থোকা থোকা লাল বিন, মৌলভীবাজারে কফির স্বপ্ন

একটি কফি গাছ তিন বছর থেকে ফল দেওয়া শুরু করলেও ৫/৬ বছর হলে ফলের পরিমাণ অনেক বেশি হয়।

বিকুল চক্রবর্তী, মৌলভীবাজার প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 24 Nov 2022, 06:06 AM
Updated : 24 Nov 2022, 06:06 AM

এক সময় মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলের জাগছড়াসহ বিভিন্ন চা বাগানে ব্রিটিশরা কফি চাষ করতেন। তারা চলে যাওয়ার পর কফির চাষ আস্তে আস্তে কমে যায়। কিন্তু বর্তমান বিশ্বের অন্যতম রপ্তানি পণ্যের তালিকায় রয়েছে কফি।

তাই কফি পুনরায় মৌলভীবাজারে চাষাবাদের জন্য কৃষি বিভাগের উদ্যোগে বিভিন্ন উপজেলায় চারা বিতরণ করা হচ্ছে। এরই মধ্যে জেলার পাহাড়ি ও সমতল ভূমিতে কফির দুটি জাত- `অ্যারাবিকা’ ও `রোবাস্তা’ পরীক্ষা মূলক চাষে ভালো ফলন হয়েছে। ফলে চায়ের পাশাপাশি এ অঞ্চলে কফি চাষের উজ্জ্বল সম্ভাবনা দেখছেন কৃষি গবেষকরা।

মৌলভীবাজার কৃষি অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মো. সামছুদ্দিন আহমদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, মৌলভীবাজার জেলার সদর উপজেলা, রাজনগর, কুলাউড়া ও শ্রীমঙ্গলে বিভিন্ন পাহাড়ি ও সমতলে পরীক্ষামূলকভাবে প্রায় তিন হাজার কফির চারা রোপন করা হয়। কিন্তু সরকারিভাবে কোন প্রকল্প না থাকায় এটির ব্যপকহারে বিস্তার সম্ভব হয়নি।

তিনি বলেন, “মৌলভীবাজারে কফির দুটি জাতেরই ফলন ভালো হয়েছে। এর মধ্যে রোবাস্তা সমতলে ভালো হয়েছে; আর পাহাড়ে হয়েছে অ্যারাবিকা। একটি কফি গাছ তিন বছর থেকে ফল দেওয়া শুরু করলেও ৫/৬ বছর হলে ফলের পরিমাণ অনেক বেশি হয়।”

সরকারি প্রণোদনাসহ প্রকল্প আকারে কফির চাষ করলে এ অঞ্চলের মানুষ অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ হবে; পাশাপাশি রপ্তানি করে সরকারও বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করতে পারবে বলে জানান এ কৃষি অধিদপ্তরের এ কর্মকর্তা।

মৌলভীবাজারে অনেকে সখের বসেও কফির চারা রোপন করছেন। কফির ফলগুলো দেখতে অনেকটা চেরি ফলের মত হয়।

রাজনগর উপজেলার টেংরা বাজার ইউনিয়নে মাথিউড়া এলাকা ঘুরে দেখা গেছে- রাস্তা ও বাড়ির পাশে কফি গাছে থোকা থোকা কফি ধরে আছে। কিছু গাছে কফি সবুজ, কিছু গাছে সাদাভাব নিচ্ছে আবার বেশ কিছু গাছে পেঁকে লাল হয়ে গেছে।

কফির স্বাদ ও ঘ্রাণ গ্রাহকের কাপ পর্যন্ত রাখতে হলে সঠিকভাবে কফি গ্রাইন্ডিং করা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কফি বীজ গুড়া করা যত মিহি হবে তত দ্রুত সুন্দর কফি তৈরি হবে। কিন্তু স্থানীয়রা এ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে পারেন না; তারা পাকা কফি গাছ থেকে পেড়ে রোদে শুকিয়ে ও ভেজে গুড়া করে তারপর পান করেন।

মাথিউড়া বাগানের বাসিন্দা সৈয়দা মনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, তিনি লালচে হয়ে যাওয়া কফির বীজগুলো গাছ থেকে সংগ্রহ করে প্রথমে পরিষ্কার পানি দিয়ে ভালো করে ধুঁয়ে দেন। তারপর লম্বা সময় পানিতে ভিজিয়ে রাখেন। একটু নরম হওয়ার পর এর উপরের চামড়া ছাড়িয়ে নেন। পরে রোদে শুকাতে দেন।

ভালো করে শুকানোর পর আরেক দফা এর শক্ত খোলস ছাড়িয়ে চুলায় ভেজে নেন। ভাজার সময় এটি হালকা কালচে রঙ হলে ব্লান্ডারে দিয়ে গুড়া করে গরম পানিতে চিনি মিশিয়ে পান করেন।

শ্রীমঙ্গলের পরিবেশবীদ ৭৫ বছর বয়সী সিতেশ রঞ্জন দেব বলেন, এ উপজেলার জাগছড়া ও সোনাছড়া চা বাগানে ফিনলে কোম্পানির বিশাল কফি বাগান আর কফির ফ্যাক্টরি ছিলো। চা উৎপাদন বেড়ে যাওয়ায় কফি চাষ কমে যায়। ১৯৮৫/৮৬ সালের দিকে ফিনলে কফি চাষ বন্ধ করে সেখানে চা আবাদ বর্ধিত করে।

ফিনলে টি- এর শ্রীমঙ্গলের ভাড়াউড়া ডিভিশনের ম্যানেজার গোলাম মোহাম্মদ শিবলী বলেন, সোনাছড়া ও জাগছড়ায় তাদের বিশাল কফি বাগান ছিল। লাভ কম হওয়ায় প্রায় ৩৭/৩৮ বছর আগে কোম্পানি কফি চাষ বন্ধ করে দেয়।

রাজনগরে বিভিন্ন চা বাগান ও গ্রামীণ এলাকায় বেশ কিছু কফি গাছের চারা লাগানো হয়েছে; যার মধ্যে রোবাস্তা জাতের কফিই বেশি বলে উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা রেজাউল করিম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান।

তিনি বলেন, “বেশ কিছু কফি গাছের বয়স তিনবছর অতিক্রম করেছে এবং এই গাছগুলোতে ফলনও ভালো হয়েছে।”

চায়ের পাশাপাশি এ জেলায় কফি চাষের একটা উজ্জ্বল সম্ভাবনা রয়েছে বলে মনে করেন মৌলভীবাজার কৃষি অধিদপ্তরের সাবেক উপ-পরিচালক ও কৃষি গবেষক লুৎফুল বারী।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “কফি একটি উচ্চ মূল্যের ফল। চায়ের সঙ্গেও এটি চাষ করা যেতে পারে। পাশাপাশি ক্ষুদ্র চাষিরা তাদের বাড়িতেও চাষ করতে পারেন। তবে এর জন্য জেলায় একটি প্রসেসিং সেন্টার প্রয়োজন হবে।”

তিনি জানান, কফি হৃদরোগ ও পাকস্থলির জন্য ও বেশ উপকারী।