স্থানীয় ব্যবসায়ী আলম মিয়া বলেন, “সরকারের জায়গা নেই কিন্তু প্রতিবছর রাজস্ব আদায়ের জন্য উচ্চমূল্যে হাটটি ইজারা দেওয়া হচ্ছে।”
Published : 11 Apr 2025, 09:24 AM
ফুটবল খেলায় ভীষণ আগ্রহ শিয়ালখোওয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী তানিয়ার। প্রতিদিনই ক্লাস শেষে সে দৌড়ে চলে যায় স্কুল মাঠে, সহপাঠীদের সঙ্গে ফুটবল খেলতে। তবে কয়েকদিন থেকেই ছোট্ট তানিয়ার মন খারাপ, কারণ স্কুলের মাঠে নাকি আবার হাট বসবে।
লালমনিরহাটের কালীগঞ্জ উপজেলার এ মাঠটির পাশেই শিয়ালখোওয়া এস.সি স্কুল অ্যান্ড কলেজ; কাছেই আছে দা শুলু কুরআন স্মার্ট একাডেমি এবং শিয়ালখোওয়া মোহাম্মদীয়া হাফেজিয়া মাদ্রাসা। এসব প্রতিষ্ঠানের প্রায় দুই হাজার শিক্ষার্থীর মনের অবস্থাও তানিয়ার মতোই।
তানিয়া, রাহুল, সুমাইয়ার মতো শিশুদের কাছে মাঠটা কেবল খেলার জায়গা নয় বরং এটা তাদের শৈশব, স্বপ্ন আর মুক্ত বাতাসে শ্বাস নেওয়ার ঠিকানা।
এই মাঠের পাশেই ৫৮ শতক জমির উপর সরকারিভাবে শেড দেওয়া ঘরে শিয়ালখোওয়া হাটের অবস্থান। সপ্তাহে শনিবার ও বুধবার বসা হাটটি দীর্ঘ দিন ধরেই নির্দিষ্ট সীমা ছাড়িয়ে দখল করে ফেলত স্কুল মাঠ।
মাঠ জুড়ে গরু, ছাগল, হাঁস-মুরগি, সাইকেল, তামাকসহ বিভিন্ন পণ্যের বাজার বসায় সপ্তাহের অন্যদিনগুলোতেও খেলার উপযোগী থাকত না। মারাত্মকভাবে ব্যহত হত শিক্ষার পরিবেশ।
সেজন্যই শিশুদের শৈশব ফিরিয়ে দিতে আন্দোলনে নামেন অভিভাবকরা। তীব্র আন্দোলনের মুখে গত বছর থেকে মাঠে হাট বসানো বন্ধ হয়েছিল। শিক্ষার্থীরা ফিরে পেয়েছিল পড়াশোনার সুষ্ঠু পরিবেশ, খেলাধুলার জায়গা ও নিরাপত্তা। কিন্তু সেই স্বস্তি বেশিদিন স্থায়ী হল না।
কারণ চলতি বছরও ৭৬ লাখ টাকায় ইজারা দেওয়া হয়েছে শিয়ালখোওয়া হাট। আর ব্যবসায়িক লাভের বিনিময়ে স্কুল মাঠটিকে ফের বিকিয়ে দেওয়ার চেষ্টায় নেমেছেন হাটের ইজারাদার।
এ নিয়ে ক্ষোভ জানিয়ে শিয়ালখোওয়া এলাকার আজিজুর রহমান বলেন, “হাট মানেই বিকট শব্দ, ভিড়, বর্জ্য, পশু জবাইয়ের রক্ত-দৃশ্য। এসবের মধ্যে শিক্ষার্থীদের মনোযোগ ধরে রাখা দুরূহ। শুধু তা-ই নয়, হাটের কারণে মাঠ দখল হয়ে গেলে শিশুদের খেলাধুলা ও শরীরচর্চা পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যাবে।”
শিয়ালখোওয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক কাশেম আলী বলেন, “বিদ্যালয়ের মাঠে ফের হাট বসানো হলে শিক্ষার পরিবেশ ক্ষতিগ্রস্ত হবে।”
শিয়ালখোওয়া এসসি উচ্চ বিদ্যালয় অ্যান্ড কলেজের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক মণিন্দ্র নাথ রায় জানান, “অতিরিক্ত লোকসমাগমে শিক্ষার পরিবেশ মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়। এ কারণে আমরা বিষয়টির জন্য প্রশাসনের দিকে তাকিয়ে আছি।”
এ নিয়ে স্থানীয় ব্যবসায়ী আলম মিয়া বলেন, “সরকারের জায়গা নেই কিন্তু প্রতিবছর রাজস্ব আদায়ের জন্য উচ্চমূল্যে হাটটি ইজারা দেওয়া হচ্ছে। হাট ইজারা দেওয়ার পূর্বে প্রশাসনের ভাবা উচিত ছিল জায়গার ব্যাপারে।”
তিনি আরও বলেন, “হাটের যেটুকু জায়গা রয়েছে সেখানেও আছে শেডঘর। অন্যান্য সামগ্রী বিক্রয়ের জন্য তেমন কোনো জায়গা না থাকায় তাদেরকে অন্য জায়গার উপর নির্ভরশীল হতে হচ্ছে।”
তাছাড়া স্থানীয়রা আশঙ্কা করছেন, হাটকে কেন্দ্র করে মাদক, চুরি, ছিনতাইয়ের মতো অপরাধ প্রবণতা বাড়তে পারে—যা সরাসরি প্রভাব ফেলবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর পরিবেশে।
বিদ্যালয়ের শিক্ষক-বাজারের ব্যবসায়ীরাও একমত, হাট বসলে শিক্ষার ক্ষতি হবেই। তবে তারা সরাসরি কোনো পক্ষকে দোষ না দিয়ে অপেক্ষা করছেন প্রশাসনের সিদ্ধান্তের।
শিক্ষকসহ-অভিবাবকরা বলছেন, একটি জাতির ভবিষ্যৎ নির্ভর করে শিশুদের সুস্থ মানসিক ও শারীরিক বিকাশের উপর। সেই বিকাশের পথে যদি প্রতিবন্ধকতা আসে তবে তা শুধুই অমানবিক নয়, ভয়ানক আত্মঘাতীও। কোনো প্রভাবশালীর ব্যবসায়িক স্বার্থে বিদ্যালয়ের মাঠে হাট বসানোর মতো সিদ্ধান্ত যদি কার্যকর হয় তবে আমাদের ভবিষ্যৎ তো কেবল কাগজে-কলমেই আলোকিত থাকবে।
এ বিষয়ে কথা বলতে হাট ইজারাদার ও শিয়ালখোওয়া হাটের ব্যবসায়ী আসাদুল ইসলাম হিরুর মোবাইলে একাধিকবার কল করা হলেও সেটি বন্ধ পাওয়া যায়।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জাকিয়া সুলতানা জানিয়েছেন, “বিষয়টি নিয়ে আলোচনা চলছে, এবং বিকল্প জায়গা খোঁজার চেষ্টা করা হচ্ছে।”
জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা মুজিবর রহমানও অভিভাবকদের উদ্বেগের বিষয়টি স্বীকার করে যথাযথ পদক্ষেপের আশ্বাস দিয়েছেন।