গোলাগুলির মধ্যে পাড়াছাড়া রুমার ৭০টি মারমা ও বম পরিবার

এই অবস্থার মধ্যেই কেএনএফের এক সদস্যের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে বলে পুলিশ জানিয়েছে।

উসিথোয়াই মারমাবান্দরবান প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 29 Jan 2023, 03:04 PM
Updated : 29 Jan 2023, 03:04 PM

সশস্ত্র সংগঠন কুকি চিন ন্যাশনাল ফ্রন্টের বিরুদ্ধে অভিযানের মধ্যে বান্দরবানের রুমা উপজেলার কয়েকটি পাড়া থেকে মারমা ও বম জাতিগোষ্ঠীর লোকজন গহীন পাহাড়ের বাড়ি ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে শহরে এসেছেন। 

রোববার বিকাল পর্যন্ত দফায় দফায় উপজেলার পাইন্দু ইউনিয়নের অন্তত ৫১টি মারমা ও ২০টি বম পরিবার রুমা বাজারের মারমা ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনের হল রুমে এবং বম কমিউনিটি সেন্টারে এসে আশ্রয় নিয়েছে।

মারমা জাতিগোষ্ঠীর নেতা, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও উপজেলা প্রশাসন জানিয়েছে, এর মধ্যে শনিবার এসেছে ৪০টি মারমা পরিবার। আর রোববার আরও ১১টি মারমা এবং ২০টি বম পরিবার পাড়া ছেড়েছে। ভয়ের মধ্যে আর কিছু পরিবার জঙ্গলে পালিয়ে থাকতে পারে বলেও আশঙ্কা করা হচ্ছে। 

রুমা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মামুন শিবলী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “গত দুদিন ধরে রুমা পাইন্দু ইউনিয়নের পার্শ্ববর্তী এলাকায় পাহাড়ে কেএনএফের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অভিযান চালায়। অভিযানের কারণে কেএনএফ সদস্যরা হ্যাপিহিল, বাসত্লাং, মুনওয়াম, মুয়ালপি, সানাক্র, ক্যকতাইং পাড়ায় এসে আশ্রয় নেয়।“ 

“পাড়ার ভিতর থেকেই তারা সেনাবাহিনীদের লক্ষ্য করে গুলি ছুড়ে। সাধারণ নিরীহ গ্রামবাসীরা নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে পাশের বন ও ঝিঁরিতে পালিয়ে বাঁচার চেষ্টা করেন।”

ইউএনও আরও বলেন, “দুদিন বনে লুকিয়ে থাকার পর নিরাপদ মনে না হলে গ্রামবাসী শিশু-বৃদ্ধ সবাই শনিবার সন্ধ্যায় রুমা বাজারে পালিয়ে আশ্রয় নিয়েছে খরব পাই। স্থানীয় জনপ্রতিনিধির সঙ্গে আলোচনা করে পরিবারগুলোকে রুমা বাজারের মারমা ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনের হল রুমে রাখা হয়েছে। তাৎক্ষণিকভাবে তাদেরকে খাবার, কম্বল ও বিছানা-চাদরের ব্যবস্থা করা হয়েছে।” 

রোববার বিকালে পাইন্দু ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান উহ্লামং মারমা বলেন, “আমার ইউনিয়নের হ্যাপিহিল, বাসত্লাং, আর্থা, মুননুয়াম ও মুয়ালপি পাড়া এখন জনমানবশূন্য। রোববার বিকাল ৩টার দিকে হ্যাপিহিল ও বাসত্লাং পাড়ার ২০টি পরিবারের ৪০ জনের মত নারী ও শিশু রুমা উপজেলা সদরে চলে এসেছে। তারা বম কমিউনিটি সেন্টারে আশ্রয় নিয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, ভয়ে এখনও কেউ কেউ বন-জঙ্গলে লুকিয়ে থাকতে পারে।” 

এই অবস্থার মধ্যেই সেনাবাহিনীর সঙ্গে গোলাগুলিতে কুকি চিন ন্যাশনাল ফ্রন্টের (কেএনএফ), পাহাড়ে যারা বম পার্টি হিসেবে পরিচিত; তাদের এক সদস্যের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে বলে রোববার পুলিশ জানিয়েছে।

পুলিশের ভাষ্য, শনিবার দুপুরে সেনাবাহিনীর একটি দল পাইন্দু ইউনিয়নের মুননুয়াম পাড়ার ক্যাম্পে যাওয়ার সময় কেএনএফ সদস্যরা তাদের ওপর হামলা চালায়। পরে সেনবাহিনীর সদস্যরা পাল্টা গুলি করলে কেএনএফের এক সদস্য নিহত হয়। 

রোববার সকালে পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে কেএনএফের ওই সদস্যের লাশ উদ্ধার করে। তবে নিহত ব্যক্তির নাম-পরিচয় জানাতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। 

আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তরের (আইএসপিআর) কাছ থেকে এ পরিস্থিতি নিয়ে কোনো সংবাদ বিজ্ঞপ্তি না এলেও নিরাপত্তা বাহিনীর বান্দরবান রিজিয়ন ও ৬৯ পদাতিক ব্রিগেড থেকে পাঠানো একটি সংবাদ বিজ্ঞপ্তি স্থানীয় সংবাদকর্মীদের কাছে এসেছে।

সাদা কাগজে নাম ও স্বাক্ষরবিহীন ওই বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, কেএনএফের অত্যাচার ও নির্যাতনে পাড়াগুলো থেকে বম ও মারমা বাসিন্দারা বাসস্থান ত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছেন। তারা রুমা উপজেলা সদরের মারমা ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনের ভবনে অবস্থান করছেন। আশ্রিত পরিবারগুলোকে সেনাবাহিনী খাবার, শীতবস্ত্র, চিকিৎসাসেবা ও প্রয়োজনীয় ওষুধপত্র প্রদান করছে।

পাড়া থেকে পালিয়ে আসা মংপ্রুচিং মারমা রোববার দুপরে মোবাইল ফোনে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “পাড়ার পার্শ্ববর্তী এলাকায় কয়েক দিন ধরে গোলাগুলি চলে। ভয়ে পালিয়ে এসেছি। পাড়া থেকে নারী-পুরুষ, শিশু ও বয়োবৃদ্ধ মিলে টানা তিন ঘণ্টা হেঁটে গতকাল সন্ধ্যায় উপজেলা সদর পৌঁছেছি। ঘরের জিনিসপত্র ও গবাদিপশু ফেলে আসতে হয়েছে।” 

“কিছু পরিবারের সদস্য হাঁটতে না পেরে রাস্তায় এবং জঙ্গলে থেকে গিয়েছিল। তারা রোববার সকালে এসে পৌঁছেছে।“ 

হ্লাথোয়াইচিং মারমার পরিবারও পালিয়ে এসেছে। তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এক সপ্তাহ আগে কেএনএফ সদস্যরা আমাদের পাড়ার এক যুবককে ধরে নিয়ে নির্যাতন করে। এটা নিয়ে সবাই ভয়ে ছিলাম। এরপরে আর কাউকে বিরক্ত করেনি। তার মধ্যে গতকাল গোলাগুলির ঘটনা ঘটে। ভবিষ্যতে খারাপ কিছু হওয়ার ভয়ে নিরাপদ আশ্রয়ে সবাই পালিয়ে এসেছি।“ 

“সবাই যে যার মত পালাচ্ছে। আমাদের মুয়ালপি পাড়ায় বম সম্প্রদায়ের আরও ৭০টি পরিবার ছিল। তারাও গতকাল চলে গেছে। তবে তারা কোথায় গেছে আমরা জানি না।”

পাইন্দু ইউপি চেয়ারম্যান উহ্লামং মারমা বলেন, “পাড়াগুলোতে কেএনএফের সদস্যরা দীর্ঘদিন ধরে অবস্থান করছে এমন অভিযোগ পাড়াবাসীর ছিল। তারা প্রায় সময় অভিযোগ করত, কেএনএফ সদস্যরা পাড়ায় এসে উৎপাত, হয়রানি করছে।” 

“শুক্রবার থেকে তাদের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু হয়। অভিযানের এক পর্যায়ে গোলাগুলির ঘটনা ঘটে। শনিবারও গোলাগুলি হয়েছে বলে অনেকে বলেছেন। স্থানীয় প্রশাসন ও পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীকে বিষয়টি জানানো হয়েছে।” 

মারমা ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক এবং রুমা কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ সুইপ্রুচিং মারমা রোববার দুপরে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ওই এলাকায় বিরূপ পরিস্থিতির কারণে ভয়ে শনিবার সন্ধ্যায় ৪০টি পরিবার পালিয়ে এসেছে। আজ সকালে আরও ১১ পরিবার পালিয়ে এসেছে। পালিয়ে আসা লোকজনের গায়ের কাপড় ছাড়া আর কিছুই ছিল না। অনেক শিশু শীতে কাঁপছিল।” 

স্থানীয় প্রশাসন এবং জনপ্রতিনিধির সঙ্গে পরামর্শ করে মারমা ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়নের হল রুমে থাকার ব্যবস্থা করে করে দেওয়া হয়েছে। সবার জন্য খাবার, কম্বল, বিছানা-চাদরের ব্যবস্থা করা হয়েছে বলে জানান সুইপ্রুচিং মারমা। 

কুকি চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট বা কেএনএফ নামে পাহাড়ের একটি সশস্ত্র দলের তৎপরতার খবর বেশ কয়েক মাস ধরেই আলোচনায় আসছিল। পাহাড়িরা কেএনএফ সংগঠনটিকে ‘বম পার্টি’ নামে চেনে। নিজেদের তারা পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রান্তিক অঞ্চলের অনগ্রসর জনজাতিগুলোর ‘প্রতিনিধিত্বকারী’ হিসেবে তুলে ধরে।

এ সংগঠন ‘কুকি-চিন রাজ্যে’ নামে একটি স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল চায়; যেখানে চাকমা, মারমা ও ত্রিপুরারা থাকবে না; থাকবে বম, খিয়াং, পাংখুয়া, লুসাই, খুমি ও ম্রোরা।

পার্বত্য চট্টগ্রামের বান্দরবান জেলায় কুকিচিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ) নামে একটি সশস্ত্র সংগঠন অর্থের বিনিময়ে নতুন জঙ্গি সংগঠন ‘জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া’র সদস্যদের সামরিক প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় বলে অক্টোবরে সংবাদ সম্মেলন করে জানায় র‌্যাব।

জঙ্গিদের পাহাড় যোগের এ তথ্য পাওয়ার ওই সময় থেকে জঙ্গি ও কেএনএফ সদস্যদের বিরুদ্ধে রোয়াংছড়ি ও রুমা উপজেলায় যৌথ অভিযান চালাচ্ছে র‌্যাব ও সেনা সদস্যরা। পরে এ অভিযান চালানো হয় থানচি উপজেলাতেও।

যৌথ বাহিনীর এ অভিযানে এ পর্যন্ত নতুন জঙ্গি সংগঠন ‘জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া’র ১২ জন সদস্য এবং কেএনএফের পাহাড়ে যারা ‘বম পার্টি’ নামে পরিচিত তাদের ১৩ সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। 

আরও পড়ুন:

রুমায় গোলাগুলিতে ‘কেএনএফ সদস্য’ নিহত

‘বম পার্টি’র প্রধান নাথানকে আসামি করে ‘জঙ্গি’ আল-আমিনের বাবার মামলা

বান্দরবানের গহীনে ‘জঙ্গির কবরে’ লাশ মেলেনি, নানা প্রশ্ন

প্রমাণ লুকাতে লাশ গায়েব, সন্দেহ ‘জঙ্গি’ আল-আমিনের বাবার

বান্দরবানে ‘জঙ্গিদের মধ্যে দ্বন্দ্ব’; একজন খুন, কবরের সন্ধান

পাহাড়ে সশস্ত্র দল; এই ‘বম পার্টি’ কারা?

‘বম পার্টি’র আস্তানায় প্রশিক্ষণে যাওয়া আরও ৫ জঙ্গি পাহাড়ে গ্রেপ্তার

বম পার্টির সঙ্গে নতুন জঙ্গি দলের ‘মাসিক চুক্তির’ খবর দিল র‌্যাব

৭ জঙ্গির সঙ্গে এবার ৩ পাহাড়িও গ্রেপ্তার: র‌্যাব

নতুন জঙ্গি দলের ‘পাহাড়ি যোগ’ পেয়েছে র‌্যাব

জঙ্গি আর পাহাড়ি দলের মিলে যাওয়ার বিপদ যেখানে

র‌্যাবের জালে নতুন জঙ্গি দল, কারা এরা?

নিখোঁজ ৪ তরুণসহ সাতজনকে গ্রেপ্তারের পর র‌্যাব জানাল নতুন জঙ্গি দলের নাম