৃতীয় ও চতুর্থবারে পাভেলুর রহমান শফিক খান এবং পঞ্চমবারে ওবায়দুর রহমান খান চেয়ারম্যান হন।
# সদর উপজেলা নির্বাচনে সাধারণ ভাইস চেয়ারম্যান পদে মনিরুল ইসলাম তুষার ভুঁইয়া, সাবেক পৌর কাউন্সিলর মনিরুজ্জামান আফসার হাওলাদার এবং সাবেক ছাত্রলীগ নেতা বোরহান উদ্দিন সরদার বিতান প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন।
# সংরক্ষিত মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান পদে জেলা যুব মহিলা লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ফারহানা নাজনীন, ফারিয়া হাসান রাখি, বর্তমান ভাইস চেয়ারম্যান ডেউজি আফরোজ, সাবেক ছাত্রলীগ নেত্রী হেনা খানম এবং সাবেক ইউপি সদস্য তাজনাহার তাজু লড়াই করছেন।