বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ির তিন পাহাড়ের মাঝখানে তৈরি স্কুলটির নাম দেওয়া হয়েছে ‘রেংয়পাড়া আশা-হফনং বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়’।
Published : 24 Jul 2023, 01:38 AM
গল্পটা এমন- বান্দরবানের গহীন পাহাড়ের এক ম্রো মা তার ছেলেকে লেখাপড়া শেখাতে পাঠিয়েছিলেন দূরের এক মফস্বল শহরে। কিন্তু কয়েকবছর পরে সেই ছেলে আর মায়ের কাছে ফিরে তো আসেনি; বরং পরিচয় পাল্টে তাকে ‘ম্রো’ থেকে ‘বড়ুয়া’ করা হয়েছে।
থানা-পুলিশ করেও ছেলেকে ফেরত পাননি সংথক ম্রো। তার আফসোস, যদি বাড়ির কাছে একটা স্কুল থাকত, তাহলে হয়তো নিজের ছেলেকে তিনি কোলছাড়া করতেন না; আর ছেলেও মাকে, মায়ের গোষ্ঠী-পাড়া-ভাষাকে ভুলতে পারত না।
সংথক ম্রোয়ের এই ‘ছেলে হারানোর’ বেদনা তার পাড়াবাসী, সম্প্রদায় আর কয়েকজন স্বেচ্ছাসেবীকে গভীরভাবে স্পর্শ করে। সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নেন, সংথক ম্রোয়ের মতো আর কারও সন্তান যেন পড়াশোনা করতে গিয়ে ‘হারিয়ে’ না যায়- সেজন্য একটা স্কুল গড়ে তুলবেন।
সেই ভাবনা থেকেই নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার দোছড়ি ইউনিয়নের দুর্গম এলাকায় ম্রো শিশুদের জন্য স্থাপিত হয়েছে একটি স্কুল। একজন জার্মান প্রবাসী ও ২০ জন স্বেচ্ছাসেবী মিলে তিন পাহাড়ের মাঝখানে তৈরি স্কুলটির নাম দেওয়া হয়েছে ‘রেংয়পাড়া আশা-হফনুং বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়’। জার্মান শব্দ ‘হফনুং’ এর বাংলা অর্থ ‘আশা’।
সম্প্রতি পাড়াবাসী বেশ উৎসাহ-উদ্দীপনা নিয়ে স্কুলটির উদ্বোধন করেছেন। নানা রঙের কাগজ দিয়ে স্কুল ও অঙ্গনকে সাজানো হয়। স্কুলের প্রবেশ পথে তৈরি করা হয় কাগজের গেইট। জুমচাষি সংথক ম্রো সকালে ঘণ্টা বাজিয়ে সেই স্কুলের উদ্বোধন করেন।
অনুষ্ঠানে সংথক ম্রো তার মাতৃভাষাতেই বলেন, “শুধু লেখাপড়া করানোর জন্য পাঁচ বছর বয়সি সন্তানকে কক্সবাজারে উখিয়ায় পাঠিয়ে ছিলাম। কিন্তু শেষ পর্যন্ত নিজের সন্তানকে হারিয়েছি। আর যাতে কেউ আমার মত নিজের সন্তানকে এভাবে না হারায় তার জন্য আমাদের এই পাড়ায় স্কুল করা হয়েছে। আমাদের আরও শিশুদের কথা ভেবে যারা স্কুল করে দিয়েছে তাদের প্রতি সবসময় কৃতজ্ঞতা থাকবে।”
সংথক ম্রো দোছড়ি ইউনিয়নের ২ নম্বর ওয়ার্ডের রেংয় ম্রো পাড়ায় পাঁচ ছেলেমেয়েকে নিয়ে বসবাস করেন। তার বাড়ির কাছেই স্কুলটির অবস্থান। নাইক্ষ্যংছড়ি ও আলীকদম দুই উপজেলার মাঝামাঝি এই পাড়ায় ৩৪টি ম্রো পরিবার বসবাস করে। উভয় দিক থেকে খুবই দুর্গম এলাকা।
রেংয় ম্রো পাড়া থেকে হেঁটে নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলা সদরে পৌঁছাতে সময় লাগে চার-পাঁচ ঘণ্টা। আর আলীকদম উপজেলা সদরে পৌঁছাতে সময় লাগে তিন থেকে চার ঘণ্টার মত। পাড়াবাসী আলীকদম উপজেলা সদরে এসেই বেশিরভাগ সময় বাজার করে থাকেন।
রেংয় পাড়ার আশপাশে আরও চারটি পাড়া আছে। কিন্তু কোথাও কোনো সরকারি-বেসরকারি; এমনকি ‘পাড়াকেন্দ্র স্কুল’ও (ইউনিসেফের পরিচালনায় পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড পরিচালিত স্কুল) নেই। ফলে এসব পাড়ার শিশুদের পড়তে হলে অনেকটা দূরের পাহাড়ি পথ পাড়ি দিতে হয়। আর এসব কারণেই যুগ যুগ ধরে শিশুদের স্কুলে পাঠানোর চেয়ে পরিবার জুম চাষে নিয়ে যেতেই বেশি আগ্রহী।
স্কুলের জন্য রেংয় ম্রো পাড়ার কারবারি (পাড়াপ্রধান) পাঁচ একর জমি দান করেছেন। বাঁশ, কাঠ ও টিন দিয়ে তৈরি স্কুলটি মোট চারটি কক্ষ। তিনটি কক্ষে শিক্ষার্থীদের পড়ানো হয়। শিক্ষকরা বসেন একটি কক্ষে। প্রাথমিকভাবে চারটি পাড়ার ৪৫ জন শিশু স্কুলটিতে প্রাথমিক ও প্রথম শ্রেণির শিক্ষা নেবে।
স্কুলটি পরিচালনার জন্য ১১ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। সেই কমিটি এরই মধ্যে দুজন শিক্ষককে মাসিক ১২ হাজার টাকা বেতনে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দিয়েছেন; যাদের একজন চাকমা এবং অপরজন ম্রো সম্প্রদায়ের।
স্কুলের উদ্বোধনী দিনে প্রত্যেক শিক্ষার্থীদের শ্রেণিভিত্তিক বই ও শিক্ষার উপকরণ বিনামূল্যে দেওয়া হয়। এর আগে প্রত্যেকে শিক্ষাথীদের দেওয়া হয় স্কুলের পোশাকও। সেই পোশাক পরিয়েই সন্তানদের হাত ধরে স্কুলে নিয়ে এসেছেন পাহাড়ি বাবা-মায়েরা।
রেংয় ম্রো পাড়ার কারবারি (পাড়াপ্রধান) ক্রাতলাই ম্রো বলেন, “এত দুর্গম এলাকার আমাদের পাড়ায় হঠাৎ করে স্কুল হবে কল্পনাও করিনি। সাংবাদিক হোসেন সোহেল দায়িত্ব নিয়ে যেভাবে অর্থ সংগ্রহ করে স্কুল তৈরি করে দিয়েছে আমরা সারাজীবন মনে রাখব। এভাবে সহযোগিতা না করলে এই এলাকায় কোনোদিন স্কুল হত না।
আশপাশের পাড়াবাসীদেরও এই স্কুলের কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত করে আগামী দিনগুলোতে সুন্দরভাবে পরিচালনা করা হবে বলে আশা প্রকাশ করেন ক্রাতলাই ম্রো।
পাহাড়ে ভ্রমণে গিয়েই সংথক ম্রোর ‘ছেলে হারানোর’ বিষয়টি জানেত পারেন বলে জানান পরিবেশকর্মী ও সাংবাদিক হোসেন সোহেলসহ কয়েকজন।
হোসেন সোহেল বলেন, “পাঁচ বছর বয়সে যে ম্রো শিশুকে লেখাপড়া করানোর জন্য পাঠানো হয়েছিল সেই সন্তানকে আর ফেরত আনা যায়নি। শিশুটির বাবা-মার নাম পরিবর্তন হয়েছে। নিজের নাম পরিবর্তন হয়েছে; এমনকি নিজের ভাষাটা পর্যন্ত পরিবর্তন হয়েছে। এখন সন্তান হারানো এই মা শূন্যবুক নিয়ে বসে আছেন, হাহাকার করছেন।
“সেই মায়ের জন্য দেশে এবং দেশের বাইরে কিছু শুভাকাঙ্ক্ষীদের থেকে সহযোগিতা নিয়ে স্কুলটা প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। যে মা সন্তানকে স্কুলে পাঠিয়ে সন্তানকে হারিয়েছে সেই মা আজকের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে মন ভরে ঘণ্টা বাজিয়েছেন। শিশুদের স্কুলে আসতে বলেছেন…
দুর্গম পাহাড়ে স্কুল খুব জরুরি হয়ে পড়েছে উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, “এত দুর্গম পাহাড়ে এই প্রথমবার স্কুলের ঘণ্টা বেজেছে, জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হয়েছে। ম্রো সম্প্রদায়ের শিক্ষার্থীরা তাদের পক্ষে যতটুকু সম্ভব ‘আমার সোনার বাংলা’ জাতীয় সংগীত গেয়েছে। এটা খুব গর্বের ব্য্যপার।”
পাড়াবাসীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সংথক ম্রোর ছয় ছেলেমেয়ে। তার স্বামী পুংক্লাইং ম্রো প্রায় দুই বছর আগে মারা গেছেন। বড় ছেলেকে নিয়ে পুংক্লাইং ম্রো এক রাতে পাহাড়ের ঝিঁরিতে কাঁকড়া, মাছ ধরতে যান। তখন দুর্ঘটনাবশত ছেলে গভীর খাদে পড়ে যায়। ছেলেকে বাঁচাতে গিয়ে বাবাও গভীর খাদের ঝাপ দেন। ছেলে বাঁচলেও মাখায় পাথরের প্রচণ্ড আঘাতে মারা যান পুংক্লাইং ম্রো।
স্বামী হারানোর শোক বুকে নিয়েই সংথক ম্রো জুম চাষ আর অন্যান্য কাজ করে পরিবার চালাচ্ছেন। ছয়-সাত বছর আগে দ্বিতীয় ছেলেকে তিনি পড়াশোনার জন্য গ্রামের বাইরে পাঠানোর ব্যাপারে মনস্থির করেন। তখন পাড়ারই ম্রো সম্প্রদায়ের এক ব্যক্তি তাকে কক্সবাজারের উখিয়া উপজেলায় এক বড়ুয়া পরিবারের কাছে নিয়ে যায়।
সংথকের ছেলে সেই পরিবারে থেকে লেখাপড়া করে। কিন্তু সেই পরিবার ছেলেকে কখনও বাড়ি আসতে দিত না। সংথক ও তার স্বামী পুংক্লাইং ম্রো ছেলের কথা জানতে চাইলে বলত, ছেলে ভাল আছে। এভাবে বেশ কয়েক বছর ছেলের দেখা পায়নি সংথক-পুংক্লাইং।
এর মধ্যে পুংক্লাইং ম্রো মারা যান। ম্রোদের ধর্মীয় অনুশাসন অনুযায়ী, বাবার শেষকৃত্যে ছেলের উপস্থিত থাকা বাধ্যতামূলক। তখন রেংয় পাড়ার মুরুব্বিরা ছেলেকে আনার জন্য উখিয়ায় যান। কিন্তু সেই বড়ুয়া পরিবার ছেলেকে আসতে দেয়নি। এক ছেলেকে ছাড়াই পুংক্লাইং ম্রোর শেষকৃত্য সম্পন্ন হয়ে। এই ঘটনা সংথক ম্রো ও তার পাড়াবাসীকে খুব কষ্ট দেয়।
এর মধ্যে গতবছর রেংয় ম্রো পাড়া ভ্রমণে যায় সাংবাদিক ও স্বেচ্ছাসেবীদের কয়েকজন। তারা গিয়ে সংথক ম্রোর কষ্টের কথা জানতে পারেন। সংথক ম্রো ছেলেকে ফিরে পেতে তাদের সহযোগিতা কামনা করেন। পরে তারা সংথক ম্রোকে নিয়ে কক্সবাজারের উখিয়ায় গিয়ে সেই ছেলেকে খুঁজে বের করেন। যদিও ছেলের নাম, বাবা-মায়ের নাম সব পরিবর্তন করে ফেলে সেই বড়ুয়া পরিবার। ছেলেও চিনতে পারেনি মাকে।
ছেলেকে ফিরিয়ে আনতে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, থানা-পুলিশও করেন সংথক ম্রো। কিন্তু ছেলে আর মায়ের কাছে ফিরতে চায়নি। ছেলে ‘হারানোর’ কষ্ট বুকে নিয়ে নিজের রেংয় পাড়ায় ফিরে আসেন সংথক ম্রো।
স্কুল তৈরির উদ্যোক্তাদের একজন সাংবাদিক মংসিহাই মারমা বলেন, “এই পাড়ার শিশুরা শিক্ষা থেকে বরাবরই বঞ্চিত ছিল। ছোট থাকতে সন্তানকে বাইরে রেখে লেখাপড়া করাতে গিয়ে একজন মা তার নিজের সন্তানকে হারাতে হয়েছে। কারও জীবনে যাতে এ ধরনের ঘটনা না আর ঘটে তার জন্য সবার সহযোগিতায় পাড়ায় এই স্কুল প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে।”
পাড়ার বাসিন্দা ও অভিভাবক মেন্নি ম্রো বলেন, “এই স্কুলটা না হলে আমাদের পাড়ার শিশুরা সারাজীবন নিরক্ষর হয়ে থাকত। সকাল হলেই আমাদের শিশুরা কাঁধে ব্যাগ নিয়ে স্কুলে যায়। এটা দেখে খুশিতে মন ভরে যায়।”
অভিভাবক পাইয়ং ম্রো বলেন, “সকাল হলে আমরা চলে যাই জুমচাষের কাজে। স্কুলটা না থাকলে শিশুদের আমরা হয়ত জুমচাষের কাজে লাগাতাম। তবে স্কুলটা ভবিষ্যতে সরকারীকরণ করা হলে আমাদের শিশুদের পড়াশুনায় আরও সুযোগ-সুবিধা বাড়বে।”
পরিচালনা কমিটি ও উদ্যোক্তারা মিলে স্কুলের সময়সূচি ঠিক করেছেন। সকাল সাড়ে ৮টায় শুরু হয় অ্যাসেম্বলি। সকাল ৯টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত একটানা ক্লাস নেওয়া হয়। তারপর দুপুর ১২টা থেকে ১টা পর্যন্ত মধ্যাহ্ন বিরতি। এরপর চলে গল্প বলা ও চিত্রাংক ক্লাস।
স্কুলের শিক্ষক ওয়াইডিং ম্রো শনিবার রাতে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “দুপুর ১টা থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত ক্লাসে মূলত বিভিন্ন ছবি আঁকাআঁকি করানো হয়। এই সময় শিশুরা ঘরে থাকলে অভিভাবকরা এমনিতে বিভিন্ন গৃহস্থালি কাজে তাদের ব্যবহার করত। যার কারণে শিশুদের গল্প শুনিয়ে এবং বিভিন্ন ছবি আঁকাআঁকি করে স্কুলে ব্যস্ত রাখা হচ্ছে।
“তবে স্কুলে পানির সমস্যা রয়েছে। একটা পাহাড়ের ঝিরি থেকে পাইপ লাগিয়ে পানির ব্যবস্থা করা হয়েছে। কিন্তু স্কুল পর্যন্ত পানি আসে না। স্কুল থেকে কিছুক্ষণ হেঁটে বোতলে ভরে নিয়ে আসতে হয়।”
এই শিক্ষক আরও বলেন, স্কুলে বাংলা পাঠ্যক্রম অনুযায়ী পাঠ দেওয়া হয়। এখানকার শিশুরা কেউ ঠিকমত বাংলা জানে না, বলতে পারে না। শুরুতে ম্রো ভাষায় তাদের বাংলা শেখানো হচ্ছে।
লামা উপজেলার চেয়ারম্যানপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক উথোয়াই মারমা বলেন, “স্কুল যেহেতেু হয়েছে এখন থেকে রেংয় পাড়ার শিশুদের ঠিক সময়ে স্কুলে পাঠাতে হবে। জুমক্ষেতে ও বাজারে শিশুদের সঙ্গে করে নিয়ে যাওয়া যাবে না।”