লালমনিরহাটে ৫৫টি ইটভাটার মধ্যে ৩২টির কোনো কাগজপত্র নেই বলে জানিয়েছে পরিবেশ অধিদপ্তর।
Published : 25 Mar 2025, 01:14 PM
সকালে সূর্য উঠে ঠিকই কিন্তু লালমনিরহাটের বেশ কিছু এলাকায় নীল আকাশ দেখা যেন ভাগ্যের ব্যাপার। দিনভর ধোঁয়ায় ঢাকা থাকে চারপাশ। রাস্তায় চলতে থাকা ট্রাক আর ইটভাটার চিমনি থেকে বের হওয়া ধোঁয়ায় শ্বাস নিতেও কষ্ট হয়।
পরিবেশ অধিদপ্তর ও জেলা প্রশাসন অবৈধ ইটভাটার বিরুদ্ধে অভিযান চালালেও কার্যত তার সুফল মিলছে না। অভিযোগ রয়েছে, অভিযানের কয়েকদিন পর আবার চালু করা হয় অবৈধ ইটভাটার কার্যক্রম। এলাকাবাসী বলছেন, এ যেন ‘ইঁদুর-বেড়াল খেলা’।
তবে লালমনিরহাট জেলা প্রশাসক এইচ এম রকিব হায়দারের দাবি, অবৈধ সব ইটভাটা বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। তবে কেউ আবার চালু করলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
ইটভাটার ধোঁয়ায় পরিবেশের ক্ষতির পাশাপাশি সেখানে জমির ‘টপ-সয়েল’ বা উপরিভাগের মাটি পোড়ানো হয় বলে অভিযোগ কালীগঞ্জ উপজেলার শ্রীখাতার কৃষক রবিউল ইসলামের।
তিনি বলেন, “ইটভাটা এমনভাবে জমির টপ-সয়েল তুলে নিচ্ছে, যে এখন জমিতে চাষাবাদই হয় না। প্রশাসন থেকে বুলডোজার এলেও কাজের কাজ কিছু হয়নি। সামান্য ভেঙে দেওয়া চিমনি ঠিক করে আবার চালু করা হচ্ছে।”
একই উপজেলার শ্রীখাতা এলাকার শিক্ষার্থী আজিজার বলেন, “আকাশে ধোঁয়ার পর্দা যতদিন থাকবে, ততদিন প্রশ্ন থাকবেই ‘অভিযান কি সত্যিই সমাধান’, নাকি শুধু ‘দেখানোর’ নাম?”
জেলা প্রশাসন ও পরিবেশ অধিদপ্তরের তথ্য মতে, জেলায় বর্তমানে ইটভাটার সংখ্যা ৫৫টি। এর মধ্যে ৩২টি ভাটার কোনও কাগজপত্র নেই বললেই চলে। যেগুলো চলছে, তার অধিকাংশই রিট পিটিশন কিংবা স্থানীয় প্রভাবশালীদের ছত্রছায়ায়।
এর আগে ১২ মার্চ হাই কোর্টের নির্দেশে কালীগঞ্জ, হাতীবান্ধা, আদিতমারীসহ বিভিন্ন উপজেলায় অভিযান চালিয়ে ছয়টি অবৈধ ইটভাটার আংশিক ভেঙে দেওয়া হয়। কিন্তু অভিযান শেষ হওয়ার কয়েকদিনের মধ্যেই সেগুলো আবার চালু করা হয়।
স্থানীয়দের অভিযোগ, এসব অভিযান মূলত লোক দেখানো। ভাটার চিমনির সামান্য অংশ ভাঙা ও কিছু ইট ভিজিয়ে দেওয়া ছাড়া তেমন কিছুই হয়নি। ফলে ভাটা মালিকরা সহজেই তা সংস্কার করে আবার চালু করছেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, জেলা সদরসহ বিভিন্ন উপজেলার অবৈধ বিবিএমসি ব্রিকস, এমজেএ-২, সান টু ব্রিকস, এলএমবি, টিএমএন এবং ওয়ান স্টার ভাটা গুঁড়িয়ে দেওয়ার কয়েকদিন পর আবার চালু করা হয়েছে। এমনকি চালু করতে নেওয়া হয়নি পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্রও।
এর আগে ১২ জানুয়ারি ও ৬ ফেব্রুয়ারি কালীগঞ্জ উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক জাহাঙ্গীর আলমের এমজেএ-২ ভাটাটির কার্যক্রম বন্ধ করতে দুই দফায় চিঠি দেয় উপজেলা প্রশাসন। এরপর ১১ ফেব্রুয়ারি ওই ভাটায় অভিযান চালায় পরিবেশ অধিদপ্তর ও দুই নির্বাহী হাকিম।
ঘটনার দিন বিএনপি নেতা তার লোকজন ও ভাটার ট্রাক দিয়ে অভিযানিক দলকে অবরুদ্ধ করে রাখেন। সেই ঘটনায় পাঁচজনের বিরুদ্ধে মামলাও করে প্রশাসন। পরে ১২ মার্চ অবৈধ ভাটাটি ধ্বংস করে বুলডোজার নিয়ে আংশিক গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়; যা আবার চালু করা হয়েছে।
এ বিষয় নিয়ে কথা বলতে বিএনপি নেতা জাহাঙ্গীর আলমের মোবাইলে একাধিকবার কল করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি।
জেলা সদর উপজেলার কুলাঘাট ধাইরখাতা এলাকায় ফিলিং স্টেশনের ২০০ গজের মধ্যে এসএস ব্রিকস নামের একটি ভাটা রয়েছে। প্রয়াত ব্যবসায়ী ফজল মিয়ার ছেলে সোহাগ ও সম্রাটের নামে রয়েছে এসএস ব্রিকস এবং কর্ণপুরের হাজী ব্রিকস। দুটি ভাটাই চলছে হাই কোর্টের রিট পিটিশনের মাধ্যমে।
লালমনিরহাট জেলা বিএনপির সহসভাপতি রোকন উদ্দিন বাবুলের মালিকানাধীন আদিতমারী উপজেলার কমলাবাড়ি চন্দপাট গ্রামের ‘বিটি ব্রিকস’ ভাটার নেই পরিবেশের ছাড়পত্র। তবুও সেটি চলছে। সদর উপজেলার ইট ব্যবসায়ী সিরাজুল হকের মালিকানাধীন ওয়ান স্টার, টু স্টার ও থ্রি-স্টার নামে তিনটি ইটভাটা। একটি ভাটারও বৈধ কোনো কাগজপত্র নেই।
লালমনিরহাট পরিবেশ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক বিজন কুমার রায় বলেন, “ভেঙে ফেলা ইটভাটাগুলো পুনরায় চালু হয়েছে, সেটি স্থানীয় প্রশাসন থেকে জানতে পেরেছি। এ নিয়ে উপজেলা প্রশাসন এবং জেলা প্রশাসন কাজ করছে। তারা আমাদের যেভাবে নির্দেশনা দেবেন, আমরা সেভাবেই কাজ করব।”
অবৈধ ইটভাটা নিয়ে কথা হয় লালমনিরহাট জেলা প্রশাসক এইচ এম রকিব হায়দারের সঙ্গে। তিনি বলেন, “অবৈধ সব ভাটা বুলডোজার দিয়ে ধ্বংস করা হয়েছে। তবে কেউ আবার চালু করলে, ব্যবস্থা নেব।”