“দশ দিনের ওপরে হয়, এলাকায় কারেন্ট নেই। কারও মোবাইলে চার্জ নেই। যে দোকানটিতে জেনারেটর দিয়ে মোবাইল চার্জ দেওয়া হচ্ছে, দোকান মালিক প্রতি মোবাইল চার্জ দিতে ৪০ টাকা করে রাখছেন।”
Published : 30 Aug 2024, 11:05 PM
“বায়াজি নাতি কিছু খাইতে ফারে না, কদ্দুরা দুধের লাই কতজনের কইলাম কেউ দিল না। পাগল কই বেকে তারাই দিল, আন্নে আরে দুধ লই দেন না, দোয়া করমু বায়াজি,” নাতনির জন্য দুধ চেয়ে না পেয়ে এভাবেই আক্ষেপ করছিলেন পঞ্চাশোর্ধ জাহানারা বেগম।
ফেনী সদর উপজেলার পাঁচগাছিয়া ইউনিয়নের বারোয়ানী গ্রামের জাহানারা বেগমের ঘরে বানের পানি ঢোকে দশদিন আগে। এরপর থেকে মানসিক প্রতিবন্ধী মেয়ে জামিলা আর চার বছরের এক নাতনিকে নিয়ে তার ঠাঁই হয়েছে এলাহীগঞ্জ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের আশ্রয়কেন্দ্রে।
স্মরণকালের ভায়াবহ বন্যা পড়া ফেনী বাসিদের মধ্যে যে আতঙ্ক আর উৎকণ্ঠা বিরাজ করছে তার আঁচ স্বাভাবিকভাবেই জাহানারার ওপরেও পড়েছে। একই তো ঘরবাড়ি ছাড়তে হয়েছে; তার উপর দিনের পর দিন না খেতে পেয়ে- দুর্দশা যেন ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করেছে।
জাহানারা বলছিলেন, তার স্বামী নেই। মেয়ে আর নাতনিকে নিয়ে অভাবের সংসার। ছোট যে ঘরটিতে তারা থাকতেন সেটা এখন পানির নিচে। বানের পানি যখন চলে আসে, তখন ঘর থেকে কিছুই বের করতে পারেননি। যেখানে আশ্রয় নিয়েছেন সেই স্কুলের আঙিনায়ও বুক সমান পানি। আশপাশের মানুষ আশ্রয়কেন্দ্রে যে খাবার দিয়ে যাচ্ছেন, তাই দিয়ে তাদের কোনোরকম জীবন কাটছে তাদের।
কথাগুলো বলার সময় আতঙ্কের স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল পঞ্চাশোর্ধ জাহানারা মুখে। বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম বলছিলেন, “এখন ত্রাণের গাড়ি দেখলেই ছুটে যাই। নাতিনের দুধের প্রয়োজন। কেউ দুধ দিচ্ছিল কি-না খোঁজ নিতে গিয়ে দেখি একটি চিকিৎসক প্রতিষ্ঠান ওষুধের সঙ্গে দুধ দিচ্ছিল। আমি অনেকবার চেষ্টা করেছি, আপনি সাংবাদিক আমাকে একটু দুধ নিয়ে দেন।”
পাঁচগাছিয়া ইউনিয়নের মত আশপাশের সদরের শর্শদি ইউনিয়ন এবং দাগনভূঞা উপজেলার সিন্দুরপুর ইউনিয়নের অর্ধশতাধিক গ্রামের মানুষ গত দশদিনের বেশি সময় ধরে পানিবন্দি হয়ে মানবেতর জীবন কাটাচ্ছেন।
সরেজমিনে দেখা গেছে-শর্শদি ইউনিয়নের দক্ষিণ আবুপুর, উত্তর আবুপুর, কুমিরা, নতুন বাড়ি, পিয়ার আলী মসজিদ, একই উপজেলার পাঁচগাছিয়া ইউনিয়নের জগরগাঁও, এলাহীগঞ্জ, ধলিয়া বারোয়ানি, উত্তর ডোমুরিয়া, দক্ষিণ ডোমুরিয়া এবং দাগনভূঞা উপজেলার সিন্দুরপুর ইউনিয়নের কৈখালী, ছোট কৈখালী এবং গৌতম খালিতে কোথাও হাঁটু সমান পানি তো কোথাও কোমর সমান পানি।
শর্শদি ইউনিয়নের এলাহীগঞ্জ বাজারে কথা হয় আব্দুল মতিনের সঙ্গে। শর্শদি, পাঁচগাছিয়া ও সিন্দুরপুর ইউনিয়নের সংযোগস্থল এই এলাহীগঞ্জ বাজার। আশপাশের সব গ্রাম পানিতে ডুবে থাকায় এলাহীগঞ্জ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও এলাহীগঞ্জ মমতাজ উদ্দিন উচ্চ বিদ্যালয় আশ্রয়কেন্দ্রে ১৫০ জন মানুষ ঠাঁই নিয়েছেন।
শুক্রবার দুপুরে এলাহীগঞ্জ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে গিয়ে দেখা গেছে, মাঠে জমে থাকা গলা সমান পানিতে ডুব দিয়ে গোসল সেরে নিচ্ছেন অনেকে। পরিষ্কার পানি না থাকায় বানের ময়লা পানিতেই গোসল সারতে হচ্ছে তাদের।
সেখানে আশ্রয় নেওয়া পাঁচগাছিয়া ইউনিয়নের ছোট ধরিয়া গ্রামের খামার পাড়ার অশীতিপর হারিস মিয়া জানালেন, দশদিন ধরে পানিবনি অবস্থায় রয়েছেন। উপায় না পেয়ে পাঁচ ছেলে, ছেলের বউ ও নাতি-নাতিদের নিয়ে পাশের একটি মার্কেটের ছাদে আশ্রয় নিয়েছেন। সেখাই ত্রিপল টানিয়ে রাত যাপন করছেন।
তিনি বলেন, “আমার ছেলে হুমায়ুন, পেয়ার আহমেদ আর সালেহ আহমেদের বেশ কয়েকটি মাছের খামার ও পোল্ট্রি খামার পানিতে ভেসে গেছে। তাদের ১৮ থেকে ২০ লাখ টাকার মত ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। এ বন্যার কারণে আমার পরিবার একেবারে নিঃস্ব হয়ে গেছে।”
সদরের পাঁচগাছিয়া ইউনিয়নের জগরগাঁও গ্রামের মুহুরি বাড়ির শাহাবুদ্দিন মিস্ত্রির মেয়ে লিপি আক্তার আক্ষেপ করে বলেন, “দশ দিনের বেশি সময় ধরে ঘরে হাঁটু পরিমাণ পানি। উঠানে গলা সমান পানি। চারিদিকে পানি থাকার কারণে বাবা কোনো কাজই করতে পারছে না। ছোট আরও পাঁচটা ছোট ছোট বোন। তাদের নিয়ে কিভাবে যে বেঁচে আছি…বলে বুঝাতে পারব না।”
এলাহীগঞ্জ মমতাজ উদ্দিন উচ্চ বিদ্যালযয়ের ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র আব্দুল কাদের জিলানী বলেন, “ঘরে এখনও হাঁটু সমান পানি। সব জিনিসপত্র ঘরেই রেখে আসতে হয়েছে।”
“পড়ার সকল বই ভিজে নষ্ট হয়ে গেছে।” পাশ থেকে বলে ওঠে কাদেরের ছোট ভাই মাদ্রাসা পড়ুয়া তৃতীয় শ্রেণীর ছাত্র আব্দুর রহমান সৈকত।
আশ্রয়কেন্দ্র থেকে বেরিয়ে কিছুদূর এগুতেই বাজারের একটি দোকানে দেখা গেল জেনারেটর দিয়ে বিশেষ ব্যবস্থায় মোবাইলে চার্জ দিচ্ছেন স্থানীয়রা। সেখানে কথা হয় আব্দুল্লাহ আলিফ নামে এক যুবকের সঙ্গে।
তিনি বলেন, “দশ দিনের ওপরে হয়, এলাকায় কারেন্ট নেই। কারও মোবাইলে চার্জ নেই। যে দোকানটিতে জেনারেটর দিয়ে মোবাইল চার্জ দেওয়া হচ্ছে, দোকান মালিক প্রতি মোবাইল চার্জ দিতে ৪০ টাকা করে রাখছেন।”
এলাহীগঞ্জ বাজারের একটি দোকানে বানভাসি মানুষকে বিনামূল্যে চিকিৎসা সেবা দিতে দেখা গেল ঢাকা থেকে আসা ‘বাংলাদেশ সচেতন নাগরিক সমাজ ফোরাম’- নামের একটি সংগঠন।
ওই সংগঠনের চিকিৎসক সাব্বির আহমেদ বলেন, তাদের দলে আটজন চিকিৎসক রয়েছেন। পানিবাহিত রোগ ও প্রাথমিক চিকিৎসার সকল ওষুধ বিনামূল্যে সবার মাঝে বিতরণ করা হচ্ছে। শুক্রবার সারারাতে তারা চার শতাধিক রোগীকে সেবা দিতে পেরেছেন।
দাগনভূঞা উপজেলার সিন্দুরপুর ইউনিয়নের গৌতমখালি গ্রামের বাসিন্দা হেলাল উদ্দিন এলাহীগঞ্জ বাজার দিয়ে হেঁটে ফেনীর দিকে যাচ্ছিলেন। কেমন আছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, “আজ দশ দিনেরও বেশি সময় হতে চলল, ঘরেতে পানি জমে আছে। শহরে এক আত্মীয়ের বাসায় আপাতত স্ত্রীকে রেখে আসতে যাচ্ছি।
“বাজারে অনেকক্ষণ ধরে দাঁড়িয়ে ছিলাম। কোনো গাড়ি না পেয়ে হাঁটু পানি ভেঙেই হেঁটে রওনা দিয়েছি। সামনে কোনো ট্রাক্টর অথবা ট্রলি পেলেই উঠে যাব।”
নদী থেকে গলিত লাশ উদ্ধার
শুক্রবার বিকালে ফেনী সদর উপজেলার লেমুয়া এলাকায় নদী থেকে এক ব্যক্তির অর্ধগলিত মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। ফেনী মডেল থানার এসআই ইমরান হোসেন এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
ফেনী জেলা ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক মোরশেদ আলম মিলন জানান, লেমুয়া ব্রিজের নিচে এক নারীর মরদেহ ভাসতে দেখে স্থানীয় এক নেতা তাকে ফোন করে জানান। পরে তিনি ‘আল মারকাজুল ইসলাম’- নামের একটি লাশ দাফনের সংগঠনকে খবর দিলে তারা পিকাআপ ভ্যান নিয়ে আসে। পরে লাশ উদ্ধার ময়নাতদন্তের জন্য ফেনী জেনারেল হাসপাতালের মর্গে পাঠায়।
মিলন বলেন, “মৃত নারীর বয়স সত্তোরর্ধ। চুলগুলো সাদা। পরনে লাল রঙরের ম্যক্সি ছিলো।”
এসআই ইমরান বলেন, ময়নাতদন্তের জন্য মরদেহটি ফেনী জেনারেল হাসপাতালের মর্গে রাখা হয়েছে।
বাড়ছে মৃত্যু
ফেনীতে স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যায় প্রতিদিনই যোগ হচ্ছে মৃতের সংখ্যা। শুক্রবার বিকালে জেলা প্রশাসন থেকে পাঠানো এক বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে, জেলায় বন্যায় এ পর্যন্ত ২৩ জনের মৃত্যু হয়েছে।
জেলা প্রশাসক মোসাম্মৎ শাহীনা আক্তার জেলা পুলিশের গোয়েন্দা শাখার (ডিএসবি) বরাতে বলেন, শুক্রবার বিকাল পর্যন্ত বন্যায় সদর উপজেলায় তিনজন, পরশুরাম উপজেলায় দুইজন, ফুলগাজী উপজেলায় সাতজন, ছাগলনাইয়ায় তিনজন, দাগনভূঞা উপজেলায় দুইজন ও সোনাগাজী উপজেলায় ছয়জনের মৃত্যু হয়েছে।